আসুন শুরু করা যাক!
জীবন একট continuous process, তাই না? আর এই প্রক্রিয়াটি সচল রাখতে কোষ বিভাজন (Cell division) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হলো তেমনই একটি কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া – মাইটোসিস (Mitosis)। এই প্রক্রিয়াটি কিভাবে কাজ করে, কেন দরকার, আর এর বিভিন্ন পর্যায়গুলো নিয়েই আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব। তাহলে চলুন, আর দেরি না করে শুরু করা যাক!
মাইটোসিস কোষ বিভাজন কাকে বলে?
মাইটোসিস (Mitosis) হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি কোষ (Cell) দুটি নতুন কোষে বিভক্ত হয়, যেখানে প্রতিটি নতুন কোষে মাতৃকোষের (Parent cell) মতোই একই সংখ্যক ক্রোমোজোম (Chromosome) থাকে। সহজ ভাষায়, মাইটোসিস হলো কোষ বিভাজনের একটি প্রকার যেখানে একটি কোষ বিভক্ত হয়ে দুটি identical বা হুবহু একই রকম কোষ তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াটি জীবন্ত প্রাণীর বৃদ্ধি (Growth) এবং ক্ষতিগ্রস্ত কোষ পূরণে (Repair) সহায়তা করে।
মাইটোসিস কেন প্রয়োজন?
মাইটোসিসের প্রয়োজনীয়তা অনেক। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করা হলো:
-
বৃদ্ধি: আমাদের শরীর অসংখ্য কোষ দিয়ে তৈরি। যখন আমাদের শরীর বৃদ্ধি পায়, তখন নতুন কোষের প্রয়োজন হয়। মাইটোসিস এই নতুন কোষ তৈরির মাধ্যমে আমাদের শরীরকে বাড়াতে সাহায্য করে।
-
ক্ষয়পূরণ: আঘাত পেলে বা কোনো কারণে শরীরের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, সেই কোষগুলোকে প্রতিস্থাপন (Replace) করার প্রয়োজন হয়। মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় নতুন কোষ তৈরি হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কোষের জায়গা পূরণ করে।
-
অঙ্গ প্রতিস্থাপন: কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে, মাইটোসিস অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সাহায্য করে। যেমন, সাপের লেজ খসে গেলে নতুন লেজ গজানো অথবা টিকটিকির লেজ নতুন করে তৈরি হওয়া।
মাইটোসিসের পর্যায় (Stages of Mitosis)
মাইটোসিস একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। এই ধাপগুলোকে সাধারণত পাঁচটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা হয়:
- প্রোফেজ (Prophase)
- প্রো-মেটাফেজ (Prometaphase)
- মেটাফেজ (Metaphase)
- অ্যানাফেজ (Anaphase)
- টেলোফেজ (Telophase)
আসুন, এই পর্যায়গুলো বিস্তারিতভাবে জেনে নেই:
প্রোফেজ (Prophase)
প্রোফেজ হলো মাইটোসিসের প্রথম পর্যায়। এই ধাপে যা ঘটে:
-
ক্রোমোজোম ঘনীভূত হওয়া: কোষের নিউক্লিয়াসের (Nucleus) মধ্যে থাকা ক্রোমোজোমগুলো ধীরে ধীরে ঘনীভূত (Condensed) হতে শুরু করে। ফলে এদেরকে মাইক্রোস্কোপের নিচে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
-
নিউক্লিয়ার পর্দা বিলুপ্ত হওয়া: নিউক্লিয়াসের চারপাশে থাকা নিউক্লিয়ার পর্দা (Nuclear membrane) ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে শুরু করে এবং অদৃশ্য হয়ে যায়।
-
স্পিন্ডল ফাইবার তৈরি: কোষের দুই মেরুতে স্পিন্ডল ফাইবার (Spindle fiber) তৈরি হতে শুরু করে, যা কোষ বিভাজনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রো-মেটাফেজ (Prometaphase)
প্রো-মেটাফেজ হলো প্রোফেজের পরবর্তী ধাপ। এই ধাপে যা ঘটে:
-
স্পিন্ডল ফাইবারের সংযোগ: স্পিন্ডল ফাইবারগুলো ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ারের (Centromere) সাথে সংযুক্ত (Attach) হয়। প্রতিটি ক্রোমোজোমের দুটি করে কাইনেটোকোর (Kinetochore) থাকে, যেখানে স্পিন্ডল ফাইবারগুলো এসে লাগে।
-
ক্রোমোজোমের স্থানান্তর: স্পিন্ডল ফাইবারগুলো ক্রোমোজোমগুলোকে কোষের মাঝ বরাবর নিয়ে আসতে শুরু করে।
মেটাফেজ (Metaphase)
মেটাফেজ হলো মাইটোসিসের তৃতীয় পর্যায়। এই ধাপে যা ঘটে:
-
ক্রোমোজোমের সারিবদ্ধতা: ক্রোমোজোমগুলো কোষের ঠিক মাঝখানে একটি সরলরেখায় (Equator) সারিবদ্ধ (Aligned) হয়। এই অবস্থাকে মেটাফেজ প্লেটও (Metaphase plate) বলা হয়।
-
সঠিক সংযোগ নিশ্চিতকরণ: স্পিন্ডল ফাইবারগুলো নিশ্চিত করে যে প্রতিটি ক্রোমোজোমের কাইনেটোকোরের সাথে সঠিকভাবে যুক্ত হয়েছে।
অ্যানাফেজ (Anaphase)
অ্যানাফেজ হলো মাইটোসিসের চতুর্থ পর্যায়। এই ধাপে যা ঘটে:
-
সেন্ট্রোমিয়ারের বিভাজন: প্রতিটি ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ার (Centromere) বিভক্ত হয়ে যায়, যার ফলে সিস্টার ক্রোমাটিডগুলো (Sister chromatids) আলাদা হয়ে যায়।
-
ক্রোমাটিডের চলন: স্পিন্ডল ফাইবারগুলো ছোট হতে শুরু করে এবং সিস্টার ক্রোমাটিডগুলোকে কোষের দুই বিপরীত মেরুর দিকে টেনে নিয়ে যায়। এখন এই সিস্টার ক্রোমাটিডগুলোকে অপত্য ক্রোমোজোম (Daughter chromosome) বলা হয়।
টেলোফেজ (Telophase)
টেলোফেজ হলো মাইটোসিসের শেষ পর্যায়। এই ধাপে যা ঘটে:
-
নিউক্লিয়ার পর্দার পুনর্গঠন: প্রতিটি মেরুতে ক্রোমোজোমগুলো পৌঁছানোর পর তাদের চারপাশে নতুন নিউক্লিয়ার পর্দা (Nuclear membrane) তৈরি হতে শুরু করে।
-
ক্রোমোজোমের প্রসারণ: ক্রোমোজোমগুলো আবার লম্বা এবং সরু হয়ে যায়, অর্থাৎ ঘনীভূত অবস্থা থেকে প্রসারিত (Decondense) হতে শুরু করে।
-
সাইটোকিনেসিস শুরু: এই পর্যায়ে সাইটোকিনেসিস (Cytokinesis) শুরু হয়, যেখানে কোষের সাইটোপ্লাজম (Cytoplasm) দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি নতুন কোষ তৈরি করে।
সাইটোকিনেসিস (Cytokinesis)
সাইটোকিনেসিস মাইটোসিসের শেষ ধাপ, যদিও এটি মাইটোসিসের অংশ হিসেবেও বিবেচিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় মাতৃকোষের সাইটোপ্লাজম (Cytoplasm) সমান দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে দুটি অপত্য কোষ (Daughter cells) গঠন করে। প্রাণী এবং উদ্ভিদকোষে সাইটোকিনেসিস ভিন্ন উপায়ে ঘটে:
-
প্রাণীকোষে সাইটোকিনেসিস: প্রাণীকোষের সাইটোকিনেসিসে কোষের মাঝখানে একটি ক্লিভেজ ফারো (Cleavage furrow) তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে বাড়তে থাকে এবং কোষটিকে দুটি অংশে বিভক্ত করে ফেলে। অনেকটা যেন একটি দড়ি দিয়ে মাঝখান থেকে কোষটিকে বাঁধা হচ্ছে।
-
উদ্ভিদকোষে সাইটোকিনেসিস: উদ্ভিদকোষে কোষ প্রাচীর (Cell wall) থাকার কারণে ক্লিভেজ ফারো তৈরি হতে পারে না। তাই এখানে কোষের মাঝে একটি কোষ প্লেট (Cell plate) তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে দুই দিকে বাড়তে থাকে এবং নতুন কোষ প্রাচীর গঠন করে।
মাইটোসিস এবং মিয়োসিসের মধ্যে পার্থক্য (Difference Between Mitosis and Meiosis)
মাইটোসিস (Mitosis) এবং মিয়োসিস (Meiosis) উভয়ই কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া, তবে তাদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিচে একটি তুলনামূলক আলোচনা দেওয়া হলো:
বৈশিষ্ট্য | মাইটোসিস (Mitosis) | মিয়োসিস (Meiosis) |
---|---|---|
উদ্দেশ্য | নতুন কোষ তৈরি করে শরীরের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণ করা | জননকোষ (Gametes) তৈরি করা |
কোষের সংখ্যা | একটি মাতৃকোষ থেকে দুটি অপত্য কোষ তৈরি হয় | একটি মাতৃকোষ থেকে চারটি অপত্য কোষ তৈরি হয় |
ক্রোমোজোম সংখ্যা | অপত্য কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা মাতৃকোষের সমান থাকে | অপত্য কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা মাতৃকোষের অর্ধেক হয়ে যায় |
বিভাজন সংখ্যা | একবার বিভাজন হয় | দুইবার বিভাজন হয় (Meiosis I এবং Meiosis II) |
জেনেটিক ভিন্নতা | অপত্য কোষগুলো জেনেটিকভাবে মাতৃকোষের হুবহু অনুরূপ হয় | অপত্য কোষগুলো জেনেটিকভাবে ভিন্ন হয়, কারণ ক্রসিং ওভার (Crossing over) ঘটে |
কোথায় ঘটে | দেহকোষে (Somatic cells) ঘটে | জননকোষ উৎপাদক কোষে (Germ cells) ঘটে |
গুরুত্ব | বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ এবং অযৌন প্রজনন (Asexual reproduction) | যৌন প্রজনন (Sexual reproduction) এবং বংশগতির ধারা রক্ষা |
মাইটোসিসের গুরুত্ব (Importance of Mitosis)
মাইটোসিস আমাদের জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর কিছু উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব নিচে উল্লেখ করা হলো:
-
শারীরিক বৃদ্ধি: মাইটোসিস কোষ বিভাজনের মাধ্যমে নতুন কোষ তৈরি করে যা আমাদের শরীরকে বড় হতে সাহায্য করে।
-
ক্ষয়পূরণ ও পুনরুদ্ধার: শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে বা আঘাত পেলে, মাইটোসিস নতুন কোষ তৈরি করে সেই ক্ষত পূরণ করে।
-
অযৌন প্রজনন: কিছু জীব, যেমন ব্যাকটেরিয়া (Bacteria) এবং অ্যামিবা (Amoeba), মাইটোসিসের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে।
- কোষের প্রতিস্থাপন: আমাদের শরীরের অনেক কোষ নিয়মিতভাবে মারা যায় এবং নতুন কোষ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এই প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া মাইটোসিসের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
মাইটোসিস সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্ন (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখন, মাইটোসিস নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন এবং সেগুলোর উত্তর জেনে নেওয়া যাক:
প্রশ্ন ১: মাইটোসিস কোথায় ঘটে?
উত্তর: মাইটোসিস সাধারণত দেহকোষে (Somatic cells) ঘটে, জননকোষে (Germ cells) নয়।
প্রশ্ন ২: মাইটোসিসের সময় ক্রোমোজোমের কী হয়?
উত্তর: মাইটোসিসের সময় ক্রোমোজোমগুলো ঘনীভূত হয়, সারিবদ্ধ হয় এবং দুটি সমান অংশে বিভক্ত হয়ে দুটি নতুন কোষে চলে যায়।
প্রশ্ন ৩: মাইটোসিস এবং ক্যান্সারের মধ্যে সম্পর্ক কী?
উত্তর: মাইটোসিস একটি স্বাভাবিক কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া। কিন্তু যখন কোষ বিভাজন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়, তখন ক্যান্সার (Cancer) সৃষ্টি হতে পারে। ক্যান্সারের কোষগুলো খুব দ্রুত এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হতে থাকে।
প্রশ্ন ৪: সাইটোকিনেসিস কি মাইটোসিসের অংশ?
উত্তর: সাইটোকিনেসিসকে অনেক সময় মাইটোসিসের শেষ ধাপ হিসেবে ধরা হয়, যেখানে কোষের সাইটোপ্লাজম দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি নতুন কোষ তৈরি করে।
প্রশ্ন ৫: মাইটোসিস প্রক্রিয়ার ধাপগুলো কী কী?
উত্তর: মাইটোসিস প্রক্রিয়ার প্রধান ধাপগুলো হলো প্রোফেজ, প্রো-মেটাফেজ, মেটাফেজ, অ্যানাফেজ এবং টেলোফেজ।
মাইটোসিস: কিছু অতিরিক্ত তথ্য (Additional Information about Mitosis)
মাইটোসিস নিয়ে আরও কিছু তথ্য জেনে রাখা ভালো:
- মাইটোসিস একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এর প্রতিটি ধাপ সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। কোনো ত্রুটি দেখা দিলে কোষের অস্বাভাবিক বিভাজন হতে পারে, যা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
- মাইটোসিস প্রক্রিয়াটি পরিবেশগত কারণ, খাদ্য এবং অন্যান্য শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।
- বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত মাইটোসিস নিয়ে গবেষণা করছেন, যাতে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়াকে আরও ভালোভাবে বোঝা যায় এবং ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা উদ্ভাবন করা যায়।
মাইটোসিস নিয়ে শেষ কথা
মাইটোসিস হলো কোষ বিভাজনের সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা আমাদের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। এটি শুধু আমাদের দৈহিক বৃদ্ধি এবং ক্ষয়পূরণে সাহায্য করে না, বরং আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের সুস্থতা বজায় রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই জটিল প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে বুঝতে পারলে, আমরা ক্যান্সার এবং অন্যান্য কোষ বিভাজন সংক্রান্ত রোগ সম্পর্কে আরও সচেতন হতে পারব।
আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি আপনাদের মাইটোসিস সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে পেরেছে। যদি আপনাদের মনে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট সেকশনে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!