আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন আপনারা? ধরুন, আপনি বাজারে গিয়েছেন পছন্দের জামা কিনতে। দোকানি দাম হাঁকালেন ২০০০ টাকা। আপনি জানেন জামাটার দাম ১৫০০ টাকার বেশি নয়। কিন্তু দোকানি কিছুতেই কম করবেন না। শেষমেশ বাধ্য হয়ে আপনি ২০০০ টাকা দিয়ে জামাটি কিনলেন। এই পরিস্থিতিতে আপনার কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই খারাপ লাগবে, মনে হবে যেন আপনার সাথে অন্যায় করা হয়েছে। অনেকটা জোর করে বেশি দাম নেওয়া হলো, তাই না? এই যে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হলো, এটাই কিন্তু এক ধরনের জুলুম।
আসুন, আজকে আমরা “জুলুম কাকে বলে” সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। শুধু সংজ্ঞা নয়, জুলুমের প্রকারভেদ, সমাজের উপর এর প্রভাব এবং এই থেকে বাঁচার উপায় নিয়েও কথা বলব। মনে রাখবেন, জুলুম একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি, যা আমাদের শান্তি ও সমৃদ্ধি কেড়ে নিতে পারে।
জুলুম কী? (What is Julum?)
সহজ ভাষায়, জুলুম মানে হলো অত্যাচার, অবিচার বা নিপীড়ন। যখন কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্বলদের উপর অন্যায় করে, তখনই জুলুম হয়। জুলুম শুধু শারীরিক নয়, মানসিক, আর্থিক এবং সামাজিকভাবেও হতে পারে।
ইসলামের দৃষ্টিতে, জুলুম একটি বড় পাপ। কোরআন ও হাদিসে জুলুমের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা জুলুমকারীকে পছন্দ করেন না এবং মাজলুমের (যার উপর জুলুম করা হয়েছে) দোয়া তিনি কবুল করেন।
জুলুমের কয়েকটি উদাহরণ (Examples of Julum)
- শারীরিক জুলুম: কাউকে মারধর করা, বন্দী করা অথবা শারীরিক নির্যাতন করা।
- মানসিক জুলুম: কাউকে গালি দেওয়া, অপমান করা, ভয় দেখানো অথবা মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া।
- আর্থিক জুলুম: কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে দখল করা, ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা অথবা অতিরিক্ত সুদ নেওয়া।
- সামাজিক জুলুম: কাউকে সমাজ থেকে দূরে রাখা, খারাপ নামে ডাকা অথবা সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
জুলুমের প্রকারভেদ (Types of Julum)
জুলুম বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
নিজের উপর জুলুম (Zulm on oneself)
সবচেয়ে বড় জুলুম হলো নিজের উপর জুলুম করা। কিভাবে? শিরক করার মাধ্যমে। শিরক মানে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করা। যখন কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কিছুর ইবাদত করে, তখন সে নিজেকেই সবচেয়ে বড় ক্ষতির দিকে ঠেলে দেয়। এটা নিজের আত্মার উপর জুলুম।
অন্যের উপর জুলুম (Zulm on others)
অন্যের উপর জুলুম করা মানে অন্যের অধিকার হরণ করা। এটা হতে পারে মানুষের জান-মালের ক্ষতি করা, তাদের সম্মানহানি করা অথবা তাদের সাথে অন্যায় আচরণ করা। প্রতিবেশীর সাথে খারাপ ব্যবহার করা, অধীনস্থ কর্মচারীদের উপর অত্যাচার করাও জুলুমের অন্তর্ভুক্ত।
প্রকৃতির উপর জুলুম (Zulm on nature)
প্রকৃতির উপর জুলুম বলতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করাকে বোঝায়। গাছপালা কাটা, নদী-নালা দূষিত করা, বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করা – এগুলো সবই প্রকৃতির উপর জুলুম। এর ফলস্বরূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় এবং পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
জুলুমের কারণ (Reasons for Julum)
জুলুমের পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে কয়েকটি প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক্ষমতার অপব্যবহার (Abuse of power)
ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে – এই কথাটা নিশ্চয়ই শুনেছেন? যখন কারো হাতে ক্ষমতা আসে, তখন অনেকেই সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে। দুর্বলদের উপর প্রভাব খাটিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায়।
লোভ ও স্বার্থপরতা (Greed and selfishness)
লোভ মানুষের বিবেককে অন্ধ করে দেয়। মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য যেকোনো কাজ করতে পারে, এমনকি অন্যের অধিকার কেড়ে নিতেও দ্বিধা করে না।
অজ্ঞতা ও অসচেতনতা (Ignorance and unawareness)
অনেক মানুষ জুলুমের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে না। তারা মনে করে, ছোটখাটো অন্যায় হয়তো তেমন কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ছোট অন্যায়গুলোই বড় জুলুমের রূপ নেয়।
জুলুমের কুফল (Negative consequences of Julum)
জুলুম একটি সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর কিছু কুফল নিচে উল্লেখ করা হলো:
- অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা: জুলুমের কারণে সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
- দারিদ্র্য ও বৈষম্য: জুলুমের কারণে সমাজে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়ে। ধনীরা আরও ধনী হয়, আর গরিবেরা আরও গরিব হতে থাকে।
- সামাজিক অবক্ষয়: জুলুমের কারণে সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ কমে যায়। মানুষ ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের পার্থক্য ভুলে যায়।
জুলুম থেকে বাঁচার উপায় (Ways to avoid Julum)
জুলুম থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। নিচে কিছু উপায় আলোচনা করা হলো:
ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা (Establishment of justice)
সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সবাই সমান অধিকার পায়।
শিক্ষার বিস্তার (Spread of education)
শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মানুষকে জুলুমের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানাতে হবে।
নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন (Development of moral values)
মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও সহানুভূতির শিক্ষা দিতে হবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি (Increase public awareness)
জুলুমের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ও উত্তর (Frequently Asked Questions)
জুলুম নিয়ে আপনাদের মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
জুলুম কাকে বলে ইসলামিক দৃষ্টিতে? (What is Julum in Islamic perspective?)
ইসলামের দৃষ্টিতে জুলুম মানে হলো কারো অধিকার হরণ করা অথবা অন্যায়ভাবে কারো উপর অত্যাচার করা। এটি একটি গুরুতর পাপ এবং আল্লাহ তায়ালা জুলুমকারীকে পছন্দ করেন না। কোরআন ও হাদিসে জুলুমের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
জুলুমের শাস্তি কী? (What is the punishment of Julum?)
জুলুমের শাস্তি অত্যন্ত কঠিন। আখিরাতে জুলুমকারীকে কঠিন আজাব ভোগ করতে হবে। এছাড়া, দুনিয়াতেও জুলুমের ফল ভালো হয় না। জুলুমকারী অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়।
আমি যদি জুলুমের শিকার হই, তাহলে আমার কী করা উচিত? (What should I do if I am a victim of Julum?)
যদি আপনি জুলুমের শিকার হন, তাহলে ধৈর্য ধারণ করুন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। পাশাপাশি, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে আইনি সহায়তা নিন।
জুলুম থেকে বাঁচতে হলে আমাদের কী করা উচিত? (What should we do to avoid Julum?)
জুলুম থেকে বাঁচতে হলে আমাদের নিজেদেরকে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।
জুলুম ও অত্যাচারের মধ্যে পার্থক্য কী? (What is the difference between Zulm and oppression?)
জুলুম শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। অত্যাচার জুলুমের একটি অংশ। অত্যাচার সাধারণত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে হয়ে থাকে, কিন্তু জুলুম আর্থিক, সামাজিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও হতে পারে।
মাজলুমের দোয়া কি কবুল হয়? (Is the prayer of Mazlum accepted?)
হ্যাঁ, মাজলুমের দোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন। হাদিসে আছে, মাজলুমের দোয়া সরাসরি আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায় এবং আল্লাহ তার দোয়া ফিরিয়ে দেন না।
জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা কি জায়েজ? (Is it permissible to protest against Zulm?)
অবশ্যই জায়েজ। জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ঈমানের দাবি। তবে প্রতিবাদ অবশ্যই শান্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক হতে হবে। কোনোভাবেই যেন সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
জুলুম নিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণা (Common misconceptions about Julum)
জুলুম নিয়ে সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। নিচে কয়েকটি ধারণা আলোচনা করা হলো:
শুধু শারীরিক নির্যাতনই জুলুম (Only physical torture is Zulm)
অনেকেই মনে করেন, শুধু মারধর বা শারীরিক নির্যাতন করলেই জুলুম হয়। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। মানসিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবেও জুলুম হতে পারে।
গরিবদের উপর জুলুম করাই জুলুম (Only Zulm on the poor is Zulm)
অনেকে ভাবেন, শুধু গরিবদের উপর অত্যাচার করাই জুলুম। কিন্তু ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবার উপর জুলুম করা সমান অপরাধ।
জুলুম করলে শুধু আখিরাতে শাস্তি হবে (Punishment for Zulm will only be in the afterlife)
অনেকে মনে করেন, জুলুম করলে শুধু আখিরাতে শাস্তি হবে, দুনিয়াতে কিছু হবে না। কিন্তু জুলুমের ফল দুনিয়াতেও ভোগ করতে হয়। জুলুমকারী সমাজে সম্মান হারায় এবং তার জীবনে অশান্তি নেমে আসে।
জুলুমের আধুনিক রূপ (Modern forms of Zulm)
বর্তমান যুগে জুলুমের রূপ পরিবর্তন হয়েছে। এখন সাইবার বুলিং, অনলাইন হ্যারাসমেন্ট, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া ইত্যাদিও জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। আসুন, এই আধুনিক জুলুমের বিরুদ্ধে আমরা সবাই সোচ্চার হই।
সাইবার বুলিং (Cyber bullying)
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে কাউকে হয়রানি করা, খারাপ মন্তব্য করা অথবা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো – এগুলো সাইবার বুলিংয়ের অন্তর্ভুক্ত।
অনলাইন হ্যারাসমেন্ট (Online harassment)
ইন্টারনেটে কাউকে হুমকি দেওয়া, ভয় দেখানো অথবা অশ্লীল ছবি বা ভিডিও পোস্ট করা অনলাইন হ্যারাসমেন্টের শামিল।
মিথ্যা অপবাদ (False accusation)
কারো নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া অথবা ভিত্তিহীন অভিযোগ করা একটি বড় ধরনের জুলুম।
আসুন, আমরা জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়াই (Let’s stand against Zulm)
জুলুম একটি সামাজিক ব্যাধি। এটি আমাদের সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। তাই, আসুন, আমরা সবাই মিলে জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়াই। নিজে জুলুম করা থেকে বাঁচি এবং অন্যকে জুলুম করতে দেখলে তার প্রতিবাদ করি। একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ার জন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
জুলুমের বিরুদ্ধে আপনার একটি ছোট পদক্ষেপও অনেক বড় পরিবর্তন আনতে পারে। আপনি যদি আপনার কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে বা সমাজে কোনো ধরনের জুলুম হতে দেখেন, তাহলে সাহস করে তার বিরুদ্ধে কথা বলুন। হয়তো আপনার একটি কথা বা একটি কাজই কারো জীবন বদলে দিতে পারে। মনে রাখবেন, নীরবতা জুলুমের চেয়েও খারাপ।
আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি জুলুমমুক্ত সমাজ গড়ি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।