জেনে নিন মুকিম কাকে বলে: সহজ ভাষায় বিস্তারিত আলোচনা
মনে করুন, আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ঘুরতে যাবেন। থাকার জন্য হোটেল বুকিংও দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ জরুরি কাজে আটকা পড়লেন। এখন কী করবেন? চাইলেই কি সব কিছু বাতিল করা যায়? অথবা ধরুন, অফিসের কাজে আপনাকে কয়েক দিনের জন্য অন্য শহরে যেতে হচ্ছে। এ সময় আপনার নামাজ-রোজার বিধান কী হবে? এই ধরনের পরিস্থিতিতে “মুকিম” শব্দটা খুব কাজে লাগে। মুকিম কাকে বলে, মুকিমের বিধান কী, একজন মুসাফির কীভাবে মুকিম হতে পারেন – এইসব নিয়েই আজকের আলোচনা।
মুকিম শব্দটির আরবি অর্থ হলো “অবস্থানকারী”। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, মুকিম হলেন সেই ব্যক্তি যিনি কোনো স্থানে ১৫ দিন বা তার বেশি সময় ধরে থাকার নিয়ত করেছেন। অর্থাৎ, আপনি যদি কোথাও ১৫ দিন বা তার বেশি থাকার পরিকল্পনা করেন, তবে আপনি সেই স্থানের জন্য মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন। মুকিম অবস্থায় একজন ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে নামাজ, রোজা এবং অন্যান্য ইবাদত পালন করেন।
মুকিম হওয়ার শর্তাবলী
মুকিম হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। এই শর্তগুলো পূরণ হলেই একজন মুসাফির মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন। নিচে শর্তগুলো আলোচনা করা হলো:
স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত
প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো, আপনাকে কোনো একটি স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করতে হবে। এর মানে হলো, আপনি সেখানে ১৫ দিন বা তার বেশি সময় ধরে থাকবেন। যদি আপনার নিয়ত থাকে যে কয়েক দিন পর আপনি অন্য কোথাও চলে যাবেন, তাহলে আপনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন না।
নির্দিষ্ট স্থান
আপনি যে স্থানে মুকিম হতে চান, সেই স্থানটি নির্দিষ্ট হতে হবে। এর মানে হলো, আপনি যদি এমন কোনো স্থানে থাকেন যেখানে আপনার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই অথবা আপনি ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করতে থাকেন, তাহলে আপনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন না।
অনিবার্য কারণ
যদি কোনো অনিবার্য কারণ যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো আপদকালীন পরিস্থিতির কারণে আপনাকে কোনো স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে হয়, তবে আপনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন না।
মুকিমের বিধান
ইসলামী শরীয়তে মুকিমের জন্য কিছু বিশেষ বিধান রয়েছে। একজন মুকিম তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মতোই ইবাদত করবেন। নিচে মুকিমের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান আলোচনা করা হলো:
নামাজ
মুকিম ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পূর্ণরূপে আদায় করবেন। তিনি নামাজের কসর করবেন না অর্থাৎ চারটি রাকাআত বিশিষ্ট ফরজ নামাজগুলো সংক্ষিপ্ত করে দুই রাকাআত পড়বেন না।
রোজা
মুকিম ব্যক্তি রমজান মাসে রোজা রাখবেন এবং তা কাজা করার প্রয়োজন হবে না। যদি তিনি অসুস্থ হন অথবা অন্য কোনো শরঈ কারণে রোজা রাখতে অক্ষম হন, তবে পরবর্তীতে কাজা করে দেবেন।
অন্যান্য ইবাদত
নামাজ ও রোজা ছাড়াও একজন মুকিম স্বাভাবিক অবস্থায় অন্যান্য ইবাদত যেমন- যাকাত, হজ ইত্যাদি পালন করবেন।
মুসাফির কখন মুকিম হবেন?
একজন মুসাফির কখন মুকিম হবেন, তা জানার আগে মুসাফির কাকে বলে সেটা একটু জেনে নেয়া যাক। মুসাফির হলেন তিনি, যিনি ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৭ কিলোমিটার) বা তার বেশি দূরত্বে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজLocality ত্যাগ করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, একজন মুসাফির কখন মুকিম হবেন? একজন মুসাফির যদি কোনো স্থানে ১৫ দিন বা তার বেশি সময় থাকার নিয়ত করেন, তবে তিনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন। এক্ষেত্রে, তাকে মুকিমের বিধান অনুযায়ী নামাজ, রোজা এবং অন্যান্য ইবাদত পালন করতে হবে।
নিয়তের গুরুত্ব
এখানে নিয়তের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো মুসাফির কোনো স্থানে কত দিন থাকবেন, তা নির্দিষ্ট না করেন অথবা তার নিয়ত থাকে যে তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই চলে যাবেন, তাহলে তিনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন না।
মুকিম এবং মুসাফিরের মধ্যে পার্থক্য
মুকিম এবং মুসাফিরের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যগুলো তাদের ইবাদত এবং জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলে। নিচে মুকিম এবং মুসাফিরের মধ্যেকার প্রধান পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হলো:
বিষয় | মুকিম | মুসাফির |
---|---|---|
সংজ্ঞা | যিনি কোনো স্থানে ১৫ দিন বা তার বেশি সময় থাকার নিয়ত করেছেন | যিনি ৪৮ মাইল (প্রায় ৭৭ কিলোমিটার) বা তার বেশি দূরত্বে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজLocality ত্যাগ করেছেন |
নামাজের বিধান | পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পূর্ণরূপে আদায় করবেন | চারটি রাকাআত বিশিষ্ট ফরজ নামাজগুলো সংক্ষিপ্ত করে দুই রাকাআত পড়বেন |
রোজার বিধান | রমজান মাসে রোজা রাখবেন এবং তা কাজা করার প্রয়োজন নেই | রোজা না রাখার সুযোগ রয়েছে, তবে পরবর্তীতে কাজা করতে হবে |
অন্যান্য বিধান | স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মতোই অন্যান্য ইবাদত পালন করবেন | কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় পেতে পারেন |
কিছু জরুরি প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এই অংশে মুকিম সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাদের মনে প্রায়ই উদয় হতে পারে:
আমি যদি জানি আমাকে ১৫ দিনের বেশি থাকতে হবে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই, তাহলে কি আমি মুকিম হব?
যদি আপনার মনে ১৫ দিনের বেশি থাকার প্রবল ধারণা থাকে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট তারিখ না থাকে, তবুও আপনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন। তবে এক্ষেত্রে আপনার নিয়তের ওপর নির্ভর করবে।
অফিসের কাজে অন্য শহরে গিয়ে কতদিন থাকলে মুকিম হবো?
অফিসের কাজে অন্য শহরে গিয়ে যদি আপনি ১৫ দিন বা তার বেশি থাকার নিয়ত করেন, তাহলে আপনি মুকিম হবেন। অন্যথায়, আপনি মুসাফির হিসেবে গণ্য হবেন।
ছাত্রজীবনে হোস্টেলে থাকলে মুকিম হওয়ার বিধান কী?
ছাত্রজীবনে হোস্টেলে থাকলে যদি আপনার সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত থাকে এবং আপনি ১৫ দিন বা তার বেশি সময় ধরে সেখানে থাকেন, তাহলে আপনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন।
মহিলারা বাবার বাড়ি বা স্বামীর বাড়ি কত দিন থাকলে মুকিম হবেন?
মহিলারা বাবার বাড়ি বা স্বামীর বাড়ি যেখানেই যান, যদি সেখানে ১৫ দিন বা তার বেশি সময় থাকার নিয়ত করেন, তাহলে তিনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন।
ভ্রমণের সময় মুকিম হওয়ার নিয়ম কী?
ভ্রমণের সময় যদি আপনি কোনো স্থানে ১৫ দিন বা তার বেশি সময় থাকার নিয়ত করেন, তাহলে আপনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন। এক্ষেত্রে, আপনাকে মুকিমের বিধান অনুযায়ী নামাজ, রোজা এবং অন্যান্য ইবাদত পালন করতে হবে।
মুকিম অবস্থায় মুসাফিরের মতো সুবিধা পাওয়া যাবে কি?
মুকিম অবস্থায় আপনি মুসাফিরের মতো সুবিধা পাবেন না। মুকিম হিসেবে আপনাকে স্বাভাবিকভাবে নামাজ, রোজা এবং অন্যান্য ইবাদত পালন করতে হবে।
মুকিম থাকা অবস্থায় কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে তার জন্য বিধান কী?
মুকিম থাকা অবস্থায় কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে তিনি রোজা রাখতে অক্ষম হলে পরবর্তীতে তা কাজা করে দিতে পারবেন। তবে নামাজের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ছাড় নেই, তিনি স্বাভাবিকভাবে নামাজ আদায় করবেন।
আমি মুসাফির হিসেবে একটি শহরে গেলাম, সেখানে আমার আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলাম। এখন আমি কতদিন পর মুকিম হবো?
আপনি যদি মুসাফির হিসেবে কোনো শহরে যান এবং সেখানে আপনার আত্মীয়ের বাড়িতে ১৫ দিন বা তার বেশি সময় থাকার নিয়ত করেন, তবে আপনি মুকিম হিসেবে গণ্য হবেন।
যদি কেউ মুকিম হওয়ার পর ১৫ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই চলে যেতে বাধ্য হয়, তাহলে তার বিধান কী?
যদি কেউ মুকিম হওয়ার পর ১৫ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই কোনো কারণে চলে যেতে বাধ্য হয়, তবে তিনি আর মুকিম থাকবেন না। এক্ষেত্রে, তিনি পুনরায় মুসাফির হিসেবে গণ্য হবেন।
বাস্তব জীবনে মুকিমের গুরুত্ব
ইসলামিক জীবন ব্যবস্থায় মুকিমের বিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মুসলিমদের ইবাদত এবং দৈনন্দিন জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। মুকিম হওয়ার নিয়ম জানার মাধ্যমে, একজন মুসলিম তার নিজLocalityর বাইরেও সঠিকভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে পারেন।
শেষ কথা
মুকিম কাকে বলে, মুকিমের বিধান, মুসাফির কখন মুকিম হন – এই বিষয়গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জরুরি। আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে আপনারা মুকিম সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন। তবুও যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আপনার সুন্দর ও ধর্মপূর্ণ জীবন কামনা করি।