মাত্রাবৃত্ত ছন্দ: কবিতার তালে তালে মন মাতানো এক সফর!
কবিতা! ভাবতেই যেন মনটা নেচে ওঠে, তাই না? আর কবিতার ছন্দ? সে তো এক শিল্প! নানা ছন্দের মধ্যে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ (Matrabritta Chanda) অন্যতম। এই ছন্দে কবিতা লিখলে, মনে হয় যেন ঢেউয়ের তালে তালে কথা বলছি। কিন্তু “মাত্রাবৃত্ত ছন্দ কাকে বলে (Matrabritta Chanda Kake Bole)” – এই প্রশ্নটা অনেকের মনেই ঘোরে। তাই আজ আমরা এই ছন্দ নিয়ে সহজভাবে আলোচনা করব, যাতে আপনিও অনায়াসে এই ছন্দে কবিতা লিখতে পারেন।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ কী?
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ বাংলা কবিতার একটি বিশেষ ছন্দ। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটি অক্ষরের (Syllable) মূল মাত্রা সংখ্যা সমান থাকে। এই ছন্দে সাধারণত ৪ মাত্রার পর্ব থাকে, তবে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। এই ছন্দের ধ্বনি মাধুর্য এটিকে অন্যান্য ছন্দ থেকে আলাদা করে তুলেছে। আপনি যদি কবিতা লেখার জগতে নতুন হয়ে থাকেন, তাহলে এই ছন্দ আপনার জন্য খুবই উপযোগী হতে পারে।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ইতিহাস
বাংলা সাহিত্যে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার বহু পুরনো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে আধুনিক অনেক কবিই এই ছন্দে কবিতা লিখেছেন। এই ছন্দের মাধুর্য এবং সহজবোধ্যতা একে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য
- পর্ব: মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর পর্বগুলো সাধারণত সমান মাত্রার হয়।
- মাত্রা: প্রতিটি অক্ষরের মাত্রা গণনা করে এই ছন্দের বৈশিষ্ট্য বোঝা যায়।
- ধ্বনি: এর ধ্বনি মাধুর্য অন্য ছন্দ থেকে আলাদা।
- নমনীয়তা: এই ছন্দে শব্দের ব্যবহারে বেশ নমনীয়তা দেখা যায়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের গঠন
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের গঠন বোঝাটা একটু জটিল মনে হতে পারে, তবে কয়েকটি বিষয় মনে রাখলে এটা সহজ হয়ে যাবে।
মাত্রা গণনা
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মুক্তাক্ষর (Open Syllable) এবং বদ্ধাক্ষরের (Closed Syllable) মাত্রা গণনা ভিন্ন হয়।
- মুক্তাক্ষর: মুক্তাক্ষর মানে হলো যে অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকে। যেমন: “মা”, “দি”, “কে”। মুক্তাক্ষরের মাত্রা ১।
- বদ্ধাক্ষর: বদ্ধাক্ষর মানে হলো যে অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকে। যেমন: “বৎ”, “হৃৎ”, “চিৎ”। বদ্ধাক্ষরের মাত্রা ১, তবে শব্দের শেষে বা বিশেষ ক্ষেত্রে এর মাত্রা ২ হতে পারে।
পর্ব বিভাজন
একটি ছত্রের মধ্যে কতগুলো পর্ব থাকবে, তা নির্ধারণ করা হয় শব্দের মাত্রা এবং ছন্দের গতির ওপর ভিত্তি করে। সাধারণত, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ৪ মাত্রার পর্ব দেখা যায়।
পর্ব চেনার উপায়
পর্ব চেনার জন্য প্রথমে পুরো চরণটিকে ভেঙে ছোট ছোট অংশে ভাগ করতে হবে। প্রতিটি অংশের মাত্রা গণনা করে দেখতে হবে। যদি ৪ মাত্রা করে পাওয়া যায়, তবে বোঝা যাবে এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।
উদাহরণ
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” – এই চরণটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা।
- আ | মার | সো | নার – (১+১ | ১+১ | ১+১ | ১+১ = ৪ মাত্রা)
- বাং | লা, | আ | মি – (২ | ১, | ১ | ১ = ৫ মাত্রা)
- তো | মায় | ভা | লো – (১+১ | ২ | ১ | ১ = ৫ মাত্রা)
- বা | সি। – (২ | ১ = ৩ মাত্রা)
এখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঙক্তিতে পর্ব পাঁচ মাত্রার হলেও, এটি স্বাভাবিক। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এরকম সামান্য ব্যতিক্রম প্রায়ই দেখা যায়।
কলাবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দের মধ্যে পার্থক্য
কলাবৃত্ত ছন্দ এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দ – এই দুটি বাংলা কবিতার গুরুত্বপূর্ণ ছন্দ। এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিচে একটিTable-এর সাহায্যে এই পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হলো:
বৈশিষ্ট্য | কলাবৃত্ত ছন্দ | মাত্রাবৃত্ত ছন্দ |
---|---|---|
অক্ষরের মাত্রা | মুক্তাক্ষর ১, বদ্ধাক্ষর ১ | মুক্তাক্ষর ১, বদ্ধাক্ষর ১ (শব্দের শেষে ২) |
পর্বের গঠন | সাধারণত ৬ বা ৮ মাত্রার পর্ব | সাধারণত ৪ মাত্রার পর্ব |
ধ্বনি মাধুর্য | দ্রুত এবং ঝর্ণার মতো | ধীর এবং ঢেউয়ের মতো |
শব্দের ব্যবহার | আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার বেশি | তৎসম শব্দের ব্যবহার বেশি |
উদাহরণ | “রূপালী নদী বাঁকে” | “আমার সোনার বাংলা” |
কিভাবে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখবেন?
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখা কঠিন নয়। কয়েকটি সহজ নিয়ম অনুসরণ করে আপনিও এই ছন্দে সুন্দর কবিতা লিখতে পারেন।
বিষয় নির্বাচন
প্রথমেই কবিতার বিষয় নির্বাচন করুন। আপনার পছন্দের যেকোনো বিষয় নিয়ে লিখতে পারেন—প্রকৃতি, প্রেম, বিরহ, দেশপ্রেম অথবা দৈনন্দিন জীবনের যেকোনো ঘটনা।
শব্দ নির্বাচন
বিষয় অনুযায়ী উপযুক্ত শব্দ নির্বাচন করুন। এক্ষেত্রে, তৎসম শব্দ ব্যবহার করলে ছন্দের মাধুর্য বৃদ্ধি পায়।
মাত্রা গণনা
প্রতিটি শব্দ এবং অক্ষরের মাত্রা হিসাব করে দেখুন। খেয়াল রাখবেন, মুক্তাক্ষরের মাত্রা ১ এবং বদ্ধাক্ষরের মাত্রা ১ (তবে শব্দের শেষে ২)।
পর্ব তৈরি
৪ মাত্রা করে পর্ব তৈরি করুন। প্রতিটি চরণে পর্ব সংখ্যা সমান রাখার চেষ্টা করুন।
ছন্দ মেলানো
কবিতার অন্ত্যমিল (Rhyme) তৈরি করুন। মিলযুক্ত শব্দ ব্যবহার করলে কবিতা শুনতে ভালো লাগে।
উদাহরণ
একটি ছোট উদাহরণ দেওয়া হলো:
“আজকে নতুন সকাল,
আলো ঝলমল দিন।
পাখিরা গান গায়,
মনটা যে রঙিন।”
এখানে প্রতিটি চরণে ৪ মাত্রা করে পর্ব আছে এবং অন্ত্যমিলও রয়েছে।
কিছু টিপস এবং ট্রিকস
- নিয়মিত অনুশীলন: নিয়মিত কবিতা লেখার মাধ্যমে আপনি এই ছন্দে দক্ষ হয়ে উঠবেন।
- অন্যের কবিতা পড়া: বেশি বেশি কবিতা পড়ুন। এতে বিভিন্ন ধরনের ছন্দ এবং শব্দ ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা জন্মাবে।
- অভিজ্ঞদের পরামর্শ: অভিজ্ঞ কবি বা সাহিত্যিকদের কাছ থেকে পরামর্শ নিন।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ নিয়ে কিছু সাধারণ ভুল
- মাত্রা গণনায় ভুল: অনেকেই মুক্তাক্ষর এবং বদ্ধাক্ষরের মাত্রা গণনায় ভুল করে থাকেন।
- পর্ব বিভাজনে সমস্যা: পর্ব ঠিকমতো ভাগ করতে না পারলে ছন্দের গতি নষ্ট হয়ে যায়।
- শব্দের ভুল ব্যবহার: ছন্দের সাথে সঙ্গতি রেখে শব্দ ব্যবহার করতে না পারলে কবিতা শ্রুতিমধুর হয় না।
FAQ: মাত্রাবৃত্ত ছন্দ নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা
এখানে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ দিন?
“আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি।”
এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের একটি পরিচিত উদাহরণ।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের মূল বৈশিষ্ট্য কী?
এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটি অক্ষরের মাত্রা সংখ্যা নির্দিষ্ট এবং পর্বগুলো সাধারণত ৪ মাত্রার হয়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ চেনার উপায় কি?
চরণে ব্যবহৃত শব্দগুলোর মাত্রা গণনা করে এবং পর্ব বিভাজন করে এই ছন্দ চেনা যায়।
বাংলা সাহিত্যে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের অবদান কী?
এই ছন্দ বাংলা কবিতাকে মাধুর্য এবং নমনীয়তা দিয়েছে। অনেক বিখ্যাত কবি এই ছন্দে কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
মাত্রা কাকে বলে(Matra kake bole)?
মাত্রা হচ্ছে কোন অক্ষরের উচ্চারণ কাল। কোন অক্ষর উচ্চারনে যতটুকু সময় লাগে, সেটাই তার মাত্রা।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ভবিষ্যৎ
বাংলা সাহিত্যে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আধুনিক কবি এবং সাহিত্যিকরা এই ছন্দে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। ফলে এই ছন্দ আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে এবং এর ব্যবহার বাড়ছে।
উপসংহার
আশা করি, “মাত্রাবৃত্ত ছন্দ কাকে বলে (Matrabritta Chanda Kake Bole)” – এই প্রশ্নের উত্তর আপনি পেয়েছেন। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ শুধু একটি ছন্দ নয়, এটি বাংলা কবিতার ঐতিহ্য। আপনিও এই ছন্দে কবিতা লিখে আপনার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন। চেষ্টা করুন, অনুশীলন করুন, আর হয়ে উঠুন একজন দক্ষ কবি! আর যদি এই ছন্দ নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় নিচে কমেন্ট করুন। আমি আপনার পাশে আছি!