প্রাচীনকালে দূরত্ব মাপার একক “যোজন” – আসুন, এর রহস্যভেদ করি!
আচ্ছা, আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আমাদের দাদু-ঠাকুমারা কিলোমিটার বা মাইলের বদলে কীভাবে দূরের পথ মাপতেন? তাদের মুখে প্রায়ই শোনা যেত “যোজন” শব্দটা। কিন্তু এই যোজন আসলে কী? কতোটা দূর বোঝাতো এটা দিয়ে? আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই যোজন নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব।
যোজন: দূরত্বের এক প্রাচীন পরিমাপ
যোজন হলো ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক। শুধু দৈর্ঘ্য নয়, গভীরতা বোঝাতেও এর ব্যবহার ছিল। মহাভারত, রামায়ণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পুরাণে এই শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে মজার বিষয় হলো, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন অঞ্চলে এই যোজনের পরিমাপ বিভিন্ন রকম হয়েছে!
“যোজন” শব্দের উৎপত্তি ও ইতিহাস
সংস্কৃত শব্দ “যোজন” থেকে এর উৎপত্তি। বৈদিক যুগে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয় বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে, বিশেষত হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে যোজনের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই পরিমাপ পদ্ধতিটি মূলত জ্যোতির্বিদ্যা, স্থাপত্য এবং ভূগোল শাস্ত্রে ব্যবহৃত হত।
বিভিন্ন যুগে যোজনের ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা
প্রাচীনকালে যোজনের নির্দিষ্ট কোনো মাপ ছিল না। অঞ্চল, সময় এবং ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে এর মান পরিবর্তিত হতো। কেউ বলতেন এক যোজন মানে ৪ মাইল, আবার কারো মতে এটা ৯ মাইলেরও বেশি!
বিভিন্ন মত অনুযায়ী যোজনের পরিমাপ:
মতবাদ | আনুমানিক পরিমাপ (কিলোমিটার) |
---|---|
প্রাচীন মত | প্রায় ১৩-১৬ কিলোমিটার |
অর্থশাস্ত্রের মতে | প্রায় ১৪.৬ কিলোমিটার |
সূর্য সিদ্ধান্তের মতে | প্রায় ১২.৮ কিলোমিটার |
যোজনের ব্যবহার: কোথায় কোথায় এর উল্লেখ আছে?
যোজনের ব্যবহার শুধু দূরত্ব মাপার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, যেমন রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পুরাণে শহর, নদী, পর্বত এবং অন্যান্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলির দূরত্ব বোঝাতেও যোজন ব্যবহৃত হত। শুধু তাই নয়, দেবতাদের আবাসস্থল বা স্বর্গলোকের দূরত্ব বোঝাতেও এর ব্যবহার দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, রামায়ণে লঙ্কা থেকে ভারতের দূরত্ব ৪০ যোজন বলা হয়েছে।
যোজনের হিসাব: কীভাবে বুঝবেন কত দূর?
প্রাচীনকালে যেহেতু আধুনিক পরিমাপের যন্ত্র ছিল না, তাই শরীরের বিভিন্ন অংশের মাপ দিয়ে দূরত্ব মাপা হতো। যেমন, আঙুল, হাত, পা ইত্যাদি। এই মাপগুলো ব্যবহার করেই যোজন হিসাব করা হতো।
প্রাচীনকালে যোজন গণনার পদ্ধতি
প্রাচীনকালে যোজন গণনার কয়েকটি পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো:
- অঙ্গুল (আঙুল): ৬টি যব (barley)শস্য পাশাপাশি রাখলে যে দৈর্ঘ্য হয়, তাকে ১ আঙ্গুল ধরা হত।
- বিতস্তি (হাত): ১২ আঙ্গুল = ১ বিতস্তি। অর্থাৎ, বৃদ্ধাঙ্গুলি থেকে কনিষ্ঠা পর্যন্ত প্রসারিত হাতের দৈর্ঘ্য।
- হস্ত (হাত): ২৪ আঙ্গুল = ১ হস্ত। কনুই থেকে মধ্যমার ডগা পর্যন্ত দৈর্ঘ্য।
- দণ্ড (লাঠি): ৪ হস্ত = ১ দণ্ড।
- ক্রোশ ( kos/ক্রোশ): ২০০০ দণ্ড = ১ ক্রোশ।
- যোজন: ৪ ক্রোশ = ১ যোজন।
আধুনিক হিসেবে এক যোজন কত কিলোমিটার?
আধুনিক হিসেবে এক যোজন কত কিলোমিটার, তা নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। সাধারণভাবে, ১ যোজন প্রায় ১২.৮ থেকে ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে ধরা হয়। তবে, বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে এর ভিন্ন ভিন্ন পরিমাপ উল্লেখ করা হয়েছে।
যোজন নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- প্রাচীনকালে বণিকরা পথ মাপার জন্য যোজন ব্যবহার করত।
- জ্যোতির্বিদ্যায় গ্রহ-নক্ষত্রের দূরত্ব বোঝাতেও যোজন ব্যবহার করা হতো।
- “ক্রোশ” নামক একটি এককও আগে প্রচলিত ছিল, যা যোজনের একটি অংশ।
যোজন কি শুধু একটি দূরত্ব পরিমাপক?
অনেকে মনে করেন যোজন শুধু দূরত্ব পরিমাপক। তবে এর বাইরেও এর গুরুত্ব রয়েছে। এটি প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জীবনযাত্রার একটি অংশ।
যোজন এবং আধুনিক পরিমাপ পদ্ধতি
বর্তমানে কিলোমিটার, মাইল ইত্যাদি আধুনিক পরিমাপ পদ্ধতি প্রচলিত থাকায় যোজনের ব্যবহার প্রায় extinct। তবে ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যারা চর্চা করেন, তাদের কাছে এর গুরুত্ব আজও অটুট।
কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর (FAQ)
যোজন নিয়ে আপনাদের মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. যোজন কাকে বলে?
যোজন হলো প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক। এটি মূলত দূরত্ব বোঝাতে ব্যবহৃত হতো, তবে এর নির্দিষ্ট মান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ছিল।
২. এক যোজন কত কিলোমিটার?
বিভিন্ন মতানুসারে, এক যোজন প্রায় ১২.৮ থেকে ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে ধরা হয়।
৩. যোজন শব্দটির উৎস কী?
যোজন শব্দটি সংস্কৃত “যোজন” থেকে এসেছে।
৪. রামায়ণে যোজনের ব্যবহার কেমন ছিল?
রামায়ণে লঙ্কা থেকে ভারতের দূরত্ব ৪০ যোজন বলা হয়েছে।
৫. বর্তমানে যোজনের ব্যবহার আছে কি?
বর্তমানে সরাসরি ব্যবহার না থাকলেও, ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যিক কারণে এর গুরুত্ব এখনও রয়েছে।
৬. যোজন কি শুধু দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক?
যোজন মূলত দূরত্ব বা দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক হলেও, প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জীবনযাত্রার সঙ্গে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি শুধু একটি পরিমাপক নয়, বরং প্রাচীন ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৭. যোজন এবং ক্রোশের মধ্যে সম্পর্ক কী?
যোজন এবং ক্রোশ উভয়ই প্রাচীন ভারতীয় দূরত্ব পরিমাপের একক। এদের মধ্যে সম্পর্ক হলো: ৪ ক্রোশ = ১ যোজন। অর্থাৎ, ক্রোশ হলো যোজনের একটি অংশ।
৮. সূর্য সিদ্ধান্তের মতে ১ যোজন কত কিলোমিটার?
সূর্য সিদ্ধান্তের মতে, ১ যোজন প্রায় ১২.৮ কিলোমিটার।
৯. অর্থশাস্ত্রের মতে ১ যোজন কত কিলোমিটার?
অর্থশাস্ত্রের মতে, ১ যোজন প্রায় ১৪.৬ কিলোমিটার।
উপসংহার: হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্য
যোজন হয়তো এখন আর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হয় না, কিন্তু আমাদের ইতিহাসে এর একটা বিশেষ স্থান রয়েছে। এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রাচীনকালে মানুষ কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রেখে জীবনযাপন করত।
আশা করি, আজকের ব্লগ পোস্টটি থেকে আপনারা যোজন সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন। এই ধরনের আরও интересные বিষয় নিয়ে জানতে আমাদের সাথেই থাকুন। যদি আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন!