মাকরুহ: যা আপনার অপছন্দ, কিন্তু হারাম নয়!
আচ্ছা, ধরুন, আপনি বিরিয়ানি খেতে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু আজ আপনার সামনে কেউ তেহারি এনে হাজির! বিরিয়ানির জায়গায় তেহারি, ব্যাপারটা ঠিক যেন মনের মতো হলো না, তাই না? অনেকটা তেমনই, ইসলামে কিছু কাজ আছে যা দেখতে খারাপ, অপছন্দনীয়, কিন্তু সরাসরি হারাম বলা যায় না। এগুলোকেই সাধারণত মাকরুহ বলা হয়। চলুন, মাকরুহ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নেই!
মাকরুহ মানে কী?
মাকরুহ শব্দটির অর্থ হলো অপছন্দনীয়, нежелательный, нелюбимый। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, যে কাজগুলো দেখতে খারাপ, যা করা উচিত না, কিন্তু করলে গুনাহ হবে না – সেগুলোই মাকরুহ। অনেকটা এমন যে, কাজটা করলে আল্লাহর অপছন্দ হবে, কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দেবেন না।
মাকরুহ কেন হয়?
ইসলাম একটি সুন্দর জীবন ব্যবস্থা। এখানে প্রতিটি কাজের একটি নিয়ম আছে। কিছু কাজ সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যেগুলোকে হারাম বলা হয়। আবার কিছু কাজ আছে যেগুলো খারাপ, কিন্তু সরাসরি নিষিদ্ধ নয়। এই কাজগুলো করলে ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে খারাপ অভ্যাস তৈরি হতে পারে, তাই এগুলোকে মাকরুহ বলা হয়।
মাকরুহের প্রকারভেদ
মাকরুহ প্রধানত দুই প্রকার:
-
মাকরুহে তাহরিমি: ওয়াজিব বা জরুরি পর্যায়ের কোনো বিধান লঙ্ঘন করার কারণে যে মাকরুহ হয়, তাকে মাকরুহে তাহরিমি বলে। এটা হারামের কাছাকাছি। যেমন, নামাজের সময় বিনা কারণে পোশাকের সাথে খেলা করা মাকরুহে তাহরিমি।
-
মাকরুহে তানজিহি: এটি মাকরুহের একটি হালকা স্তর। মুস্তাহাব বা পছন্দের কোনো কাজ ছেড়ে দিলে অথবা অপছন্দনীয় কোনো কাজ করলে মাকরুহে তানজিহি হয়। এটা করা অনুচিত, তবে গুনাহ নয়। যেমন, দাঁড়িয়ে পানি পান করা মাকরুহে তানজিহি।
মাকরুহে তাহরিমি ও মাকরুহে তানজিহির মধ্যে পার্থক্য কী?
মাকরুহে তাহরিমি এবং মাকরুহে তানজিহির মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। নিচে একটি ছকের সাহায্যে এই পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হলো:
বৈশিষ্ট্য | মাকরুহে তাহরিমি | মাকরুহে তানজিহি |
---|---|---|
গুরুত্ব | হারামের কাছাকাছি | তুলনামূলকভাবে কম গুরুতর |
কারণ | ওয়াজিব লঙ্ঘন করলে | মুস্তাহাব ত্যাগ করলে |
শাস্তি | করলে গুনাহ হয় এবং তওবা করা জরুরি | করলে গুনাহ হয় না, তবে অনুচিত |
উদাহরণ | নামাজের মধ্যে বিনা কারণে পোশাক নাড়াচাড়া করা | দাঁড়িয়ে পানি পান করা |
ফলাফল | ঈমানের দুর্বলতা সৃষ্টি করে | রুচিতে অপছন্দনীয় |
পরিত্রাণ | খাঁটি তওবা ও ইস্তেগফার করা | আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া |
দৈনন্দিন জীবনে মাকরুহ: কিছু উদাহরণ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক কাজ আছে যেগুলো মাকরুহ। এই কাজগুলো এড়িয়ে চললে আমরা সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতে পারি। নিচে কয়েকটি সাধারণ উদাহরণ দেওয়া হলো:
-
নামাজে হাই তোলা: নামাজে মনোযোগের সাথে দাঁড়ানো উচিত। হাই তোলা একটি অলসতা বা বিরক্তির লক্ষণ, যা নামাজের একাগ্রতা কমিয়ে দেয়। তাই এটি মাকরুহ। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে হাই চলে আসলে ভিন্ন কথা।
-
দাঁড়িয়ে পানি পান করা: ইসলামে বসে পানি পান করা সুন্নত। দাঁড়িয়ে পানি পান করা মাকরুহ, কারণ এতে শরীরের ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
-
বাম হাতে খাওয়া: ডান হাতে খাওয়া সুন্নত এবং বাম হাতে খাওয়া মাকরুহ। কারণ, বাম হাত সাধারণত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজে ব্যবহৃত হয় না।
-
অপ্রয়োজনীয় কথা বলা: অনর্থক এবং বাজে কথা বলা মাকরুহ। এতে সময় নষ্ট হয় এবং অন্যের মনে কষ্ট লাগতে পারে।
-
মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা: মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করা জরুরি। মসজিদে দুনিয়াবি কথাবার্তা বললে মসজিদের সম্মান কমে যায়।
-
ঘুমের মধ্যে কথা বলা: ঘুমের মধ্যে কথা বলা একটি অনিচ্ছাকৃত বিষয়, তবে চেষ্টা করা উচিত ঘুমের আগে প্রয়োজনীয় দোয়া ও জিকির করে ঘুমানো।
-
পায়খানা-প্রস্রাবের সময় কথা বলা: এটা আদবের খেলাফ। প্রয়োজনে খুব বেশি কথা বলতে হলে কে আগে সালাম দিয়েছে, তার জবাব দেওয়া যায়।
-
রোজা অবস্থায় কোনো কিছু চিবানো বা স্বাদ নেয়া: রোজা রাখা অবস্থায় বিনা কারণে কোনো কিছু চিবানো বা স্বাদ নেয়া মাকরুহ। এতে রোজার প্রতি সম্মান কমে যায়।
নামাজের মধ্যে মাকরুহ কাজগুলো কী কী?
নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাই নামাজে মনোযোগ দেওয়া এবং এর নিয়মকানুনগুলো সঠিকভাবে পালন করা জরুরি। কিছু কাজ আছে যেগুলো নামাজের মধ্যে মাকরুহ হিসেবে বিবেচিত হয়। নিচে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:
-
কাপড় বা শরীর নিয়ে খেলা করা: নামাজের সময় কাপড় বা শরীর নিয়ে খেলা করা মনোযোগ নষ্ট করে।
-
আঙ্গুল ফোটানো: নামাজে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল ফোটানো একটি অপছন্দনীয় কাজ।
-
মাটি বা অন্য কিছু সরানো: নামাজের সময় মাটি বা অন্য কিছু সরানো খেলাতুল্য এবং মনোযোগ ভঙ্গ করে।
-
ইচ্ছা করে কাশি দেয়া: কোনো কারণ ছাড়া কাশি দেয়া নামাজের একাগ্রতা নষ্ট করে।
-
জামা ঠিক করার জন্য দুই হাত ব্যবহার করা: এক হাত দিয়ে জামা ঠিক করাই যথেষ্ট। দুই হাত ব্যবহার করা মাকরুহ।
-
নামাজে এদিক-ওদিক তাকানো: নামাজের সময় কেবল সিজদার স্থানে দৃষ্টি রাখা উচিত। অন্য দিকে তাকানো মাকরুহ।
- মহিলাদের পুরুষের মতো করে নামাজ আদায় করা: মহিলাদের উচিত পর্দা বজায় রেখে আলাদাভাবে নামাজ আদায় করা। পুরুষের মতো করে নামাজ আদায় করা মাকরুহ।
মাকরুহ থেকে বাঁচার উপায়
মাকরুহ কাজগুলো থেকে বাঁচতে হলে আমাদের কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে।
-
ইসলামের জ্ঞান অর্জন করা: ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে আমরা সহজেই ভালো-মন্দ বুঝতে পারব এবং মাকরুহ কাজগুলো এড়িয়ে চলতে পারব।
-
নিয়মিত কুরআন ও হাদিস পাঠ করা:কুরআন ও হাদিস পাঠের মাধ্যমে আমরা জানতে পারব কোন কাজগুলো আল্লাহ তাআলার অপছন্দনীয়।
-
ভালো সঙ্গ নির্বাচন করা: সৎ ও ধার্মিক বন্ধুদের সাথে থাকলে তারা আমাদের ভালো কাজ করতে উৎসাহিত করবে এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখবে।
-
দোয়া করা: আল্লাহর কাছে দোয়া করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যেন আমাদের মাকরুহ কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন, সেই প্রার্থনা সবসময় করা উচিত।
-
