আচ্ছা, ভাবুন তো, আপনি একটা মজার খেলা খেলছেন!
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হলো “নিবৃত্তি বিভব”। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, জিনিসটা আসলে খুবই সোজা। দৈনন্দিন জীবনের খেলার মতোই আমরা এটা বুঝবো। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
নিবৃত্তি বিভব জিনিসটা কী, সেটা জানার আগে চলুন এর পেছনের কিছু কথা জেনে নেই।
নিবৃত্তি বিভব (Reversal Potential) কী?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, নিবৃত্তি বিভব হলো সেই ভোল্টেজ যেখানে একটি নির্দিষ্ট আয়নের (যেমন সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড) জন্য কোষ ঝিল্লির (cell membrane) মধ্যে কোনো তড়িৎ রাসায়নিক শক্তি (electrochemical driving force) থাকে না। তার মানে, এই ভোল্টেজে আয়নগুলোর নেট প্রবাহ শূন্য হয়ে যায়, অর্থাৎ কোনো আয়ন কোষের ভিতরেও প্রবেশ করে না, আবার কোষ থেকে বাইরেও যায় না। সবকিছু একদম চুপচাপ!
বিষয়টা আরও একটু ভেঙে বলা যাক। যখন কোনো আয়ন চ্যানেলের মাধ্যমে কোষের ভিতরে বা বাইরে যায়, তখন দুটি জিনিস কাজ করে:
- রাসায়নিক ঢাল (Chemical Gradient): এটি আয়নগুলোর ঘনত্বের পার্থক্যের কারণে তৈরি হয়। বেশি ঘনত্ব থেকে কম ঘনত্বের দিকে আয়ন যেতে চায়। অনেকটা যেন নদীর জল উঁচু জায়গা থেকে নিচু জায়গায় গড়িয়ে যায়।
- বৈদ্যুতিক ঢাল (Electrical Gradient): এটি কোষের ভেতরের এবং বাইরের চার্জের পার্থক্যের কারণে তৈরি হয়। পজিটিভ আয়ন নেগেটিভ চার্জের দিকে এবং নেগেটিভ আয়ন পজিটিভ চার্জের দিকে আকৃষ্ট হয়।
নিবৃত্তি বিভবে এই দুটি ঢাল একে অপরের বিপরীত দিকে কাজ করে এবং একে অপরের প্রভাবকে বাতিল করে দেয়। ফলে, আয়নের নেট প্রবাহ শূন্য হয়।
নিবৃত্তি বিভবের গুরুত্ব
নিবৃত্তি বিভব কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তাই তো ভাবছেন? এর অনেক কারণ আছে!
- কোষের সংকেত (Cell Signaling): নিবৃত্তি বিভব স্নায়ু কোষ (nerve cell) এবং পেশী কোষের (muscle cell) সংকেত পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই বিভবের পরিবর্তনের মাধ্যমেই কোষগুলো একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে।
- রোগ নির্ণয় (Diagnosis): বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে নিবৃত্তি বিভবের পরিবর্তন হতে পারে। তাই, এটি রোগ নির্ণয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
- ফার্মাকোলজি (Pharmacology): ওষুধ কিভাবে কোষের উপর কাজ করে, সেটা বোঝার জন্য নিবৃত্তি বিভব জানা জরুরি।
নিবৃত্তি বিভব কিভাবে পরিমাপ করা হয়?
নিবৃত্তি বিভব পরিমাপ করার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো “ভোল্টেজ ক্ল্যাম্প” (Voltage Clamp) পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে, কোষের ভোল্টেজ একটি নির্দিষ্ট মানে ধরে রাখা হয় এবং তারপর দেখা হয় আয়নগুলোর প্রবাহ কোন ভোল্টেজে শূন্য হয়।
ভোল্টেজ ক্ল্যাম্প পদ্ধতি
ভোল্টেজ ক্ল্যাম্প পদ্ধতিতে একটি ইলেকট্রোড ব্যবহার করে কোষের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। এই ইলেকট্রোড কোষের ভোল্টেজ পরিমাপ করে এবং একটি অ্যামপ্লিফায়ারের মাধ্যমে ভোল্টেজকে একটি নির্দিষ্ট মানে ধরে রাখে। যখন কোনো আয়ন চ্যানেল খোলে, তখন আয়নগুলো কোষের ভিতরে বা বাইরে যেতে শুরু করে। অ্যামপ্লিফায়ার তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে কারেন্ট সরবরাহ করে কোষের ভোল্টেজ স্থির রাখে।
এই কারেন্টের পরিমাণ পরিমাপ করে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে কোন ভোল্টেজে আয়নগুলোর নেট প্রবাহ শূন্য হচ্ছে। সেটাই হলো নিবৃত্তি বিভব।
নার্নস্ট সমীকরণ (Nernst Equation)
নিবৃত্তি বিভবকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করার জন্য নার্নস্ট সমীকরণ ব্যবহার করা হয়। এই সমীকরণটি একটি নির্দিষ্ট আয়ন এবং তাপমাত্রার জন্য নিবৃত্তি বিভবের মান নির্ণয় করতে সাহায্য করে।
নার্নস্ট সমীকরণটি হলো:
E = (RT/zF) * ln( [Ion]out / [Ion]in )
এখানে,
- E = নিবৃত্তি বিভব (Reversal Potential)
- R = গ্যাস ধ্রুবক (Gas constant)
- T = পরম তাপমাত্রা (Absolute temperature)
- z = আয়নের চার্জ (Ion charge)
- F = ফ্যারাডে ধ্রুবক (Faraday constant)
- [Ion]out = কোষের বাইরের আয়ন এর ঘনত্ব (Ion concentration outside the cell)
- [Ion]in = কোষের ভিতরের আয়ন এর ঘনত্ব (Ion concentration inside the cell)
এই সমীকরণটি ব্যবহার করে, বিজ্ঞানীরা কোষের ভিতরে এবং বাইরের আয়নগুলোর ঘনত্ব এবং চার্জ জেনে নিবৃত্তি বিভবের মান বের করতে পারেন।
নার্নস্ট সমীকরণের ব্যবহার
নার্নস্ট সমীকরণ শুধু একটি গাণিতিক সূত্র নয়, এটি আমাদের কোষের আচরণ বুঝতেও সাহায্য করে।
- এই সমীকরণ ব্যবহার করে, বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে কোনো নির্দিষ্ট আয়ন কিভাবে কোষের মেমব্রেন পোটেনশিয়ালকে (membrane potential) প্রভাবিত করে।
- বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, যেমন অসুস্থতার সময় বা ওষুধের প্রভাবে, কোষের আয়ন ঘনত্বের পরিবর্তন হলে নিবৃত্তি বিভবের পরিবর্তন কেমন হবে, সেটাও এই সমীকরণ দিয়ে বের করা যায়।
নিবৃত্তি বিভব এবং অ্যাকশন পোটেনশিয়াল (Action Potential)
নিবৃত্তি বিভব এবং অ্যাকশন পোটেনশিয়াল – এই দুইটি বিষয় স্নায়ুবিজ্ঞানের (Neuroscience) জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাকশন পোটেনশিয়াল হলো স্নায়ু কোষের মধ্যে দ্রুত বৈদ্যুতিক সংকেত, যা আমাদের মস্তিষ্ক থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে তথ্য আদান প্রদানে সাহায্য করে।
অ্যাকশন পোটেনশিয়ালে নিবৃত্তি বিভবের ভূমিকা
অ্যাকশন পোটেনশিয়ালের মূল চালিকাশক্তি হলো সোডিয়াম (Na+) এবং পটাশিয়াম (K+) আয়নগুলোর প্রবাহ।
- যখন একটি স্নায়ু কোষ উদ্দীপিত হয়, তখন সোডিয়াম চ্যানেলগুলো খুলে যায় এবং সোডিয়াম আয়ন কোষের ভিতরে প্রবেশ করে। এর ফলে কোষের ভেতরের ভোল্টেজ বেড়ে যায়, কারণ সোডিয়ামের নিবৃত্তি বিভব অনেক বেশি পজিটিভ (+60 mV)।
- এরপর পটাশিয়াম চ্যানেলগুলো খুলে যায় এবং পটাশিয়াম আয়ন কোষ থেকে বাইরে যেতে শুরু করে। এতে কোষের ভেতরের ভোল্টেজ আবার কমতে থাকে, কারণ পটাশিয়ামের নিবৃত্তি বিভব নেগেটিভ (-90 mV)।
এই প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত ঘটে এবং এর ফলেই অ্যাকশন পোটেনশিয়াল তৈরি হয়। নিবৃত্তি বিভব এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি নির্ধারণ করে যে কোন আয়ন কোন দিকে প্রবাহিত হবে এবং কোষের ভোল্টেজ কতটুকু পরিবর্তিত হবে।
বিভিন্ন আয়ন এর নিবৃত্তি বিভব
কোষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আয়ন থাকে, এবং তাদের প্রত্যেকের নিবৃত্তি বিভব আলাদা। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ন এবং তাদের নিবৃত্তি বিভব দেওয়া হলো:
আয়ন | নিবৃত্তি বিভব (mV) |
---|---|
সোডিয়াম (Na+) | +60 |
পটাশিয়াম (K+) | -90 |
ক্লোরাইড (Cl-) | -70 |
ক্যালসিয়াম (Ca2+) | +120 |
এই টেবিল থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সোডিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের নিবৃত্তি বিভব পজিটিভ, যার মানে হলো এই আয়নগুলো কোষের ভিতরে প্রবেশ করতে চায়। অন্যদিকে, পটাশিয়াম এবং ক্লোরাইডের নিবৃত্তি বিভব নেগেটিভ, যার মানে হলো এই আয়নগুলো কোষ থেকে বাইরে যেতে চায়।
নিবৃত্তি বিভবের উপর প্রভাব বিস্তারকারী কারণ
কিছু জিনিস আছে যা নিবৃত্তি বিভবের মানকে প্রভাবিত করতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- আয়ন ঘনত্ব (Ion Concentration): কোষের ভিতরে এবং বাইরের আয়ন ঘনত্বের পরিবর্তন হলে নিবৃত্তি বিভবের মান পরিবর্তিত হয়। যদি কোনো কারণে কোষের ভেতরে সোডিয়ামের ঘনত্ব বেড়ে যায়, তাহলে সোডিয়ামের নিবৃত্তি বিভবও বেড়ে যাবে।
- তাপমাত্রা (Temperature): তাপমাত্রা বাড়লে আয়নগুলোর গতি বেড়ে যায়, যার ফলে নিবৃত্তি বিভবের মানও পরিবর্তিত হতে পারে। নার্নস্ট সমীকরণে তাপমাত্রার প্রভাব সরাসরি দেখা যায়।
- মেমব্রেন ভেদ্যতা (Membrane Permeability): কোষ ঝিল্লির ভেদ্যতা পরিবর্তন হলে, অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট আয়ন কত সহজে কোষের ভিতরে বা বাইরে যেতে পারছে, তার উপরও নিবৃত্তি বিভব নির্ভর করে।
নিবৃত্তি বিভব নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
এখানে নিবৃত্তি বিভব নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাদের মনে প্রায়ই আসতে পারে:
নিবৃত্তি বিভব কি সবসময় স্থির থাকে?
না, নিবৃত্তি বিভব সবসময় স্থির থাকে না। এটি কোষের অবস্থা, আয়ন ঘনত্ব এবং তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে৷
অ্যাকশন পোটেনশিয়ালের জন্য নিবৃত্তি বিভব কেন গুরুত্বপূর্ণ?
অ্যাকশন পোটেনশিয়ালের সময় আয়ন চ্যানেলগুলো খোলে এবং বন্ধ হয়, যা কোষের মেমব্রেন পোটেনশিয়ালকে পরিবর্তন করে। নিবৃত্তি বিভব নির্ধারণ করে কোন আয়ন কোন দিকে প্রবাহিত হবে এবং কতটুকু ভোল্টেজ পরিবর্তন হবে।
নার্নস্ট সমীকরণ কিভাবে নিবৃত্তি বিভব বের করতে সাহায্য করে?
নার্নস্ট সমীকরণ ব্যবহার করে কোষের ভিতরে এবং বাইরের আয়নগুলোর ঘনত্ব এবং চার্জ জেনে নিবৃত্তি বিভবের মান বের করা যায়।
নিবৃত্তি বিভবের পরিবর্তন কি রোগের লক্ষণ হতে পারে?
হ্যাঁ, কিছু রোগের ক্ষেত্রে নিবৃত্তি বিভবের পরিবর্তন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মৃগীরোগে (epilepsy) মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষগুলোর নিবৃত্তি বিভবে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা যায়।
নিবৃত্তি বিভব এবং বিশ্রাম পোটেনশিয়াল (resting potential) এর মধ্যে পার্থক্য কী?
বিশ্রাম পোটেনশিয়াল হলো যখন কোষ শান্ত অবস্থায় থাকে (অর্থাৎ, কোনো সংকেত পাঠাচ্ছে না), তখন তার ঝিল্লির ভোল্টেজ। অন্যদিকে, নিবৃত্তি বিভব হলো একটি বিশেষ আয়নের জন্য সেই ভোল্টেজ যেখানে সেই আয়নের নেট প্রবাহ শূন্য। বিশ্রাম পোটেনশিয়াল বিভিন্ন আয়নের নিবৃত্তি বিভবের সম্মিলিত প্রভাবের কারণে তৈরি হয়।
যদি কোনো কারণে কোষের পটাশিয়াম আয়ন এর ঘনত্ব কমে যায়, তাহলে নিবৃত্তি বিভবের কি পরিবর্তন হবে?
যদি কোষের বাইরের দিকে পটাশিয়ামের ঘনত্ব কমে যায়, তাহলে পটাশিয়ামের নিবৃত্তি বিভব আরও নেগেটিভ হবে। কারণ, নার্নস্ট সমীকরণ অনুযায়ী, বাইরের আয়নের ঘনত্ব কম হলে নিবৃত্তি বিভবের মান কমে যায়।
নিবৃত্তি বিভব কি শুধুমাত্র স্নায়ু কোষের জন্য প্রযোজ্য?
যদিও স্নায়ু কোষের ক্ষেত্রে নিবৃত্তি বিভবের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়, তবে এটি অন্যান্য কোষ যেমন পেশী কোষ এবং গ্রন্থি কোষের (gland cells) জন্যও প্রযোজ্য। যেকোনো কোষে যেখানে আয়নের প্রবাহ আছে, সেখানেই নিবৃত্তি বিভব একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা।
আশা করি এই প্রশ্নগুলো আপনাদের আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে।
উপসংহার
তাহলে, নিবৃত্তি বিভব (reversal potential) নিয়ে আমাদের আলোচনা আজ এখানেই শেষ। এটা সত্যিই খুব মজার একটা বিষয়, তাই না?
আমরা দেখলাম, কিভাবে এই বিভব কোষের সংকেত পরিবহনে, রোগ নির্ণয়ে, এমনকি ওষুধ তৈরিতেও কাজে লাগে। নার্নস্ট সমীকরণ আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে এই বিভবের মান বের করতে হয়।
যদি আপনি বিজ্ঞান ভালোবাসেন, তাহলে এই বিষয়গুলো আপনার জন্য আরও অনেক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। আপনার যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানান।
আজকের মতো বিদায়। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন!