হৃদস্পন্দন: আপনার হৃদয়ের ছন্দ বোঝা
আচ্ছা, কখনও কি মনে হয়েছে বুকের ভেতর একটা ড্রাম বাজছে? যখন টেনশন হয়, দৌড়ানোর পর, কিংবা পছন্দের মানুষটির সামনে পড়লে? ওটাই কিন্তু হার্টবিট! শুধু ড্রাম নয়, এটা আপনার জীবন বাঁচানোর স্পন্দন। চলুন, আজ আমরা হার্টবিট বা হৃদস্পন্দন নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা করি। জানবো, হার্টবিট কী, কেন হয়, আর এর ছন্দ কখন তালগোল পাকালে ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হবে।
হার্টবিট কী?
হার্টবিট (Heartbeat) মানে হল হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে রক্ত পাম্প করার প্রক্রিয়া। আমাদের হৃদপিণ্ড একটা পাম্প মেশিনের মতো, যা সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করে। এই পাম্পিংয়ের সময় হৃদপিণ্ডের পেশী সংকুচিত হয় (সিস্টোল) এবং প্রসারিত হয় (ডায়াস্টোল)। এই সংকোচন ও প্রসারণের ফলেই আমরা হার্টবিট অনুভব করি। অনেকটা ঢিপ ঢিপ শব্দ শোনার মতো, তাই না?
হার্টবিট কিভাবে কাজ করে?
হার্টবিট একটা জটিল প্রক্রিয়া। আমাদের হৃদপিণ্ডের চারটি প্রকোষ্ঠ আছে: দুটি অলিন্দ (Atria) এবং দুটি নিলয় (Ventricles)।
১. অলিন্দ থেকে রক্ত নিলয়ে আসে।
২. নিলয় সংকুচিত হয়ে রক্ত ফুসফুস ও শরীরের অন্যান্য অংশে পাঠিয়ে দেয়।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে একটা ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমের মাধ্যমে। হৃদপিণ্ডের সাইনো atrial (SA) নোড নামক একটি বিশেষ অংশ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইম্পালস তৈরি হয়। এই ইম্পালস পুরো হৃদপিণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং হৃদপিণ্ডকে সংকুচিত হতে সাহায্য করে।
হার্টবিট কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হার্টবিট আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষকে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে। ভাবুন তো, যদি হার্টবিট থেমে যায়? তাহলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাদের শরীরের সবকিছু অচল হয়ে যাবে। তাই হার্টবিট শুধু একটা শব্দ নয়, এটা জীবন!
স্বাভাবিক হার্টবিট কত হওয়া উচিত?
একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক হার্টবিট প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ১০০ বার হওয়া উচিত। তবে, বয়সের সাথে সাথে এটা কম বেশি হতে পারে। শিশুদের হার্টবিট সাধারণত বেশি থাকে, আর বয়স্কদের কম। ব্যায়াম করার সময় বা অন্য কোনো শারীরিক পরিশ্রমের সময় হার্টবিট বেড়ে যায়।
হার্টবিট পরিমাপ করার উপায়
হার্টবিট মাপা খুবই সহজ। আপনি নিজেই এটা করতে পারেন।
১. আপনার হাতের কব্জির ভেতরের দিকে দুটি আঙুল রাখুন।
২. ঘড়ি ধরে ১৫ সেকেন্ডের জন্য পালস গুনুন।
৩. এবার সেই সংখ্যাকে ৪ দিয়ে গুণ করুন।
তাহলেই পেয়ে যাবেন আপনার প্রতি মিনিটের হার্টবিট।
হার্টবিট মাপার আধুনিক গ্যাজেট
আজকাল স্মার্টওয়াচ আর ফিটবিট-এর যুগে হার্টবিট মাপা আরও সহজ হয়ে গেছে। শুধু হাতে পরলেই হলো, এরা আপনার হার্টবিট মেপে জানিয়ে দেবে।
হার্টবিট অনিয়মিত হওয়ার কারণ
হার্টবিট সবসময় একই তালে নাও চলতে পারে। অনেক কারণে এটা অনিয়মিত হতে পারে।
- মানসিক চাপঃ অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করলে হার্টবিট বেড়ে যেতে পারে।
- শারীরিক পরিশ্রম: ব্যায়াম বা দৌড়ানোর সময় হার্টবিট বাড়ে।
- অতিরিক্ত ক্যাফেইন: চা, কফি বেশি খেলে হার্টবিট বাড়তে পারে।
- কিছু রোগ: হৃদরোগ, থাইরয়েড সমস্যা, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি কারণেও হার্টবিট অনিয়মিত হতে পারে।
হার্টবিট খুব বেশি হলে কী হয়?