নিজেকে সংশোধন করা: নিয়মিত আত্মসমালোচনা করা উচিত। নিজের ভুলগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো শুধরানোর চেষ্টা করতে হবে।
ইসলামে মাকরুহের গুরুত্ব
ইসলামে মাকরুহের গুরুত্ব অপরিসীম। যদিও মাকরুহ কাজগুলো সরাসরি হারাম নয়, তবুও এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ, ছোট ছোট ভুলগুলো একসময় বড় ধরনের গুনাহের দিকে নিয়ে যেতে পারে। মাকরুহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে আমরা একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতে পারব এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হব।
মাকরুহ পরিহার করার উপকারিতা
- আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ: মাকরুহ কাজগুলো পরিহার করার মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ পায় এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।
- মনের শান্তি: মাকরুহ কাজ থেকে দূরে থাকলে মন শান্ত থাকে এবং দুশ্চিন্তা কমে যায়।
- গুনাহ থেকে সুরক্ষা: ছোটখাটো মাকরুহ কাজগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখলে বড় গুনাহ থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়।
- উত্তম চরিত্র গঠন: মাকরুহ কাজ পরিহার করার মাধ্যমে নিজের চরিত্রকে সুন্দর ও পরিশীলিত করা যায়।
- সাফল্যমণ্ডিত জীবন: যে ব্যক্তি মাকরুহ কাজগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলে, তার জীবন সুন্দর ও সফল হয়।
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
মাকরুহ কাজ করলে কি গুনাহ হবে?
মাকরুহ কাজ করলে সরাসরি গুনাহ হয় না, তবে এটি আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ। নিয়মিত মাকরুহ কাজ করলে তা গুনাহের দিকে ধাবিত করতে পারে।
নামাজে মাকরুহ কাজগুলো কী কী?
নামাজে মাকরুহ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে কাপড় বা শরীর নিয়ে খেলা করা, আঙ্গুল ফোটানো, মাটি বা অন্য কিছু সরানো, বিনা কারণে কাশি দেয়া ইত্যাদি।
দাঁড়িয়ে পানি পান করা কি মাকরুহ?
হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে পানি পান করা মাকরুহ। বসে পানি পান করা সুন্নত। এতে শরীরের ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
কোন কাজগুলো মাকরুহে তানজিহি?
যে কাজগুলো মুস্তাহাব বা পছন্দের নয়, সেগুলো মাকরুহে তানজিহি। যেমন, দাঁড়িয়ে পান করা, অপ্রয়োজনীয় কথা বলা ইত্যাদি।
মাকরুহ থেকে বাঁচার উপায় কী?
ইসলামের জ্ঞান অর্জন, কুরআন ও হাদিস পাঠ, ভালো সঙ্গ নির্বাচন, দোয়া করা এবং নিজেকে সংশোধন করার মাধ্যমে মাকরুহ থেকে বাঁচা যায়।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এখানে প্রতিটি কাজের গুরুত্ব আলোচনা করা হয়েছে। মাকরুহ বিষয়গুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিহার করা উচিত, যাতে আমরা একটি সুন্দর ও আল্লাহ-সন্তুষ্ট জীবনযাপন করতে পারি। আসুন, আমরা সবাই মাকরুহ থেকে দূরে থাকি এবং আল্লাহর পথে চলি।
জীবনে চলার পথে ছোটখাটো ভুলত্রুটি হতেই পারে। তবে সচেতন থাকলে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলে অবশ্যই আমরা ভালো পথে চলতে পারব। মাকরুহ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে একটি সুন্দর জীবন গড়ি, এটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।