শুরুতেই একটা গল্প বলি, কেমন? ধরুন, আপনি আর আপনার বন্ধু মিলে ঠিক করলেন, আজ সন্ধ্যায় নদীর ধারে সূর্যাস্ত দেখবেন। কিন্তু বন্ধুটি শেষ মুহূর্তে জানালো, তার শরীর খারাপ, আসতে পারবে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল, তাই না? জীবনের কিছু বিষয়ও অনেকটা এরকম – কিছু সম্পর্ক, কিছু অনুভূতি তখনই সুন্দর, যখন তা সঠিক পথে চলে। “যেনা” এমনই একটা বিষয়। চলুন, আজ আমরা “যেনা কাকে বলে” সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।
যেনা শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয়, তাই না? আসলে, এটা এমন একটা বিষয়, যেটা আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি আর ধর্মের সঙ্গে খুব গভীরভাবে জড়িত। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যেনা মানে হলো অবৈধ যৌন সম্পর্ক। ইসলামে এটা একটা বড় পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু শুধু পাপ বললে বিষয়টাকে ছোট করে দেখা হয়। যেনার কারণে একটা পরিবার, একটা সমাজ ভেঙে যেতে পারে। তাই এর সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখাটা খুব জরুরি।
যেনা কী? একটি বিস্তৃত আলোচনা (What is Zina?)
যেনা শব্দটা আরবি থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো অবৈধ যৌন সম্পর্ক। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে, বিবাহিত বা অবিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা, যা বৈধ নয়, তাই যেনা। শুধু শারীরিক সম্পর্ক নয়, এক্ষেত্রে চোখের যেনা, হাতের যেনা, মুখের যেনা—এগুলোও শামিল।
যেনার প্রকারভেদ (Types of Zina)
ইসলামে যেনাকে শুধু শারীরিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। বরং, মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন প্রকার অবৈধ কাজকেও যেনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
-
শারীরিক যেনা: এটা হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা। ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী, এটা সবচেয়ে গুরুতর যেনা হিসেবে বিবেচিত।
-
চোখের যেনা: কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে নারীর দিকে তাকানো অথবা অশ্লীল ভিডিও দেখা চোখের যেনার অন্তর্ভুক্ত।
-
মুখের যেনা: খারাপ কথা বলা, অশ্লীল গল্প করা, পরনিন্দা করা অথবা কাউকে খারাপ কিছু বলা মুখের যেনা।
-
হাতের যেনা: অবৈধ উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে স্পর্শ করা অথবা খারাপ কিছু লেখা হাতের যেনা।
-
মনের যেনা: খারাপ চিন্তা করা অথবা কু-বাসনা পোষণ করা মনের যেনা।
ইসলামে এগুলোর প্রত্যেকটিকেই গুনাহ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।
কোরআন ও হাদিসের আলোকে যেনা (Zina in the Light of Quran and Hadith)
কোরআন ও হাদিসে যেনার ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যেনা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন।
কোরআনে বলা হয়েছে, “আর তোমরা যেনার কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পথ।” (সূরা আল-ইসরা: ৩২)
হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যখন কোনো ব্যক্তি যেনা করে, তখন তার থেকে ঈমান উঠে যায়।” (বুখারি ও মুসলিম)
এই আয়াত ও হাদিসগুলো থেকে বোঝা যায়, ইসলামে যেনাকে কতটা ভয়ংকর অপরাধ হিসেবে দেখা হয়।
কেন যেনা এত খারাপ? (Why is Zina so Bad?)
ইসলামে যেনাকে এত খারাপ বলার কিছু কারণ আছে। এটা শুধু একটা পাপ নয়, এর অনেক সামাজিক ও ব্যক্তিগত কুফল রয়েছে। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো:
-
পারিবারিক কাঠামো ভেঙে যায়: যেনার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়, যার ফলে সংসার ভেঙে যেতে পারে।
-
সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়: যেনার কারণে সমাজে অবৈধ সন্তান জন্ম নেওয়ার হার বাড়ে, যা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে।
-
রোগ ছড়ায়: অবৈধ সম্পর্কের কারণে এইডস, সিফিলিসের মতো মারাত্মক রোগ ছড়াতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।
-
মানসিক অশান্তি: যেনার কারণে মানুষ অনুশোচনা ও অপরাধবোধে ভোগে, যা মানসিক শান্তির অন্তরায়।
-
আল্লাহর অসন্তুষ্টি: এটা আল্লাহর হুকুমের সরাসরি লঙ্ঘন, ফলে আল্লাহর অসন্তুষ্টি নেমে আসে।
যেনা থেকে বাঁচার উপায় (How to Avoid Zina)
যেনার ভয়াবহতা জানার পর, এটা থেকে বাঁচার উপায়গুলো জানা আমাদের জন্য জরুরি। কিছু সহজ উপায় অবলম্বন করে আমরা নিজেদেরকে এই পাপ থেকে রক্ষা করতে পারি:
চোখের হেফাজত (Guarding the Eyes)
খারাপ দৃষ্টি থেকে চোখকে বাঁচানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাস্তাঘাটে বা অনলাইনে যেখানেই খারাপ কিছু চোখে পড়ুক, সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে হবে। বলা হয়ে থাকে, “দৃষ্টি হচ্ছে শয়তানের তীর।” তাই প্রথম তীরটাকেই রুখে দিতে হবে।
অশ্লীল কথাবার্তা পরিহার (Avoiding Obscene Talk)
মুখে লাগাম দেওয়া খুব জরুরি। অশ্লীল কথাবার্তা, গান-বাজনা, গীবত—এগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। সবসময় ভালো কথা বলতে এবং শুনতে চেষ্টা করতে হবে।
খারাপ বন্ধু পরিহার (Avoiding Bad Company)
খারাপ বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত। কারণ, খারাপ সঙ্গ ধীরে ধীরে মানুষকে খারাপ কাজের দিকে ধাবিত করে। সবসময় ভালো এবং ধার্মিক বন্ধুদের সঙ্গে মিশে থাকা উচিত।
ইন্টারনেট ও মিডিয়ার সঠিক ব্যবহার (Proper Use of the Internet and Media)
ইন্টারনেট ও মিডিয়া এখন আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এর খারাপ দিকগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অশ্লীল ওয়েবসাইট ও ভিডিও দেখা থেকে নিজেকে সংযত রাখতে হবে। ভালো ইসলামিক ওয়েবসাইট ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে।
বিবাহের গুরুত্ব (Importance of Marriage)
ইসলামে বিবাহকে উৎসাহিত করা হয়েছে। শারীরিক চাহিদা পূরণের বৈধ উপায় হলো বিবাহ। তাই দেরি না করে উপযুক্ত সময়ে বিবাহ করা উচিত।
নিয়মিত দোয়া ও ইবাদত (Regular Prayer and Worship)
আল্লাহর কাছে নিয়মিত দোয়া করা উচিত, যেন তিনি আমাদের সবাইকে খারাপ কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। নিয়মিত নামাজ পড়া এবং অন্যান্য ইবাদত করা আমাদের মনকে পরিশুদ্ধ রাখে।
নফল রোজা রাখা (Fasting regularly)
নফল রোজা রাখা শরীর ও মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। যখন কু-চিন্তা মাথায় আসে, তখন রোজা রাখা সেই চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
এগুলো কিছু উপায়, যা অবলম্বন করে আমরা নিজেদেরকে যেনার মতো গর্হিত কাজ থেকে বাঁচাতে পারি।
যেনা বিষয়ক কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs on Zina)
এখানে যেনা সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাদের মনে প্রায়শই উদয় হয়:
যেনা কি শুধু শারীরিক সম্পর্ক? (Is Zina Only Physical Relationship?)
না, যেনা শুধু শারীরিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। চোখের যেনা, মুখের যেনা, হাতের যেনা এবং মনের যেনাও যেনার অন্তর্ভুক্ত।
যেনার শাস্তি কি? (What is the Punishment for Zina?)
ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী, বিবাহিত ব্যক্তির যেনার শাস্তি হলো পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড (যদি সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়)। অবিবাহিত ব্যক্তির শাস্তি হলো ১০০টি বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন। তবে, বর্তমানে এই শাস্তি কার্যকরের জন্য ইসলামী রাষ্ট্র এবং যথাযথ বিচার ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
তওবা করলে কি যেনার পাপ মাফ হয়? (Is Repentance Accepted for Zina?)
হ্যাঁ, তওবা করলে আল্লাহ যেনার পাপ মাফ করতে পারেন। তবে, তওবা হতে হবে আন্তরিক এবং অনুতপ্ত হৃদয়ে। ভবিষ্যতে আর কখনো এই কাজ না করার প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
যেনা থেকে বাঁচার জন্য ইসলামিক স্কলারদের পরামর্শ কী? (What is the Advice of Islamic Scholars to Avoid Zina?)
ইসলামিক স্কলারগণ সবসময় যেনা থেকে বাঁচার জন্য তাকওয়া অবলম্বন করতে, চোখের হেফাজত করতে, অশ্লীলতা পরিহার করতে এবং বিবাহের প্রতি গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দেন।
যেনা ও ধর্ষণের মধ্যে পার্থক্য কী? (What is the Difference Between Zina and Rape?)
যেনাতে নারী ও পুরুষ উভয়ের সম্মতি থাকে। অন্যদিকে, ধর্ষণে নারীর কোনো সম্মতি থাকে না, বরং জোরপূর্বক করা হয়। ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ এবং এর শাস্তিও অনেক কঠোর। যেনা বলতে যখন দুজনের সম্মতি থাকে, তখন সেটা যেনা হিসেবে গণ্য হবে, যেখানে একজনের সম্মতি থাকে না, সেটা ধর্ষণ।
যেনা থেকে দূরে থাকার সুফল (Benefits of Staying Away from Zina)
যেনা থেকে দূরে থাকার অনেক উপকারিতা রয়েছে, যা আমাদের জীবনকে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ করতে পারে। নিচে কয়েকটি প্রধান সুফল আলোচনা করা হলো:
-
পারিবারিক শান্তি: যেনা থেকে দূরে থাকলে পরিবারে শান্তি বজায় থাকে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা ও বিশ্বাস অটুট থাকে।
-
সামাজিক সম্মান: সমাজে একজন ব্যক্তি সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে।
-
মানসিক প্রশান্তি: অনুশোচনা ও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, যা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
-
শারীরিক সুস্থতা: যৌনরোগের ঝুঁকি কমে যায়, যা শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করে।
-
আল্লাহর সন্তুষ্টি: আল্লাহর হুকুম পালন করার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
উপকারিতা | বিবরণ |
---|---|
পারিবারিক শান্তি | স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা ও বিশ্বাস বজায় থাকে। |
সামাজিক সম্মান | সমাজে সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। |
মানসিক প্রশান্তি | অনুশোচনা ও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। |
শারীরিক সুস্থতা | যৌনরোগের ঝুঁকি কমে যায়। |
আল্লাহর সন্তুষ্টি | আল্লাহর হুকুম পালন করার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। |
এই সুফলগুলো প্রমাণ করে যে যেনা থেকে দূরে থাকা আমাদের জন্য কতটা জরুরি। এতে আমাদের ইহকালীন ও পরকালীন উভয় জীবনেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
শেষকথা
যেনা একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। এটা শুধু একটি পাপ নয়, এর কারণে অনেক পরিবার ও সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়। তাই আমাদের সবার উচিত যেনা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং অন্যকে উৎসাহিত করা। ইসলামে যেনা থেকে বাঁচার অনেক উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো অনুসরণ করে আমরা একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারি।
যদি এই লেখার মাধ্যমে আপনি এতটুকুও উপকৃত হন, তবে নিজেকে ধন্য মনে করব। আসুন, আমরা সবাই মিলে যেনামুক্ত একটি সমাজ গড়ি। আপনার কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।