শুনতে কেমন লাগছে, তাই না? “হিজরা” শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন এসে ভিড় করে মনে। আচ্ছা, হিজরা আসলে কারা? কেন তাদের জীবনযাত্রা আমাদের থেকে আলাদা? এই প্রশ্নগুলো নিশ্চয়ই আপনার মনেও উঁকি দেয়, তাই না? আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলব খোলাখুলি। কোনো লুকোছাপা নয়, একেবারে মন খুলে আলোচনা!
হিজরা: পরিচয় ও সংজ্ঞা
হিজরা কারা, এই প্রশ্নের সহজ উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ, হিজরা কোনো একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গ পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মূলত, হিজরা শব্দটি দক্ষিণ এশিয়ার কিছু সংস্কৃতিতে সেই সকল ব্যক্তিকে বোঝায়, যাদের জন্মগত লিঙ্গ পরিচয় এবং তাদের অনুভূত লিঙ্গ পরিচয়ের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। কেউ জন্মগতভাবে পুরুষ হয়েও নারীসত্ত্বা অনুভব করেন, আবার কেউ নারী হয়েও পুরুষের মতো অনুভব করেন। তবে, শুধু এইটুকু বললেই হিজরাদের পরিচয় শেষ হয়ে যায় না।
হিজরা: একটি বহুমাত্রিক পরিচয়
হিজরা পরিচয়কে বুঝতে হলে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে:
-
শারীরিক গঠন: জন্মগতভাবে হিজরাদের শারীরিক গঠন সাধারণ নারী বা পুরুষের থেকে ভিন্ন হতে পারে। কারো শরীরে নারী এবং পুরুষ উভয়ের বৈশিষ্ট্যই দেখা যায়।
-
লিঙ্গ পরিচয়: হিজরাদের লিঙ্গ পরিচয় তাদের নিজেদের অনুভূতির উপর নির্ভরশীল। তারা নিজেদের পুরুষ, নারী অথবা উভয়ের মাঝামাঝি হিসেবে ভাবতে পারেন।
-
সামাজিক পরিচয়: সমাজে হিজরাদের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। তারা দলবদ্ধভাবে বসবাস করেন এবং তাদের নিজস্ব রীতিনীতি অনুসরণ করেন।
হিজরা: শুধু তৃতীয় লিঙ্গ নয়
আমাদের দেশে হিজড়াদের “তৃতীয় লিঙ্গ” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, এই পরিচয়টি হিজরাদের সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে না। কারণ, হিজরা পরিচয়টি শুধুমাত্র লিঙ্গ পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ব্যক্তিগত অনুভূতির সংমিশ্রণ।
হিজরাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য
হিজরাদের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ভারতীয় উপমহাদেশে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনেক গভীর। মুঘল আমলে রাজদরবারে হিজরাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তারা প্রাসাদের অন্দরমহলের দেখাশোনা করতেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত থাকতেন।
প্রাচীন সাহিত্যে হিজড়া
প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে, যেমন মহাভারত ও কামসূত্রে, হিজড়াদের উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থগুলোতে তাদের উপস্থিতি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের অংশ হিসেবেই দেখা যায়।
মুঘল আমলে হিজড়া
মুঘল শাসনামলে হিজড়ারা রাজদরবারে বিশেষ স্থান লাভ করেন। তারা হারেমের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করতেন এবং তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাও ছিল।
ব্রিটিশ শাসন ও হিজড়া
ব্রিটিশ শাসনামলে হিজড়াদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হতে শুরু করে। তাদের সামাজিক মর্যাদা কমতে থাকে এবং তারা প্রান্তিক অবস্থানে চলে যান।
হিজরাদের সামাজিক জীবন
হিজরাদের জীবনযাত্রা সাধারণ মানুষের থেকে অনেক আলাদা। তারা সমাজে নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হন। শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা – সব ক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে থাকেন।
হিজরাদের পেশা
সাধারণত, হিজরারা নাচ-গান, ভিক্ষাবৃত্তি অথবা যৌনকর্মের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। কারণ, সমাজের মূল স্রোতে তাদের জন্য কাজের সুযোগ খুবই কম।
হিজরাদের বাসস্থান
হিজরারা সাধারণত দলবদ্ধভাবে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসবাস করেন। তাদের এই বসতিগুলোকে “হিজড়া বাড়ি” বলা হয়।
হিজরাদের সংস্কৃতি
হিজরাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। তাদের গান, নাচ, পোশাক এবং আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুই স্বতন্ত্র।
হিজরাদের অধিকার ও আইনি সুরক্ষা
সংবিধান অনুযায়ী, হিজরারাও বাংলাদেশের নাগরিক এবং অন্যান্য নাগরিকদের মতো সমান অধিকার ভোগ করার অধিকারী। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের “তৃতীয় লিঙ্গ” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর ফলে তারা শিক্ষা, চাকরি এবং অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পান।
হিজরাদের জন্য সরকারি উদ্যোগ
হিজরাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া, তাদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করা হচ্ছে।
হিজরাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি
হিজরাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও পুরোপুরি ইতিবাচক নয়। অনেকেই তাদের অবজ্ঞা করেন এবং খারাপ চোখে দেখেন। তবে, ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি বাড়ছে।
হিজরাদের নিয়ে কিছু ভুল ধারণা (Misconceptions about Hijras)
আমাদের সমাজে হিজরাদের নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এই ধারণাগুলো তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করে। আসুন, আমরা কয়েকটি ভুল ধারণা সম্পর্কে জেনে নিই:
-
ভুল ধারণা ১: হিজরারা অভিশপ্ত।
- সত্য: হিজরারা কোনো অভিশাপ নয়। এটি একটি শারীরিক ও মানসিক অবস্থা।
-
ভুল ধারণা ২: হিজরারা সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
- সত্য: হিজরারা সমাজের অংশ। তারা সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন।
-
ভুল ধারণা ৩: হিজরারা শুধু যৌনকর্মী।
* **সত্য:** হিজরাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চান এবং সমাজের মূল স্রোতে শামিল হতে চান।
হিজড়া বিষয়ক কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)
হিজরাদের নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
হিজরা কিভাবে হয়? (Hijra Kivabe Hoy)
হিজরা হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে জন্মগত শারীরিক ভিন্নতা অন্যতম। এছাড়া, হরমোনের অভাব অথবা অতিরিক্ত নিঃসরণের কারণেও এমনটা হতে পারে। তবে, অনেক ক্ষেত্রে এর কারণ এখনও পর্যন্ত অজানা।
হিজরাদের বিয়ে হয়? (Hijrader Biye Hoy?)
হিজড়াদের মধ্যে বিয়ের প্রচলন আছে। তবে, এটি তাদের নিজস্ব সামাজিক রীতিনীতির অংশ। বাংলাদেশে আইনগতভাবে হিজড়াদের বিবাহের স্বীকৃতি নেই।
হিজরাদের মাসিক হয়? (Hijrader Masik Hoy?)
সব হিজড়ার মাসিক হয় না। যাদের শারীরিক গঠন নারীর মতো, তাদের মাসিক হতে পারে। কিন্তু, যাদের শারীরিক গঠন ভিন্ন, তাদের মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা কম।
হিজরাদের বাচ্চা হয়? (Hijrader Baccha Hoy?)
সাধারণত হিজড়াদের সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। তবে, ব্যতিক্রম হিসেবে কারো কারো ক্ষেত্রে এটি সম্ভব হতে পারে।
হিজরাদের লিঙ্গ পরিবর্তন (Gender Reassignment)
হিজড়াদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করতে চান। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এর জন্য অনেক সাহস ও ধৈর্যের প্রয়োজন।
হিজরাদের প্রতি আমাদের করণীয় (What should we do?)
হিজরাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত। তাদের সম্মান করা এবং তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। এছাড়া, তাদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা কিছু সংস্থা
বাংলাদেশে হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন অনেক সংস্থা রয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংস্থা হলো:
- বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (Bandhu Social Welfare Society)
- badhan hijra sangha (বন্ধন হিজড়া সংঘ )
- জাগো নারী উন্নয়ন সংস্থা (Jago Nari Unnayan Sangstha)
এই সংস্থাগুলো হিজড়াদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং আইনি সহায়তা প্রদান করে থাকে।
সংস্থার নাম | কার্যক্রম |
---|---|
বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (BSWS) | স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অধিকার রক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি |
badhan hijra sangha | হিজড়াদের অধিকার আদায়, আইনি সহায়তা এবং সামাজিক সুরক্ষা |
জাগো নারী উন্নয়ন সংস্থা | শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে হিজড়াদের ক্ষমতায়ন |
উপসংহার
হিজরা আমাদের সমাজেরই একটা অংশ। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি inclusive সমাজ গড়ি, যেখানে হিজরারাও মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।
এই ব্লগ পোস্টটি কেমন লাগলো, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর হিজড়া বিষয়ে যদি আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে দ্বিধা ছাড়াই জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আপনার প্রতিটি মতামত আমাদের কাছে মূল্যবান।