শুরুতেই একটা প্রশ্ন করি, “বাংলার সৈয়দ আহমদ” নামটা শুনলেই আপনার মনে কার ছবি ভেসে ওঠে? নিশ্চয়ই ভাবছেন, সৈয়দ আহমদ তো একজনই হওয়ার কথা, আবার “বাংলার” কেন? তাহলে বুঝিয়ে বলা যাক…
আসলে, উনি শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা, সমাজসেবা, আর সংস্কারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি হলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর।
আজ আমরা নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুরকে নিয়েই কথা বলব, জানব কেন তাঁকে বাংলার সৈয়দ আহমদ বলা হয়।
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ: পরিচয় ও প্রেক্ষাপট
১৮৭১ সালের ৭ জুন (মতান্তরে ১৮৬৬) তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে বাংলাদেশ) ঢাকা জেলার আহসান মঞ্জিলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাজা আহসানুল্লাহ এবং মাতার নাম বিলকিস বানু। নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন ঢাকা নবাব পরিবারের চতুর্থ নবাব। নবাব হওয়ার পরে তিনি মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য অনেক কাজ করেছেন।
নবাব সলিমুল্লাহর বংশ পরিচয়
নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত। তাঁর পূর্বপুরুষেরা মুঘল আমলে ব্যবসার উদ্দেশ্যে কাশ্মীর থেকে বাংলায় আসেন এবং এখানেই স্থায়ী হন। ধীরে ধীরে তাঁরা জমিদারি লাভ করেন এবং ঢাকা নবাব পরিবার হিসেবে পরিচিত হন।
শিক্ষা ও পারিবারিক জীবন
নবাব সলিমুল্লাহ প্রথমে গৃহশিক্ষকের কাছে আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষা শেখেন। পরে তাঁকে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু পারিবারিক কারণে তিনি পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ১৮৮৪ সালে তিনি কুমিল্লার নবাব এস্টেটের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগ দেন। ১৮৮৬ সালে দিনাজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও কাজ করেন।
১৮৮০ সালে সলিমুল্লাহ বেগম খুরশিদ জাহাঁকে বিয়ে করেন। তাঁদের পাঁচ ছেলে ও সাত মেয়ে ছিল।
কাকে বাংলার সৈয়দ আহমদ বলা হয়? নবাব সলিমুল্লাহ কেন?
স্যার সৈয়দ আহমদ খান ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন ভারতীয় মুসলিম সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ। তিনি মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করেন এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। নবাব সলিমুল্লাহ অনেকটা একই ধরনের কাজ বাংলায় করেছিলেন। তাই নবাব সলিমুল্লাহ বাহাদুরকে বাংলার সৈয়দ আহমদ বলা হয়। নিচে কয়েকটি কারণ আলোচনা করা হলো:
শিক্ষার বিস্তার
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মতো, নবাব সলিমুল্লাহও মনে করতেন মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য আধুনিক শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই তিনি পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের জন্য শিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করেন।
- ইসলামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা: ১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বর্তমানে সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা নামে পরিচিত।
- মুসলিম শিক্ষা সমিতি: মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি ‘মুসলিম শিক্ষা সমিতি’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। এই সমিতি মুসলিমদের শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কাজ করত।
রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি
নবাব সলিমুল্লাহ বুঝতে পেরেছিলেন, রাজনৈতিক অধিকার ছাড়া মুসলিমদের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তিনি মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দেন এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
- মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা: ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগেই ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজনৈতিক দল মুসলিমদের অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- বঙ্গভঙ্গ সমর্থন: নবাব সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গের একজন strong supporter ছিলেন। তিনি মনে করতেন, এর মাধ্যমে পূর্ববাংলার মুসলিমরা উপকৃত হবে।
সামাজিক সংস্কার
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মতো নবাব সলিমুল্লাহও সমাজের কুসংস্কার দূর করতে চেষ্টা করেন এবং আধুনিক চিন্তাভাবনা প্রসারে উৎসাহিত করেন। তিনি নারীদের শিক্ষার প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বিধবা বিবাহের সমর্থন করেন।
- বাল্যবিবাহ রোধ: নবাব সলিমুল্লাহ বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং এর কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতেন।
- যৌতুক প্রথা বিরোধিতা: তিনি যৌতুক প্রথার বিরোধিতা করতেন এবং এই প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করতেন।
এই কারণগুলোর জন্য নবাব সলিমুল্লাহ বাহাদুরকে বাংলার সৈয়দ আহমদ বলা হয়।
নবাব সলিমুল্লাহর অবদান
নবাব সলিমুল্লাহ শুধু একজন সমাজ সংস্কারক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষানুরাগী। তাঁর অবদানগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নবাব সলিমুল্লাহর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি পূর্ববাংলার মানুষের শিক্ষার উন্নতির জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং এর জন্য জোরালো আন্দোলন করেন।
*তিনি না থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো আজও আলোর মুখ দেখতো না।
- ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষা: নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিমদের ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন। তিনি ওয়াকফ সম্পত্তি বোর্ডের মাধ্যমে এসব সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করেন, যাতে কেউ অবৈধভাবে দখল করতে না পারে।
- কৃষি উন্নয়ন: নবাব সলিমুল্লাহ কৃষকদের উন্নতির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনি কৃষকদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করেন এবং তাদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
আরও কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ
- ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করেন।
- ১৯০৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করে মুসলিমদের জন্য আলাদা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন।
- ১৯০৯ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন।
- ঢাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল তৈরি করেন।
নবাব সলিমুল্লাহর সমালোচনা
এত অবদানের পরেও নবাব সলিমুল্লাহ কিছু ক্ষেত্রে সমালোচিত হয়েছেন। নিচে কয়েকটি সমালোচনা উল্লেখ করা হলো:
- বঙ্গভঙ্গ সমর্থন: নবাব সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেছিলেন, যা অনেক বাঙালি হিন্দু ভালোভাবে নেয়নি। তাঁরা মনে করতেন, এর মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
- জমিদারি প্রথা: নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন জমিদার। জমিদার হিসেবে তিনি সাধারণ মানুষের ওপর অনেকক্ষেত্রে শোষণ চালিয়েছিলেন, যা সমালোচিত হয়েছে।
এই সমালোচনা সত্ত্বেও, নবাব সলিমুল্লাহর অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি ছিলেন বাংলার মুসলিম সমাজের একজন অগ্রণী নেতা।
কিছু বিতর্কিত প্রশ্ন (Controversial Questions)
নবাব সলিমুল্লাহকে নিয়ে কিছু বিতর্কিত প্রশ্ন প্রায়ই সামনে আসে। নিচে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:
-
নবাব সলিমুল্লাহ কি সত্যিই প্রজাবান্ধব ছিলেন?
ঐতিহাসিকভাবে জমিদারদের প্রজাবান্ধব হিসেবে প্রমাণ করা কঠিন। তবে নবাব সলিমুল্লাহ অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন, যা প্রমাণ করে তিনি প্রজাদের মঙ্গলের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
-
বঙ্গভঙ্গ কি মুসলিমদের জন্য উপকারী ছিল?
বঙ্গভঙ্গ নিয়ে এখনো অনেক বিতর্ক আছে। কেউ মনে করেন, এর মাধ্যমে পূর্ববাংলার মুসলিমরা উপকৃত হয়েছে, আবার কেউ মনে করেন এটা ছিল ব্রিটিশদের divide and rule পলিসি।
-
নবাব সলিমুল্লাহর রাজনৈতিক ভূমিকা কি সবসময় সঠিক ছিল?
নবাব সলিমুল্লাহর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভিন্ন মত থাকতেই পারে। তবে তিনি মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করেছেন, এটা অনস্বীকার্য।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্ন (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে নবাব সলিমুল্লাহ সম্পর্কে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
-
নবাব সলিমুল্লাহর জন্ম তারিখ কবে?
নবাব সলিমুল্লাহ ১৮৭১ সালের ৭ জুন (মতান্তরে ১৮৬৬) জন্মগ্রহণ করেন।
-
নবাব সলিমুল্লাহর পিতার নাম কি?
নবাব সলিমুল্লাহর পিতার নাম খাজা আহসানুল্লাহ।
-
নবাব সলিমুল্লাহ কেন বিখ্যাত?
নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য বিখ্যাত।
-
নবাব সলিমুল্লাহকে কেন বাংলার সৈয়দ আহমদ বলা হয়?
শিক্ষা, সমাজসেবা ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কারণে তাঁকে বাংলার সৈয়দ আহমদ বলা হয়।
-
নবাব সলিমুল্লাহর স্ত্রীর নাম কি?
নবাব সলিমুল্লাহর স্ত্রীর নাম বেগম খুরশিদ জাহাঁ।
-
নবাব সলিমুল্লাহ কত সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন?
নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন।
টেবিলে কিছু তথ্য (Some Information in Table)
তথ্য | বিবরণ |
---|---|
জন্ম | ১৮৭১ সালের ৭ জুন (মতান্তরে ১৮৬৬) |
জন্মস্থান | ঢাকা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ) |
পিতার নাম | খাজা আহসানুল্লাহ |
মাতার নাম | বিলকিস বানু |
স্ত্রীর নাম | বেগম খুরশিদ জাহাঁ |
উল্লেখযোগ্য অবদান | মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা বিস্তার |
রাজনৈতিক দল | মুসলিম লীগ |
মৃত্যু | ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি |
নবাব সলিমুল্লাহর জীবন থেকে শিক্ষা (Lessons from the Life of Nawab Salimullah)
নবাব সলিমুল্লাহর জীবন থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। তার মধ্যে কয়েকটি নিচে দেওয়া হলো:
- শিক্ষার গুরুত্ব: নবাব সলিমুল্লাহ মনে করতেন শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। তাই আমাদের উচিত শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
- ঐক্যের শক্তি: নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। ঐক্যবদ্ধ থাকলে যে কোনো কঠিন কাজও সহজে করা যায়।
- সাহসিকতা: নবাব সলিমুল্লাহ সবসময় নিজের বিশ্বাসে অটল ছিলেন এবং সাহসী সিদ্ধান্ত নিতেন। আমাদের জীবনেও সাহসী হওয়া উচিত।
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর ছিলেন বাংলার মুসলিম সমাজের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। শিক্ষা, সমাজ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আজও স্মরণীয়। “বাংলার সৈয়দ আহমদ” হিসেবে তিনি সবসময় আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।
আজ এই পর্যন্তই। নবাব সলিমুল্লাহ সম্পর্কে আপনার কোনো মতামত থাকলে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর যদি মনে হয় এই লেখাটি তথ্যপূর্ণ, তাহলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন।