জারণ-বিজারণ: রসায়নের এক মজার খেলা, বুঝবেন কী করে?
আচ্ছা, দৈনন্দিন জীবনে কত কিছুই তো ঘটছে, তাই না? লোহার গেটে মর্চে পড়া থেকে শুরু করে আমাদের শরীরে খাবার হজম হওয়া – সবকিছুর পেছনেই কিন্তু লুকিয়ে আছে রসায়নের খেলা। আর এই খেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হল জারণ-বিজারণ (Oxidation-Reduction)। ভয় পাবেন না! নামটা একটু কঠিন হলেও, জিনিসটা কিন্তু খুবই মজার। আজ আমরা এই জারণ-বিজারণ নিয়েই সহজ ভাষায় আলোচনা করব, যাতে রসায়নের এই জটিল বিষয়টাও আপনার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।
জারণ বিজারণ কী? (What is Oxidation-Reduction?)
জারণ (Oxidation) আর বিজারণ (Reduction) – এই দুটো শব্দ আসলে একটা মুদ্রার দুই পিঠ। এরা সবসময় একসঙ্গেই ঘটে। একটা বিক্রিয়ায় যখন কোনো পরমাণু, আয়ন বা অণু ইলেকট্রন বর্জন করে, তখন সেটা হল জারণ। আর যখন কোনো পরমাণু, আয়ন বা অণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে, তখন সেটা হল বিজারণ।
ব্যাপারটা অনেকটা এরকম – ধরুন, আপনার কাছে কিছু চকলেট আছে। আপনি যদি সেই চকলেটগুলো আপনার বন্ধুকে দেন, তাহলে আপনার চকলেট কমে গেল (জারণ), আর আপনার বন্ধুর চকলেট বেড়ে গেল (বিজারণ)। রসায়নের ক্ষেত্রেও ইলেকট্রন দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে এই জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া ঘটে।
জারণ (Oxidation)
-
সংজ্ঞা: কোনো পদার্থ কর্তৃক ইলেকট্রন বর্জন করার প্রক্রিয়াকে জারণ বলে।
-
উদাহরণ: লোহার মর্চে পড়া (Iron rusting)। এখানে লোহা (Fe) ইলেকট্রন বর্জন করে ফেরিক অক্সাইড (Fe₂O₃) তৈরি করে।
Fe → Fe²⁺ + 2e⁻
-
জারণ সংখ্যা বৃদ্ধি: জারণ প্রক্রিয়ায় কোনো মৌলের জারণ সংখ্যা (Oxidation Number) বৃদ্ধি পায়।
বিজারণ (Reduction)
-
সংজ্ঞা: কোনো পদার্থ কর্তৃক ইলেকট্রন গ্রহণ করার প্রক্রিয়াকে বিজারণ বলে।
-
উদাহরণ: কপার অক্সাইডের (CuO) সাথে হাইড্রোজেনের (H₂) বিক্রিয়া। এখানে কপার অক্সাইড থেকে কপার (Cu) উৎপন্ন হওয়ার সময় অক্সিজেন অপসারিত হয় এবং কপার ইলেকট্রন গ্রহণ করে।
CuO + H₂ → Cu + H₂O
-
জারণ সংখ্যা হ্রাস: বিজারণ প্রক্রিয়ায় কোনো মৌলের জারণ সংখ্যা হ্রাস পায়।
জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া চেনার সহজ উপায়
জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়াগুলো চেনার জন্য কিছু সহজ টিপস জেনে রাখা ভালো:
- অক্সিজেনের সংযোগ: কোনো মৌলের সাথে অক্সিজেনের সংযোগ ঘটলে সাধারণত জারণ হয়। যেমন: কার্বনের সাথে অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) তৈরি হওয়া।
- হাইড্রোজেনের অপসারণ: কোনো যৌগ থেকে হাইড্রোজেন অপসারিত হলে জারণ হয়।
- ধাতুর সংযোগ: কোনো যৌগের সাথে ধাতুর সংযোগ ঘটলে বিজারণ হতে পারে।
- অধাতুর অপসারণ: কোনো যৌগ থেকে অধাতু অপসারিত হলে বিজারণ হতে পারে।
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার প্রকারভেদ (Types of Redox Reactions)
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকারভেদ নিচে আলোচনা করা হলো:
সরাসরি জারণ-বিজারণ (Direct Redox Reaction)
এই ধরনের বিক্রিয়ায় জারক (Oxidizing agent) সরাসরি বিজারকের (Reducing agent) সাথে বিক্রিয়া করে।
উদাহরণ:
Zn(s) + Cu²⁺(aq) → Zn²⁺(aq) + Cu(s)
এখানে, জিংক (Zn) কপার আয়নকে (Cu²⁺) বিজারিত করে এবং নিজে জারিত হয়।
অপ্রত্যক্ষ জারণ-বিজারণ (Indirect Redox Reaction)
এই ধরনের বিক্রিয়ায় জারক ও বিজারক সরাসরি সংস্পর্শে আসে না, কিন্তু একটি পরিবাহীর মাধ্যমে ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হয়।
উদাহরণ:
ড্যানিয়েল কোষ (Daniell Cell)। এখানে জিংক সালফেট (ZnSO₄) দ্রবণে ডোবানো জিংকের দণ্ড এবং কপার সালফেট (CuSO₄) দ্রবণে ডোবানো কপারের দণ্ড একটি লবণ সেতুর (Salt Bridge) মাধ্যমে যুক্ত থাকে।
সমানুপাতিক জারণ-বিজারণ (Disproportionation Reaction)
এই ধরনের বিক্রিয়ায় একটি পদার্থ একই সাথে জারিত এবং বিজারিত হয়।
উদাহরণ:
2H₂O₂(aq) → 2H₂O(l) + O₂(g)
এখানে হাইড্রোজেন পারক্সাইড (H₂O₂) একই সাথে বিজারিত হয়ে জল (H₂O) এবং জারিত হয়ে অক্সিজেন (O₂) উৎপন্ন করে।
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার উদাহরণ (Examples of Redox Reactions)
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া আমাদের চারপাশে প্রায় সর্বত্রই বিদ্যমান। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দেওয়া হলো:
-
শ্বসন (Respiration): আমাদের শরীরে খাদ্য জারিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে। এখানে গ্লুকোজ অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই অক্সাইড, জল এবং শক্তি উৎপন্ন করে।
C₆H₁₂O₆ + 6O₂ → 6CO₂ + 6H₂O + Energy
-
আলোসংশ্লেষণ (Photosynthesis): উদ্ভিদেরা কার্বন ডাই অক্সাইড ও জল থেকে সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে গ্লুকোজ তৈরি করে। এটি শ্বসনের বিপরীত প্রক্রিয়া।
6CO₂ + 6H₂O + Light Energy → C₆H₁₂O₆ + 6O₂
-
ব্যাটারির কার্যক্রম (Battery Function): ব্যাটারিতে রাসায়নিক শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়, যা জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে।
-
ধাতু নিষ্কাশন (Metal Extraction): বিভিন্ন ধাতু যেমন লোহা, তামা ইত্যাদি তাদের অক্সাইড আকরিক থেকে নিষ্কাশন করতে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া ব্যবহার করা হয়।
-
দহন (Combustion): কোনো জ্বালানি অক্সিজেনের সাথে পুড়ে কার্বন ডাই অক্সাইড, জল এবং তাপ উৎপন্ন করে। এটি একটি দ্রুত জারণ প্রক্রিয়া।
-
ব্লিচিং (Bleaching): ব্লিচিং এজেন্টগুলো রঙিন পদার্থকে জারিত করে বর্ণহীন করে তোলে।
জারণ-বিজারণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার ব্যবহার ব্যাপক। এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার নিচে উল্লেখ করা হলো:
- শিল্পক্ষেত্রে: বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। যেমন – সার, অ্যাসিড, ক্ষার ইত্যাদি।
- পরিবেশ সুরক্ষায়: দূষিত পদার্থকে জারিত বা বিজারিত করে পরিবেশ বান্ধব পদার্থে রূপান্তরিত করা হয়।
- খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে: খাদ্য সংরক্ষণে এবং খাদ্যগুণ বৃদ্ধিতে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া ব্যবহার করা হয়।
- চিকিৎসা ক্ষেত্রে: রোগ নিরাময়ে এবং রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে এই বিক্রিয়া কাজে লাগে।
- গবেষণায়: নতুন রাসায়নিক যৌগ আবিষ্কার এবং তাদের বৈশিষ্ট্য জানতে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ।