আচ্ছালামু আলাইকুম! কেমন আছেন সবাই? আজ আমরা কথা বলব এমন একটা বিষয় নিয়ে, যেটা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে, কিন্তু হয়তো মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে দ্বিধা বোধ করেন। আজকের বিষয় হলো – খোজা পুরুষ কাকে বলে? একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে, তাই না? ভয় নেই, আমরা সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেবো। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
খোজা পুরুষ: আসল ব্যাপারটা কী?
“খোজা পুরুষ”। শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয়, তাই না? কিন্তু সত্যি বলতে, এটা কোনো গালি নয়, বরং একটা শারীরিক অবস্থা। চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের perspective থেকে এর একটা সংজ্ঞা আছে। চলুন, ব্যাপারটা একটু খুলে বলি।
খোজা পুরুষ বলতে কী বোঝায়?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, খোজা পুরুষ মানে হলো সেই ব্যক্তি, যার পুরুষাঙ্গ বা টেস্টিস (testicles) অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়েছে অথবা জন্মগতভাবে নেই, অথবা টেস্টিসের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে তাদের শরীরে পুরুষ হরমোন (যেমন টেস্টোস্টেরন) তৈরি হয় না অথবা খুব কম পরিমাণে তৈরি হয়।
খোজা হওয়ার পেছনের কারণগুলো কী কী হতে পারে?
খোজা হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো:
চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণ:
- ক্যানসার: টেস্টিসের ক্যানসার হলে অনেক সময় আক্রান্ত টেস্টিস অপসারণ করতে হয়।
- অন্যান্য রোগ: কিছু বিশেষ রোগের কারণে টেস্টিস ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা অপসারণ করার প্রয়োজন হতে পারে।
ঐতিহাসিক এবং সামাজিক কারণ:
- হারেমের প্রহরী: প্রাচীনকালে রাজাদের হারেমের (যেখানে রানীরা থাকতেন) নিরাপত্তার জন্য খোজা পুরুষদের প্রহরী হিসেবে রাখা হতো।
- দাসত্ব: দাস প্রথার সময় অনেক পুরুষকে খোজা করে দেওয়া হতো, যাতে তারা বংশবৃদ্ধি করতে না পারে।
জেন্ডার পরিচিতি:
- কিছু ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া ব্যক্তি তাদের শারীরিক পরিবর্তনের অংশ হিসেবে এই প্রক্রিয়া বেছে নেন।
শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন
পুরুষ হরমোন কমে গেলে একজন পুরুষের শরীরে অনেক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনগুলো শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিকেই হতে পারে।
শারীরিক পরিবর্তন
- পেশী দুর্বল হয়ে যাওয়া: টেস্টোস্টেরন পেশী গঠনে সাহায্য করে। এর অভাবে পেশী দুর্বল হয়ে যায়।
- হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া: হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- শারীরিক দুর্বলতা: শরীর খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
- যৌন ক্ষমতা হ্রাস: যৌন চাহিদা কমে যায় এবং ইরেকশন (erection) পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
- গলার স্বর পরিবর্তন: গলার স্বর কিছুটা মেয়েদের মতো হয়ে যেতে পারে।
- স্তন বড় হওয়া: পুরুষদের স্তন আকারে বড় হতে পারে (গাইনোকোমাস্টিয়া)।
মানসিক পরিবর্তন
- মেজাজ পরিবর্তন: Mood swings বা হঠাৎ করে মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়া।
- উদ্বেগ এবং হতাশা: Anxiety (উদ্বেগ) এবং depression (হতাশা) দেখা দিতে পারে।
- আত্মবিশ্বাসের অভাব: আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে।
খোজা পুরুষদের সমাজে অবস্থান
আমাদের সমাজে খোজা পুরুষদের অবস্থান খুব একটা সম্মানের নয়। তাদেরকে প্রায়ই অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে তাদেরও সম্মান ও dignity পাওয়ার অধিকার আছে। তাদের প্রতি আমাদের সংবেদনশীল হওয়া উচিত।
তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত?
- সম্মান করা: প্রত্যেক মানুষের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। তাদের শারীরিক অবস্থার জন্য খারাপ ব্যবহার করা উচিত না।
- সহানুভূতি দেখানো: তাদের কষ্টগুলো বোঝার চেষ্টা করা উচিত এবং সহানুভূতি দেখানো উচিত।
- বৈষম্য দূর করা: সমাজে তাদের যেন কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।
- সাহায্য করা: তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাহায্য করা উচিত।
কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা (মিথ) এবং বাস্তবতা
খোজা পুরুষদের নিয়ে সমাজে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এই ভুল ধারণাগুলো তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। নিচে কয়েকটি প্রচলিত মিথ এবং তার বাস্তবতা তুলে ধরা হলো:
মিথ | বাস্তবতা |
---|---|
তারা পুরুষ নয় | তারা শারীরিকভাবে পুরুষ না হলেও মানুষ। তাদের অনুভূতি, আবেগ এবং অধিকার আছে। |
তারা বিপজ্জনক | এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তারা সাধারণত শান্ত ও নিরীহ প্রকৃতির হয়। |
তাদের কোনো অনুভূতি নেই | তাদের শারীরিক কিছু অক্ষমতা থাকলেও স্বাভাবিক মানুষের মতো তাদেরও অনুভূতি আছে। |
তারা শুধু যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে পারে | তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সমাজে বিভিন্ন সম্মানজনক পেশায় কাজ করছেন। |
খোজা এবং হিজড়া কি একই? (Are Eunuchs and Hijras the Same?)
অনেকেই খোজা বলতে হিজড়াদের বোঝেন। এই ধারণাটা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নয়। হিজড়া হলো একটি সামাজিক পরিচিতি, যেখানে একজন ব্যক্তি নিজেকে নারী বা পুরুষ কোনো পরিচয়েই পরিচিত করতে চান না। অন্যদিকে, খোজা হলো একটি শারীরিক অবস্থা। তবে হ্যাঁ, অনেক হিজড়া তাদের gender-affirming journey-র অংশ হিসেবে surgical intervention এর মাধ্যমে খোজা হতে পারেন, কিন্তু সব খোজা ব্যক্তি হিজড়া নন।
হিজড়া কারা?
হিজড়া একটি লিঙ্গীয় পরিচয়। তারা জন্মগতভাবে পুরুষ বা নারী হতে পারেন, কিন্তু তারা নিজেদেরকে নারী বা পুরুষ হিসেবে দেখেন না। হিজড়াদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে।
তাদের মধ্যে পার্থক্য কী? (Differences between them)
নিচে একটি টেবিলের মাধ্যমে খোজা ও হিজড়াদের মধ্যেকার কিছু মূল পার্থক্য তুলে ধরা হলো:
বিষয় | খোজা | হিজড়া |
---|---|---|
সংজ্ঞা | এটি একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে টেস্টিস অপসারণ করা হয় বা কার্যকারিতা নষ্ট করে দেওয়া হয়। | এটি একটি লিঙ্গীয় পরিচয়, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে নারী বা পুরুষ কোনো পরিচয়েই পরিচিত করতে চান না। |
কারণ | চিকিৎসা সংক্রান্ত, ঐতিহাসিক বা জেন্ডার পরিচিতির কারণে হতে পারে। | সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে হয়ে থাকে। |
শারীরিক বৈশিষ্ট্য | টেসটোস্টেরনের অভাবজনিত শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায়। | শারীরিক গঠন জন্মগত লিঙ্গের উপর নির্ভর করে, তবে তারা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পরিবর্তন করতে পারেন। |
সামাজিক পরিচিতি | সমাজে প্রায়শই অবহেলিত এবং বৈষম্যের শিকার। | নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে এবং সমাজে একটি বিশেষ স্থান আছে। |
জীবনযাত্রা এবং চ্যালেঞ্জ (Lifestyle and Challenges)
খোজা পুরুষদের জীবন নানা ধরনের চ্যালেঞ্জে ভরা। শারীরিক দুর্বলতা থেকে শুরু করে সামাজিক stigma (কুসংস্কার), সবকিছু মিলিয়ে তাদের জীবন বেশ কঠিন।
শারীরিক দুর্বলতা
পুরুষ হরমোনের অভাবে তাদের শরীরে নানা ধরনের দুর্বলতা দেখা যায়। অল্প বয়সেই তারা বার্ধক্যের শিকার হতে পারেন।
সামাজিক কুসংস্কার
আমাদের সমাজে তাদেরকে খারাপ চোখে দেখা হয়। তাদের সাথে মিশতে বা কথা বলতে অনেকেই দ্বিধা বোধ করেন।
কর্মসংস্থানের অভাব
ভালো শিক্ষা ও সুযোগের অভাবে তারা অনেক সময় ভালো চাকরি পান না। ফলে তাদের জীবন ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কীভাবে সাহায্য করতে পারেন? (How Can You Help?)
তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে আপনিও সাহায্য করতে পারেন। কিভাবে? নিচে কয়েকটি উপায় দেওয়া হলো:
সচেতনতা তৈরি করুন
খোজা পুরুষদের সম্পর্কে সমাজে সঠিক ধারণা তৈরি করুন। তাদের অধিকার সম্পর্কে মানুষকে জানান।
তাদের পাশে থাকুন
তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না। তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখান এবং তাদের কথা শুনুন।
তাদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করুন
তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ তৈরি করুন, যাতে তারা সম্মানের সাথে জীবন যাপন করতে পারে।
চিকিৎসা এবং হরমোন থেরাপি (Treatment and Hormone Therapy)
যদিও খোজা হওয়ার প্রক্রিয়াটি необратимой (irreversible), কিছু চিকিৎসা এবং থেরাপির মাধ্যমে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কমানো যেতে পারে।
হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (Hormone Replacement Therapy)
টেস্টোস্টেরনের অভাব পূরণের জন্য হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক কিছু সমস্যা কমানো যেতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা (Mental Health Support)
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য কাউন্সেলিং এবং থেরাপি খুব জরুরি। এর মাধ্যমে তারা মানসিক চাপ মোকাবেলা করতে পারেন।
কিছু অনুপ্রেরণামূলক গল্প (Inspirational Stories)
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অনেক খোজা পুরুষ সমাজে সফল হয়েছেন। তাদের জীবন থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি।
সাফল্যের উদাহরণ
- রাজনীতি: Shabnam Mausi ভারতের প্রথম হিজড়া বিধায়ক ছিলেন।
- সমাজসেবা: অনেক খোজা পুরুষ আছেন যারা দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য কাজ করছেন।
- শিল্পকলা: অনেকে গান, নাচ ও অভিনয়ের মাধ্যমে সমাজে পরিচিতি লাভ করেছেন।
আইন ও অধিকার (Law and Rights)
সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। খোজা পুরুষরাও এর অন্তর্ভুক্ত।
আইনগত সুরক্ষা
সরকার তাদের অধিকার রক্ষার জন্য কিছু আইন তৈরি করেছে। যেমন, শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে।
আরও কী করা যেতে পারে?
তাদের অধিকার আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
খোজা পুরুষদের নিয়ে কিছু দরকারি প্রশ্নোত্তর (FAQs)
এই বিষয়ে আপনাদের মনে আরও কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। তাই নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
খোজা হওয়ার পর কি সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব?
উত্তর: না, খোজা হওয়ার পর সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ টেস্টিস না থাকলে স্পার্ম (শুক্রাণু) তৈরি হয় না।
খোজা পুরুষদের জীবনকাল কি স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে কম হয়?
উত্তর: যদি সঠিক চিকিৎসা ও যত্ন নেওয়া হয়, তাহলে তাদের জীবনকাল স্বাভাবিক মানুষের মতোই হতে পারে।
খোজা হওয়ার প্রক্রিয়া কি বেদনাদায়ক?
উত্তর: সার্জারির সময় অবেদন (anesthesia) ব্যবহার করা হয়, তাই সাধারণত ব্যথা লাগে না। তবে পরবর্তীতে কিছু discomfort (অস্বস্তি) হতে পারে।
বাংলাদেশে খোজা পুরুষদের সংখ্যা কত?
উত্তর: বাংলাদেশে হিজড়া ও খোজা মিলিয়ে সঠিক সংখ্যা বলা কঠিন, তবে সরকারি হিসেবে প্রায় ১০,০০০ এর বেশি হিজড়া আছেন।
খোজা পুরুষদের প্রতি আমাদের কেমন আচরণ করা উচিত?
উত্তর: তাদের প্রতি সম্মানজনক ও সহানুভূতিশীল আচরণ করা উচিত। কোনোভাবেই তাদের অবজ্ঞা করা উচিত নয়।
পুরুষত্বহীনতা আর খোজা কি একই জিনিস?
উত্তর: না, দুটো এক জিনিস নয়। পুরুষত্বহীনতা (impotence) মানে হলো যৌন অক্ষমতা, যেখানে ইরেকশন পেতে সমস্যা হয়। আর খোজা মানে হলো টেস্টিস অপসারণ করা অথবা এর কার্যকারিতা নষ্ট করে দেওয়া।
খোজা করার অপকারিতা কি?
উত্তর: খোজা করার ফলে শরীরে হরমোনের অভাব দেখা দেয়, যা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়া সামাজিক stigma-র কারণে তাদের জীবন কঠিন হয়ে পড়ে।
শেষ কথা
আশা করি, এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে “খোজা পুরুষ কাকে বলে” এই বিষয়ে আপনাদের মনে আর কোনো দ্বিধা নেই। মনে রাখবেন, মানুষ হিসেবে সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া আমাদের দায়িত্ব। তাদের জীবনকে সহজ করতে আমাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি সুন্দর ও মানবিক সমাজ গড়ি।
যদি আপনার মনে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ!