আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন আপনারা? আজ আমরা কথা বলবো এমন একটি বিষয় নিয়ে যা নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। বিষয়টি হলো – হিজড়া সম্প্রদায়। “হিজড়া কাকে বলে” – এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো আমরা, পাশাপাশি তাদের জীবন, সমাজ এবং অধিকার সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করবো। চলুন, শুরু করা যাক!
হিজড়া: সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ
হিজড়া শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে একটি বিশেষ ছবি ভেসে ওঠে, তাই না? কিন্তু এই শব্দটি আসলে কী বোঝায়? শুধু শারীরিক গঠনই কি একজন মানুষকে হিজড়া হিসেবে পরিচিত করে তোলে, নাকি এর পেছনে আরও কিছু কারণ আছে? চলুন, গভীরে যাওয়া যাক।
হিজড়া কারা: একটি সংজ্ঞা
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, হিজড়া হলো সেই ব্যক্তি যাদের জন্মগত লিঙ্গ পরিচয় তাদের লৈঙ্গিক অনুভূতির সঙ্গে মেলে না। অর্থাৎ, একজন মানুষ হয়তো পুরুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু তিনি মানসিকভাবে নারী অনুভব করেন, অথবা এর বিপরীত। হিজড়ারা নিজেদের নারী বা পুরুষ কোনো শ্রেণীতেই অন্তর্ভুক্ত করতে চান না; বরং তারা নিজেদের একটি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।
হিজড়াদের প্রকারভেদ
হিজড়াদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারভেদ দেখা যায়। এদের মধ্যে কয়েকজন হলো:
-
জন্মগত হিজড়া: যারা শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহন করেন।
-
রূপান্তরিত হিজড়া: যারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিজেদের লিঙ্গ পরিবর্তন করেছেন।
-
মানসিক হিজড়া: যাদের শারীরিক গঠন পুরুষ বা নারীর মতো হলেও তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হন।
হিজড়া: শুধু একটি শব্দ নয়, একটি জীবন
হিজড়া শুধু একটি শব্দ নয়, এটি একটি জীবন। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের অনুভূতি আছে, স্বপ্ন আছে, এবং আমাদের মতোই বাঁচার অধিকার আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে তাদের প্রায়ই অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়।
হিজড়াদের ইতিহাস: এক ঝলক
হিজড়াদের ইতিহাস কিন্তু আজকের নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে এর ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরনো। মুঘল আমলে হিজড়াদের রাজদরবারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হতো। তারা অন্তঃপুরের দেখাশোনা করতেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তাদের সরব উপস্থিতি ছিল।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
হিজড়াদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। তারা বিশেষ ধরনের গান ও নাচ পরিবেশন করেন, যা তাদের সংস্কৃতির অংশ। তাদের গুরু-শিষ্য পরম্পরা রয়েছে, এবং এই পরম্পরার মাধ্যমেই তারা তাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
তবে সময়ের পরিবর্তনে অনেক কিছুই বদলে গেছে। এখন হিজড়াদের জীবন আগের মতো সহজ নয়। সমাজের মূলস্রোত থেকে তারা অনেকটাই বিচ্ছিন্ন।
হিজড়াদের জীবন: বাস্তবতা ও সংগ্রাম
হিজড়াদের জীবন মোটেও সহজ নয়। জন্ম থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে তাদের নানা প্রতিকূলতার सामना করতে হয়। পরিবার তাদের অনেক সময় মেনে নিতে চায় না, সমাজের মানুষ বাঁকা চোখে দেখে, আর কর্মসংস্থানের সুযোগ তো প্রায় নেই বললেই চলে।
সামাজিক বৈষম্য
হিজড়াদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো নেতিবাচক। তাদের প্রায়ই উপহাস করা হয়, খারাপ নামে ডাকা হয়, এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা অবহেলিত হন। শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হন।
শিক্ষাক্ষেত্রে বাধা
অনেক হিজড়া শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। স্কুলে তাদের বুলিং করা হয়, শিক্ষকরাও অনেক সময় তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন না। ফলে, তারা পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
কর্মসংস্থানের অভাব
শিক্ষা না থাকার কারণে হিজড়াদের জন্য ভালো চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় তারা ভিক্ষাবৃত্তি বা অন্য কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়।
পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা
পরিবার হলো মানুষের প্রথম আশ্রয়স্থল। কিন্তু অনেক হিজড়া পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত হন। বাবা-মা তাদের বোঝা মনে করেন, ভাই-বোনেরা তাদের সঙ্গে মিশতে চান না। ফলে, তারা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন এবং অনেক সময় হতাশায় ভোগেন।
মানসিক স্বাস্থ্য
সামাজিক ও পারিবারিক চাপের কারণে হিজড়াদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা যায়। তাদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
হিজড়াদের অধিকার: আইন ও সমাজ
সংবিধান অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। হিজড়ারাও এই দেশের নাগরিক, তাই তাদেরও সমান অধিকার পাওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে কি তা হয়?
আইনগত স্বীকৃতি
বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর ফলে, তারা এখন সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারেন, নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন, এবং অন্যান্য নাগরিক সুবিধাও ভোগ করতে পারেন৷
সামাজিক স্বীকৃতি
আইনগত স্বীকৃতি পেলেও হিজড়াদের সামাজিক স্বীকৃতি এখনো অনেক দূরে। সমাজের মানুষ তাদের স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে এখনো প্রস্তুত নয়। তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে আরো অনেক কাজ করতে হবে।
গণমাধ্যমের ভূমিকা
গণমাধ্যম হিজড়াদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারে। তাদের জীবন ও সংগ্রামের গল্পগুলো তুলে ধরলে সমাজের মানুষ তাদের সম্পর্কে জানতে পারবে এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে।
শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন
স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে হিজড়াদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই তাদের সম্পর্কে জানতে পারবে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।
হিজড়া বিষয়ক কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর (FAQ)
হিজড়া সম্প্রদায় নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। এখানে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
হিজড়া হওয়ার কারণ কী?
হিজড়া হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে শারীরিক, মানসিক এবং জিনগত কারণ অন্যতম। অনেক সময় জন্মগত ত্রুটির কারণেও কেউ হিজড়া হতে পারেন। আবার, অনেকে মানসিকভাবে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণে নিজেদের হিজড়া হিসেবে পরিচয় দেন।
হিজড়াদের জীবনযাপন কেমন?
হিজড়াদের জীবনযাপন বেশ কঠিন। তারা সাধারণত দলবদ্ধভাবে বসবাস করেন এবং তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন মেনে চলেন। তাদের প্রধান কাজ হলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ-গান পরিবেশন করা এবং মানুষের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া।
হিজড়ারা কি বিয়ে করতে পারেন?
আইনগতভাবে, হিজড়াদের বিয়ের অধিকার এখনো স্বীকৃত নয়। তবে, তারা নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং একসঙ্গে বসবাস করেন।
হিজড়াদের প্রতি আমাদের কেমন ব্যবহার করা উচিত?
হিজড়াদের প্রতি আমাদের সম্মানজনক ব্যবহার করা উচিত। তাদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া উচিত এবং তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা বা তাদের উপহাস করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা কত?
সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তবে, বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
হিজড়াদের জন্য সরকারের কী কী সুযোগ-সুবিধা রয়েছে?
বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা চালু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা বৃত্তি, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ। এছাড়া, তাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
আমাদের করণীয়: একটি মানবিক সমাজ গড়ার পথে
আমরা যদি একটি সুন্দর ও মানবিক সমাজ গড়তে চাই, তাহলে হিজড়াদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাদের সম্মান করতে হবে, তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং তাদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে হবে।
সচেতনতা তৈরি করা
হিজড়াদের সম্পর্কে সমাজের মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তাদের জীবন ও সংগ্রামের গল্পগুলো বেশি করে প্রচার করতে হবে।
সহানুভূতিশীল হওয়া
হিজড়াদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। তাদের কষ্টগুলো বুঝতে হবে এবং তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
সাহায্যের হাত বাড়ানো
হিজড়াদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাদের স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করতে হবে।
বৈষম্য দূর করা
হিজড়াদের প্রতি সমাজের সকল স্তরের বৈষম্য দূর করতে হবে। তাদের সমান সুযোগ দিতে হবে এবং তাদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে।
হিজড়া: কিছু অতিরিক্ত তথ্য
এই অংশে আমরা হিজড়া সম্প্রদায় সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানবো।
হিজড়াদের ভাষা ও সংস্কৃতি
হিজড়াদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তারা “ফিরনি” নামক একটি গোপন ভাষায় কথা বলেন, যা বাইরের মানুষের জন্য বোঝা কঠিন। তাদের সংস্কৃতিতে নাচ-গান, বিশেষ পোশাক এবং আচার-অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
হিজড়াদের গুরু প্রথা
হিজড়াদের মধ্যে গুরু প্রথা প্রচলিত। প্রত্যেক হিজড়া কোনো না কোনো গুরুর অধীনে থাকেন এবং তাদের নির্দেশ মেনে চলেন। গুরুরাই তাদের জীবনযাপন এবং সামাজিক রীতিনীতি শেখান।
হিজড়াদের ভবিষ্যৎ
হিজড়াদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে, যদি আমরা সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়াই। তাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিলে তারা সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।
হিজড়া বিষয়ক কিছু ভুল ধারণা
আমাদের সমাজে হিজড়া সম্প্রদায় নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এই ধারণাগুলো দূর করা জরুরি।
ভুল ধারণা ১: হিজড়ারা অভিশাপ
অনেকে মনে করেন হিজড়ারা অভিশাপ। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। হিজড়ারাও মানুষ এবং তাদেরও স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার আছে।
ভুল ধারণা ২: হিজড়ারা শুধু নাচ-গান করে
অনেকে মনে করেন হিজড়ারা শুধু নাচ-গান করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এটা সত্যি নয়। অনেক হিজড়া এখন পড়াশোনা করছেন এবং ভালো চাকরিও করছেন।
ভুল ধারণা ৩: হিজড়ারা সমাজের বোঝা
অনেকে মনে করেন হিজড়ারা সমাজের বোঝা। এটা ভুল ধারণা। হিজড়ারাও সমাজের অংশ এবং তারা সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন।
উপসংহার
“হিজড়া কাকে বলে” – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা জানলাম, হিজড়ারা আমাদের সমাজেরই অংশ। তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত এবং তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি সুন্দর ও মানবিক সমাজ গড়ি, যেখানে সবাই সমান সুযোগ পাবে এবং মর্যাদার সাথে বাঁচতে পারবে।
যদি এই বিষয়ে আপনার কোন মতামত থাকে তাহলে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ!