আচ্ছালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? ধরুন, একদিন আপনি রেগে গিয়ে স্ত্রীকে এমন কিছু কথা বললেন, যা আপনার বলা উচিত হয়নি। হয়তো রাগের মাথায় মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল এমন কোনো কথা, যা সম্পর্কটাকে জটিল করে তুললো। এই জটিলতাটাকেই ইসলামে ‘যিহার’ বলা হয়। কিন্তু যিহার আসলে কী? এর পরিণামই বা কী? চলুন, আজ আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।
যিহার নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, রাগের মাথায় স্ত্রীকে খারাপ কথা বললেই বুঝি যিহার হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এটা তেমন গুরুতর কোনো বিষয় নয়। কিন্তু ইসলামি শরিয়তে এর গুরুত্ব অনেক। তাই, এই বিষয় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা আমাদের সবার জন্য জরুরি।
যিহার কী? একটি বিস্তারিত আলোচনা
যিহার আরবি শব্দ। এর আক্ষরিক অর্থ হলো “পিঠ”। ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায়, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে এমন কোনো কথা বলা, যা দ্বারা স্ত্রীকে নিজের মায়ের অথবা অন্য কোনো মাহরাম (যাদের সাথে বিবাহ হারাম) আত্মীয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এই ধরনের তুলনা সাধারণত স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখা হারাম করার উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে।
যিহারের সংজ্ঞা
সহজ ভাষায় যদি বলি, স্বামী যখন রাগের বশে স্ত্রীকে বলে, “তুমি আমার কাছে আমার মায়ের মতো” অথবা “তোমার পিঠ আমার মায়ের পিঠের মতো”, তখন সেটি যিহার হিসেবে গণ্য হবে। এখানে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, মায়ের সাথে তুলনাটা যেন সম্মান বা স্নেহের অর্থে না হয়, বরং স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে হয়।
যিহার কখন হয়?
যিহার হওয়ার জন্য কিছু শর্ত আছে। শর্তগুলো পূরণ না হলে, শুধু রাগের মাথায় কথা বললেই যিহার হবে না। নিচে শর্তগুলো উল্লেখ করা হলো:
- স্বামী কর্তৃক উচ্চারণ: যিহার অবশ্যই স্বামীকে উচ্চারণ করতে হবে। স্ত্রীর পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হলে তা যিহার হিসেবে গণ্য হবে না।
- সজ্ঞানে উচ্চারণ: স্বামী যখন সুস্থ মস্তিষ্কে, অর্থাৎ স্বাভাবিক জ্ঞান থাকা অবস্থায় এই কথাগুলো বলবে, তখনই তা যিহার হিসেবে ধরা হবে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অথবা ঘুমের ঘোরে বলা কথা যিহার হিসেবে গণ্য হবে না।
- স্পষ্ট উচ্চারণ: কথাগুলো স্পষ্ট হতে হবে। কোনো রকম অস্পষ্টতা থাকলে, সেটি যিহার হিসেবে গণ্য হবে না।
- তুলনা করা: স্ত্রীকে মায়ের বা অন্য কোনো মাহরাম আত্মীয়ের সাথে তুলনা করতে হবে। শুধু খারাপ কথা বললেই যিহার হবে না।
উদাহরণস্বরূপ:
- যদি কোনো স্বামী রাগের মাথায় স্ত্রীকে বলে, “তুমি আমার কাছে মায়ের মতো,” তাহলে এটি যিহার হবে যদি এই কথার উদ্দেশ্য স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়।
- কিন্তু যদি স্বামী স্ত্রীকে বলে, “তুমি আমার মায়ের মতো স্নেহময়ী,” তাহলে এটি যিহার হিসেবে গণ্য হবে না।
যিহারের প্রকারভেদ
যিহার প্রধানত দুই প্রকার:
- মুআল্লাক (Conditional): যখন কোনো শর্তের ওপর যিহার নির্ভরশীল হয়, তখন তাকে মুআল্লাক যিহার বলা হয়।
- উদাহরণ: স্বামী যদি বলে, “যদি আমি আগামী মাসে তোমার সাথে কথা বলি, তবে তুমি আমার কাছে আমার মায়ের মতো।”
- মুঞ্জাজ (Unconditional): যখন কোনো শর্ত ছাড়া সরাসরি স্ত্রীকে মায়ের সাথে তুলনা করা হয়, তখন তাকে মুঞ্জাজ যিহার বলা হয়।
- উদাহরণ: স্বামী যদি বলে, “তুমি আমার কাছে আমার মায়ের মতো।”
যিহারের বিধান ও কাফফারা
ইসলামি শরিয়তে যিহার একটি গর্হিত কাজ এবং এর জন্য কাফফারার বিধান রয়েছে। কাফফারা হলো প্রায়শ্চিত্ত, যা যিহারের পাপ থেকে মুক্তি পেতে আদায় করতে হয়।
কাফফারার নিয়ম
যিহারের কাফফারা দেওয়ার তিনটি উপায় আছে। যেকোনো একটি পালন করলেই কাফফারা আদায় হয়ে যাবে। নিচে উপায়গুলো উল্লেখ করা হলো:
- ক্রীতদাস মুক্তি: একজন ক্রীতদাসকে মুক্ত করা। তবে বর্তমানে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় এই উপায়টি প্রযোজ্য নয়।
- ধারাবাহিকভাবে রোজা রাখা: একটানা দুই মাস রোজা রাখা। কোনো কারণে রোজা ভঙ্গ হলে, আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
- গরিবদের খাবার দেওয়া: ষাটজন গরিবকে দুই বেলা পেট ভরে খাবার দেওয়া অথবা প্রত্যেককে পৌনে দুই কেজি গম বা সমপরিমাণ মূল্য প্রদান করা।
যদি কেউ উপরোক্ত তিনটি উপায়ের কোনোটিই পালন করতে অক্ষম হয়, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তাওবা করতে হবে।
কাফফারা দেওয়ার গুরুত্ব
যিহার করার পর কাফফারা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কাফফারা না দেওয়া পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করা বৈধ নয়। যদি কাফফারা দেওয়ার আগে স্বামী স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে তা হারাম হিসেবে গণ্য হবে এবং এর জন্য তওবা করতে হবে।
যিহার ও তালাকের মধ্যে পার্থক্য
অনেকেই যিহারকে তালাকের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু এই দুটো বিষয় ভিন্ন। নিচে যিহার ও তালাকের মধ্যেকার কিছু মৌলিক পার্থক্য তুলে ধরা হলো:
বৈশিষ্ট্য | যিহার | তালাক |
---|---|---|
সংজ্ঞা | স্ত্রীকে মায়ের বা অন্য কোনো মাহরাম আত্মীয়ের সাথে তুলনা করা। | স্ত্রীকে বিবাহবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেওয়া। |
উদ্দেশ্য | সাধারণত সম্পর্ক ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে করা হয়, তবে সরাসরি বিবাহ বিচ্ছেদ নয়। | সরাসরি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো। |
কাফফারা | কাফফারা আদায় করে পুনরায় সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যায়। | তালাক হয়ে গেলে পুনরায় বিবাহের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। |
ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ | কাফফারা দেওয়ার পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। | তালাকের ক্ষেত্রে (তালাকে رجعى) ইদ্দতকালে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। |
যিহার সম্পর্কিত সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
যিহার নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন থাকে। নিচে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
রাগের মাথায় স্ত্রীকে খারাপ কথা বললে কি যিহার হবে?
না, শুধু রাগের মাথায় খারাপ কথা বললে যিহার হবে না। যিহার হওয়ার জন্য স্ত্রীকে মায়ের বা অন্য কোনো মাহরাম আত্মীয়ের সাথে তুলনা করতে হবে এবং এই তুলনার উদ্দেশ্য হতে হবে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা।
যিহার করলে কি বিবাহ ভেঙে যায়?
যিহার করলে সরাসরি বিবাহ ভেঙে যায় না, তবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হারাম হয়ে যায়। কাফফারা দেওয়ার মাধ্যমে পুনরায় সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যায়।
কাফফারা দেওয়ার নিয়ম কি সবার জন্য একই?
কাফফারা দেওয়ার তিনটি উপায় আছে। যেকোনো একটি পালন করলেই কাফফারা আদায় হয়ে যাবে। তবে যদি কেউ কোনোটিই পালন করতে অক্ষম হয়, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তাওবা করতে হবে।
যিহার থেকে বাঁচার উপায় কি?
যিহার থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখা। কোনো বিষয়ে মন খারাপ হলে বা রাগ হলে, তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কথা না বলে একটু সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা উচিত। এছাড়া, ইসলামি অনুশাসন মেনে চললে এবং দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখলে এই ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।
“রাগ মানুষের বিবেককে আচ্ছন্ন করে ফেলে” – তাই রাগের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।
যিহারের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অধিকার কী?
যিহারের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অধিকার হলো, স্বামী যেন দ্রুত কাফফারা আদায় করে এবং পুনরায় সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। যদি স্বামী কাফফারা দিতে বিলম্ব করে অথবা অস্বীকার করে, তবে স্ত্রী কাজীর (ইসলামি আদালতের বিচারক) কাছে যেতে পারেন এবং বিচার চাইতে পারেন।
যিহার: একটি সামাজিক প্রেক্ষাপট
আমাদের সমাজে এখনো অনেক পরিবারে দাম্পত্য কলহ দেখা যায়। অনেক সময় রাগের বশে স্বামীরা এমন কিছু কথা বলে ফেলেন, যা সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। যিহারের মতো বিষয়গুলো দাম্পত্য জীবনে আরও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই, এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
ইসলাম দাম্পত্য জীবনকে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর взаимно احترام, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে একটি সুখী পরিবার গঠন করা সম্ভব। যিহারের মতো বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে হলে, ইসলামি অনুশাসন মেনে চলার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়াতে হবে।
মনে রাখবেন, “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে” – তবে পুরুষের দায়িত্বও কম নয়।
উপসংহার
যিহার একটি জটিল বিষয়, যা দাম্পত্য জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই, এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রাখা এবং তা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা আমাদের সকলের কর্তব্য। রাগের বশে কোনো ভুল কথা বলে ফেললে দ্রুত অনুতপ্ত হয়ে কাফফারা আদায় করা উচিত। দাম্পত্য জীবনে শান্তি ও সুখ বজায় রাখতে হলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই।
আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে আপনারা যিহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকলে, অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আপনার দাম্পত্য জীবন সুখ ও শান্তিতে ভরে উঠুক, এই কামনাই করি।
যদি এই ব্লগ পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আর ইসলামিক বিষয় সম্পর্কে আরও জানতে আমাদের সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ!