পৃথিবী সবসময় সবকিছুকে নিজের দিকে টানে! এই টানার ক্ষমতাকেই আমরা মহাকর্ষ বলি। কিন্তু শুধু কি টানলেই হবে? কত জোরে টানছে, সেটাও তো জানতে হবে, তাই না? এই যে কত জোরে টানছে, সেটাই হলো মহাকর্ষীয় প্রাবল্য। বিষয়টা একটু কঠিন মনে হচ্ছে? আরে, চিন্তা নেই! আমি আছি তো! চলেন, সহজ ভাষায় “মহাকর্ষীয় প্রাবল্য কাকে বলে” সেটা জেনে নিই, আর এর পেছনের বিজ্ঞানটা একটু ঝালিয়ে নেই।
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য: একদম জলের মতো সোজা!
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য মানে হলো, কোনো একটা স্থানে মহাকর্ষ বল কতটা শক্তিশালী। ধরুন, আপনি একটা চুম্বক ধরে আছেন। চুম্বকের কাছে একটা লোহার পেরেক আনলে, পেরেকটা খুব জোরে চুম্বকের দিকে ছুটে যাবে। কারণ, ওই স্থানে চুম্বকের আকর্ষণ বেশি। তেমনি, পৃথিবীর চারপাশেও একটা ক্ষেত্র আছে, যেখানে পৃথিবীর আকর্ষণ অনুভব করা যায়। এই ক্ষেত্রটাই হলো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র, আর এই ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে একক ভরের কোনো বস্তুকে পৃথিবী যে বল দিয়ে টানে, সেটাই হলো ঐ স্থানের মহাকর্ষীয় প্রাবল্য।
তাহলে সংজ্ঞাটা কী দাঁড়ালো?
সংজ্ঞাটা হলো: মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে একক ভরের বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বলকে ঐ বিন্দুর মহাকর্ষীয় প্রাবল্য বলে।
একটু অঙ্ক কষি? (ভয় নেই, সহজ!)
যদি m ভরের কোনো বস্তুর উপর F বল প্রয়োগ করা হয়, তাহলে মহাকর্ষীয় প্রাবল্য (E) হবে:
E = F/m
মহাকর্ষীয় প্রাবল্যের একক হলো নিউটন প্রতি কিলোগ্রাম (N/kg)।
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য আমাদের চারপাশের অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিচে দেওয়া হলো:
-
গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি: মহাকর্ষীয় প্রাবল্য দিয়েই বোঝা যায়, কেন গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘোরে, অথবা চাঁদ কেন পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে।
-
ওজন মাপা: আপনার ওজন আসলে পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের কারণে হয়। মহাকর্ষীয় প্রাবল্য কম-বেশি হলে আপনার ওজনেরও তারতম্য ঘটবে।
-
রকেট উৎক্ষেপণ: রকেটকে পৃথিবীর আকর্ষণ ভেদ করে মহাশূন্যে যেতে হয়। এর জন্য মহাকর্ষীয় প্রাবল্য সম্পর্কে ধারণা থাকা খুব জরুরি।
মহাকর্ষীয় বিভব (Gravitational Potential): প্রাবল্যের সাথে এর সম্পর্ক কী?
মহাকর্ষীয় বিভব আর প্রাবল্য কিন্তু একই জিনিস নয়, তবে তারা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। মহাকর্ষীয় বিভব হলো কোনো বস্তুকে অসীম দূরত্ব থেকে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে আনতে যে কাজ করতে হয়, সেটি। অন্যদিকে, মহাকর্ষীয় প্রাবল্য হলো ঐ বিন্দুতে একক ভরের বস্তুর উপর প্রযুক্ত মহাকর্ষ বল।
সম্পর্কটা কেমন?
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য হলো মহাকর্ষীয় বিভবের ঋণাত্মক নতি (negative gradient)। এর মানে হলো, বিভবের পরিবর্তনের হার থেকেই প্রাবল্য নির্ণয় করা যায়।
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য এবং অভিকর্ষজ ত্বরণ: এদের মধ্যে পার্থক্য কী?
অনেকেই মহাকর্ষীয় প্রাবল্য এবং অভিকর্ষজ ত্বরণকে গুলিয়ে ফেলেন। তবে এদের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে।
-
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য: এটা হলো কোনো স্থানে মহাকর্ষ বলের তীব্রতা। অর্থাৎ, একক ভরের বস্তুর উপর কতটুকু বল কাজ করছে।
-
অভিকর্ষজ ত্বরণ: এটা হলো মহাকর্ষ বলের কারণে কোনো বস্তুর ত্বরণের হার। অর্থাৎ, কোনো বস্তু কত দ্রুত পৃথিবীর দিকে পড়ছে।
আসলে, অভিকর্ষজ ত্বরণ হলো মহাকর্ষীয় প্রাবল্যের একটি বিশেষ রূপ। পৃথিবীর পৃষ্ঠে বা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি মহাকর্ষীয় প্রাবল্যকে অভিকর্ষজ ত্বরণ বলা হয়।
গণিতের ভাষায়:
অভিকর্ষজ ত্বরণ (g) = G * M / R^2
এখানে,
- G = মহাকর্ষীয় ধ্রুবক (Gravitational Constant)
- M = পৃথিবীর ভর
- R = পৃথিবীর ব্যাসার্ধ
বিভিন্ন স্থানে মহাকর্ষীয় প্রাবল্যের পরিবর্তন
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য সব জায়গায় সমান নয়। এটা বিভিন্ন কারণে পরিবর্তিত হতে পারে:
-
দূরত্ব: পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে যত দূরে যাবেন, মহাকর্ষীয় প্রাবল্য তত কমবে।
-
উচ্চতা: সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে উঠবেন, মহাকর্ষীয় প্রাবল্য তত কমবে।
-
অক্ষাংশ: পৃথিবীর আকৃতির কারণে মেরু অঞ্চলে মহাকর্ষীয় প্রাবল্য বেশি, আর বিষুব অঞ্চলে কম।
উদাহরণ:
মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় মহাকর্ষীয় প্রাবল্য সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে একটু কম। তাই সেখানে আপনার ওজন সামান্য কম হবে!
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য পরিমাপ করার উপায়
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য সরাসরি মাপা যায় না। তবে, মহাকর্ষ বল পরিমাপ করে প্রাবল্য নির্ণয় করা যায়। এর জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যেমন:
-
ব্যালান্স: ব্যালান্স ব্যবহার করে বস্তুর ওজন মাপা হয়, যা থেকে মহাকর্ষ বল এবং পরে প্রাবল্য বের করা যায়।
-
গ্রাভিমিটার: এটি একটি বিশেষ যন্ত্র, যা মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের ছোট পরিবর্তনও মাপতে পারে।
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য নিয়ে কিছু মজার তথ্য
-
চাঁদে মহাকর্ষীয় প্রাবল্য পৃথিবীর চেয়ে অনেক কম। তাই সেখানে সবকিছু হালকা মনে হয়।
-
বৃহস্পতি গ্রহে মহাকর্ষীয় প্রাবল্য অনেক বেশি। সেখানে আপনার ওজন পৃথিবীর চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি হবে!
-
কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole)-এর মহাকর্ষীয় প্রাবল্য এত বেশি যে, আলো পর্যন্ত সেখান থেকে পালাতে পারে না!
FAQs: আপনার প্রশ্ন, আমার উত্তর
এখন কিছু সাধারণ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করা যাক, যেগুলো अक्सर মহাকর্ষীয় প্রবাহের আলোচনায় উঠে আসে:
-
মহাকর্ষীয় প্রাবল্যের মান কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে?
মহাকর্ষীয় প্রাবল্যের মান প্রধানত দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে: বস্তুর ভর এবং দূরত্বের বর্গ। ভর যত বেশি, প্রাবল্য তত বেশি; দূরত্ব যত বেশি, প্রাবল্য তত কম। -
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য একটি ভেক্টর রাশি কেন?
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য একটি ভেক্টর রাশি, কারণ এর মান এবং দিক উভয়ই আছে। এটি একটি নির্দিষ্ট দিকে ক্রিয়া করে, যা মহাকর্ষীয় বলের দিক নির্দেশ করে। -
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য এবং মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্যে সম্পর্ক কী?
মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র হলো সেই অঞ্চল, যেখানে মহাকর্ষীয় বল অনুভব করা যায়। মহাকর্ষীয় প্রাবল্য হলো এই ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে একক ভরের বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল।
-
পৃথিবীর কেন্দ্রে মহাকর্ষীয় প্রাবল্যের মান কত?
পৃথিবীর কেন্দ্রে মহাকর্ষীয় প্রাবল্যের মান শূন্য। কারণ, কেন্দ্রের চারপাশে সমানভাবে ভর বিস্তৃত থাকায় মহাকর্ষীয় বল একে অপরকে প্রশমিত করে। -
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য কিভাবে বস্তুর ওজনকে প্রভাবিত করে?
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য সরাসরি বস্তুর ওজনকে প্রভাবিত করে। কোনো বস্তুর ওজন হলো মহাকর্ষীয় প্রাবল্যের কারণে সেই বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল। প্রাবল্য বাড়লে ওজন বাড়ে, কমলে কমে।
এগুলো ছাড়াও যদি আপনার মনে কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় কমেন্ট সেকশনে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আমি অবশ্যই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
উপসংহার: মহাকর্ষ যেন এক মায়ার খেলা!
মহাকর্ষীয় প্রাবল্য হয়তো একটু জটিল মনে হতে পারে, কিন্তু এটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহাকর্ষ না থাকলে আমরা কেউই মাটিতে পা রাখতে পারতাম না, সবকিছু ভেসে বেড়াতো! তাই মহাকর্ষকে জানুন, বুঝুন, এবং এই মায়ার খেলায় শামিল হন। কেমন লাগলো আজকের আলোচনা? জানাতে ভুলবেন না কিন্তু! আর হ্যাঁ, মহাকর্ষ নিয়ে আপনার কোনো মজার অভিজ্ঞতা থাকলে, সেটাও শেয়ার করতে পারেন।