“
জীবনটা কি একটা দমবন্ধ করা খাঁচা, নাকি খোলা আকাশের নিচে মুক্তির স্বাদ? আমাদের সংবিধানে কিছু অধিকার লেখা আছে, যা এই দুটোর মাঝে একটা ভারসাম্য তৈরি করে। চলুন, আজ আমরা সেই “মৌলিক অধিকার”গুলো নিয়ে একটু গল্প করি।
মৌলিক অধিকার কাকে বলে? (Moulik Odhikar Kake Bole?)
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, মৌলিক অধিকার হলো সেইসব অধিকার যা একজন নাগরিকের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। এগুলো সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এবং সুরক্ষিত, যা রাষ্ট্র বা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কেড়ে নেওয়া যায় না। এগুলো এমন কিছু পাওয়ার, যা আপনাকে মানুষ হিসেবে বাঁচতে সাহায্য করে।
মৌলিক অধিকারগুলো মানুষের জন্মগত অধিকার। একটা সুন্দর, সুস্থ জীবন ধারণের জন্য এই অধিকারগুলো ভোগ করা খুবই জরুরি।
একটু অন্যভাবে ভাবুন তো…
ধরুন, আপনি একটি ছবি আঁকতে ভালোবাসেন। আপনার মৌলিক অধিকার যদি না থাকে, তাহলে হয়তো কেউ আপনাকে সেই ছবি আঁকতে বাধা দিতে পারে। অথবা, আপনি হয়তো নিজের পছন্দের খাবার খেতে চান, কিন্তু মৌলিক অধিকার না থাকলে, কেউ আপনাকে সেই খাবার থেকে বঞ্চিত করতে পারে।
মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করে যে, আপনি নিজের মতো করে বাঁচতে পারবেন, নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারবেন এবং সমাজে একজন সম্মানিত নাগরিক হিসেবে জীবন যাপন করতে পারবেন।
বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহ
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকদের জন্য কিছু মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো:
জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার (Right to life and personal liberty)
সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এর মানে হলো, প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আছে। কেউ আপনার জীবন কেড়ে নিতে পারবে না, অথবা আপনাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করতে পারবে না।
আইনের দৃষ্টিতে সমতার অধিকার (Right to equality before the law)
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। এর মানে হলো, ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই আইনের কাছে সমান। কেউ বিশেষ সুবিধা পাবে না।
ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার (Right to freedom of religion)
সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম পালন ও প্রচারের স্বাধীনতা আছে। আপনি যে কোনো ধর্ম বিশ্বাস করতে পারেন, সেই অনুযায়ী উপাসনা করতে পারেন এবং নিজের ধর্ম প্রচার করতে পারেন। কেউ আপনাকে ধর্ম পরিবর্তন করতে বাধ্য করতে পারবে না।
বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার অধিকার (Right to freedom of speech and expression)
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মানে হলো, আপনি নিজের চিন্তা প্রকাশ করতে পারবেন, সরকারের সমালোচনা করতে পারবেন, শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল-মিটিং করতে পারবেন। তবে, এই অধিকারের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আছে, যা দেশের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য জরুরি।
সম্পত্তির অধিকার (Right to property)
যদিও পূর্বে সম্পত্তির অধিকার একটি মৌলিক অধিকার ছিল, বর্তমানে এটি একটি সাংবিধানিক অধিকার।
গ্রেফতার ও আটকের বিরুদ্ধে অধিকার (Protection against arrest and detention)
সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা আটক করা হলে, তাকে আটকের কারণ জানাতে হবে এবং আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। বিনা কারণে কাউকে বন্দী করে রাখা যাবে না।
চলাফেরার স্বাধীনতা (Freedom of movement)
সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার আছে। আপনি বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে যেতে পারেন, বসবাস করতে পারেন। তবে, জনস্বার্থে বা আদালতের নির্দেশে এই অধিকার সীমিত হতে পারে।
কেন এই অধিকারগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ?
মৌলিক অধিকারগুলো শুধু কাগজে লেখা কিছু শব্দ নয়, এগুলো আমাদের জীবনের ভিত্তি। এগুলো ছাড়া একটি সুস্থ, সুন্দর ও মানবিক সমাজ কল্পনা করা যায় না। নিচে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো:
- ব্যক্তি স্বাধীনতা: এই অধিকারগুলো আপনাকে নিজের মতো করে বাঁচতে সাহায্য করে। আপনি কী করবেন, কী ভাববেন, কীভাবে চলবেন, তা ঠিক করার স্বাধীনতা দেয়।
- সামাজিক ন্যায়বিচার: মৌলিক অধিকারগুলো সমাজের দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের রক্ষা করে। সবাই যাতে সমান সুযোগ পায়, তা নিশ্চিত করে।
- গণতন্ত্রের ভিত্তি: গণতন্ত্র তখনই সফল হয়, যখন নাগরিকরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং সেগুলো ভোগ করতে পারে। এই অধিকারগুলো সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে।
মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকার: এদের মধ্যে পার্থক্য কী?
অনেকেই মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকারকে গুলিয়ে ফেলেন। এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। নিচে একটি টেবিলের মাধ্যমে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া হলো:
বৈশিষ্ট্য | মৌলিক অধিকার | মানবাধিকার |
---|---|---|
উৎস | সংবিধান | আন্তর্জাতিক চুক্তি ও ঘোষণা |
পরিধি | একটি দেশের ভূখণ্ডে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য | বিশ্বের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য |
প্রয়োগকারী সংস্থা | রাষ্ট্র (দেশের সরকার) | জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা |
উদাহরণ | বাকস্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা | জীবনধারণের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার |
মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে কী করবেন?
যদি মনে করেন আপনার কোনো মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তাহলে আপনি আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগে মামলা করা যায়। আদালত আপনার অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হলো, যা মৌলিক অধিকার সম্পর্কে আপনার ধারণা আরও স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে:
প্রশ্ন ১: মৌলিক অধিকার কি পরিবর্তন করা যায়?
উত্তর: সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক অধিকার পরিবর্তন করা যায়, তবে সেটি সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। অর্থাৎ, এমন কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না, যা সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যকে বদলে দেয়।
প্রশ্ন ২: জরুরি অবস্থায় কি মৌলিক অধিকার স্থগিত করা যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, জরুরি অবস্থায় কিছু মৌলিক অধিকার স্থগিত করা যেতে পারে। তবে, জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩২) কোনো অবস্থাতেই স্থগিত করা যায় না।
প্রশ্ন ৩: বাংলাদেশের সংবিধানে কয়টি মৌলিক অধিকার আছে?
উত্তর: বাংলাদেশের সংবিধানে বর্তমানে বেশ কয়েকটি মৌলিক অধিকার রয়েছে, যা তৃতীয় ভাগে বর্ণিত আছে।
প্রশ্ন ৪: কোন অধিকারটি আগে মৌলিক অধিকার ছিল কিন্তু বর্তমানে নেই?
উত্তর: সম্পত্তির অধিকার আগে মৌলিক অধিকার ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটি একটি সাংবিধানিক অধিকার।
প্রশ্ন ৫: মৌলিক অধিকারগুলো কি শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য?
উত্তর: না, মৌলিক অধিকারগুলো শিশুসহ সকল নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য। কিছু অধিকার, যেমন শিক্ষার অধিকার, বিশেষভাবে শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব
মৌলিক অধিকার ভোগ করার পাশাপাশি আমাদের কিছু দায়িত্বও আছে। আমাদের উচিত:
- নিজের অধিকার সম্পর্কে জানা এবং অন্যদের জানাতে সাহায্য করা।
- অন্যের অধিকারকে সম্মান করা।
- আইন মেনে চলা এবং দেশের প্রতি অনুগত থাকা।
- গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা এবং সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা।
শেষ কথা
মৌলিক অধিকারগুলো আমাদের জীবনের অমূল্য সম্পদ। এগুলো রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি এমন সমাজ গড়ি, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার অধিকার ভোগ করতে পারে এবং সম্মানের সাথে বাঁচতে পারে। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকুন, অন্যদের সচেতন করুন। মনে রাখবেন, আপনার অধিকার আপনার হাতেই।
“