হার্টবিট যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় (১০০-এর উপরে), তাহলে তাকে ট্যাকিকার্ডিয়া (Tachycardia) বলে। এর কারণে মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, এমনকি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
হার্টবিট খুব কম হলে কী হয়?
হার্টবিট যদি স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয় (৬০-এর নিচে), তাহলে তাকে ব্র্যাডিকার্ডিয়া (Bradycardia) বলে। এর কারণে দুর্বল লাগা, ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
হার্টবিট স্বাভাবিক রাখার উপায়
জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনলে হার্টবিটকে স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।
- নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য ব্যায়াম করুন।
- স্বাস্থ্যকর খাবার: ফল, সবজি, শস্য জাতীয় খাবার বেশি খান। ফ্যাট ও কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো জরুরি।
- মানসিক চাপ কমান: যোগা, মেডিটেশন, বা পছন্দের কাজ করার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো যায়।
- ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার: এগুলো হার্টের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
খাবার এবং পানীয়ের ভূমিকা
কিছু খাবার ও পানীয় আছে যা হার্টবিটকে প্রভাবিত করতে পারে।
১. ক্যাফেইন: কফি, চা, এবং কিছু এনার্জি ড্রিংকস হার্টবিট বাড়াতে পারে।
২. অ্যালকোহল: অতিরিক্ত মদ্যপান হার্টবিট অনিয়মিত করতে পারে।
৩. সোডিয়াম: লবণ বেশি খেলে রক্তচাপ বাড়ে, যা হার্টের জন্য ক্ষতিকর।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
যদি আপনি নিয়মিতভাবে অনিয়মিত হার্টবিট অনুভব করেন, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এছাড়া, যদি বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হয়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ডাক্তার আপনার শারীরিক পরীক্ষা করার পাশাপাশি কিছু পরীক্ষাও করতে পারেন, যেমন:
- ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG): এটি হৃদপিণ্ডের ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটি রেকর্ড করে।
- ইকোকার্ডিওগ্রাম (Echocardiogram): এটি হৃদপিণ্ডের আলট্রাসাউন্ড।
- হোল্টার মনিটর (Holter Monitor): এটি ২৪-৪৮ ঘণ্টা ধরে আপনার হার্টবিট রেকর্ড করে।
হার্টবিট নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
আমাদের সমাজে হার্টবিট নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে।
- বুকের বাঁ দিকে ব্যাথা হলেই হার্টের সমস্যা: সবসময় তা নয়, অনেক সময় গ্যাস বা অন্য কারণেও ব্যথা হতে পারে।
- হার্টবিট বাড়লেই বিপদ: ব্যায়াম করলে বা টেনশন হলে হার্টবিট বাড়া স্বাভাবিক।
- হার্টের ওষুধ একবার শুরু করলে সারা জীবন খেতে হয়: কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ বন্ধ করা যায়, তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নয়।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও হার্টবিট
জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন এনে আপনি আপনার হার্টবিটকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন।
- সক্রিয় থাকুন: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য হাঁটুন, দৌড়ান, সাঁতার কাটুন বা অন্য কোনো ব্যায়াম করুন।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন: অতিরিক্ত ওজন হৃদপিণ্ডের উপর চাপ ফেলে।
- ধূমপান পরিহার করুন: ধূমপান হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
- মানসিক চাপ কমান: যোগা ও মেডিটেশন করুন, শখের কাজকর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
হার্টবিটের প্রকারভেদ
হার্টবিট বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন:
- স্বাভাবিক সাইনাস রিদম (Normal Sinus Rhythm): এটি স্বাভাবিক হার্টবিট।
- অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন (Atrial Fibrillation): এটি অনিয়মিত ও দ্রুত হার্টবিট।
- ভেন্ট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া (Ventricular Tachycardia): এটি বিপজ্জনক দ্রুত হার্টবিট।
হার্টবিট ও ব্যায়াম
ব্যায়াম করার সময় হার্টবিট বাড়া স্বাভাবিক। ব্যায়ামের সময় আপনার টার্গেট হার্ট রেট কত হওয়া উচিত, তা জেনে ব্যায়াম করা ভালো।
টার্গেট হার্ট রেট কিভাবে বের করবেন?
নিজের সর্বোচ্চ হার্ট রেট (Maximum Heart Rate) বের করার জন্য ২২০ থেকে নিজের বয়স বিয়োগ করুন।
উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার বয়স ৩০ বছর হয়, তাহলে আপনার সর্বোচ্চ হার্ট রেট হবে ২২০ – ৩০ = ১৯০ বিপিএম (beats per minute)।
ব্যায়ামের সময় আপনার টার্গেট হার্ট রেট আপনার সর্বোচ্চ হার্ট রেটের ৫০% থেকে ৮৫% এর মধ্যে হওয়া উচিত।
হার্টবিট এবং বয়স
বয়সের সাথে সাথে হার্টবিটের স্বাভাবিক মাত্রা পরিবর্তিত হয়। শিশুদের হার্টবিট বেশি থাকে, কারণ তাদের শরীর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বয়স্কদের হার্টবিট সাধারণত কম থাকে, কারণ তাদের হৃদপিণ্ড ধীরে ধীরে কাজ করে।
শিশুদের হার্টবিট
- নবজাতক (০-১ মাস): ৭০-১৯০ বিপিএম
- শিশু (১-১১ মাস): ৮০-১৬০ বিপিএম
- শিশু (১-২ বছর): ৮০-১৩০ বিপিএম
- স্কুলগামী শিশু (৬-১৫ বছর): ৭০-১০০ বিপিএম
প্রাপ্তবয়স্কদের হার্টবিট
- প্রাপ্তবয়স্ক (১৮+ বছর): ৬০-১০০ বিপিএম
হার্টবিট ও গর্ভাবস্থা
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে অনেক পরিবর্তন আসে, যার মধ্যে হার্টবিটও একটি। গর্ভাবস্থায় হার্টবিট সাধারণত বেড়ে যায়। এর কারণ হলো, মায়ের শরীরকে গর্ভের শিশুর জন্য অতিরিক্ত রক্ত সরবরাহ করতে হয়।
গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক হার্টবিট
গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিক হার্টবিট প্রতি মিনিটে ৮০ থেকে ১২০ বার হতে পারে। তবে, যদি হার্টবিট খুব বেশি বা খুব কম হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
হার্টবিট নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- একটি সুস্থ হৃদপিণ্ড প্রতিদিন প্রায় ১ লক্ষ বার স্পন্দিত হয়।
- মহিলাদের হার্টবিট পুরুষদের চেয়ে সাধারণত একটু বেশি থাকে।
- জিরাফের হার্টবিট মিনিটে ৩০ বার, আর হামিংবার্ডের হার্টবিট মিনিটে ১,২০০ বারের বেশি!
শেষ কথা
হার্টবিট আমাদের জীবনের স্পন্দন। একে অবহেলা না করে, এর প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। সুস্থ জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে আমরা আমাদের হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখতে পারি। নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন, সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন!