শুরু করা যাক!
প্রাচীন ইতিহাসে ডুব দিতে চান? এমন এক শহরের গল্প শুনবেন, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ? যেখানে সম্রাট আর তার পারিষদবর্গের শ্বাস-প্রশ্বাস চলত একচ্ছত্র আধিপত্যে? তাহলে আজকের আলোচনা আপনার জন্য। আমরা কথা বলব সেই শহর নিয়ে, যাকে বলা হয় নিষিদ্ধ শহর। আসুন, জেনে নিই “নিষিদ্ধ শহর বলা হয় কাকে” এবং এর পেছনের রহস্য।
নিষিদ্ধ শহর: ইতিহাসের এক ঝলক
নিষিদ্ধ শহর (Forbidden City) চীনের বেইজিং-এ অবস্থিত। ১৪২০ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত এটি ছিল চীনের সম্রাটদের বাসভবন এবং রাজনৈতিক কেন্দ্র। প্রায় ৫০০ বছর ধরে এটি মিং এবং কিং রাজবংশের সম্রাটদের আবাসস্থল ছিল। সাধারণ মানুষ বা অনুমতি ছাড়া অন্য কারো এই শহরে প্রবেশের অধিকার ছিল না। তাই এর নাম হয় “নিষিদ্ধ শহর”।
নিষিদ্ধ শহরের স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী
নিষিদ্ধ শহরের স্থাপত্য সত্যিই অসাধারণ। এর নির্মাণশৈলীতে চীনা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সুস্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:
- আয়তন: প্রায় ১৮০ একর জমির উপর নির্মিত এই শহরে ৯৮০টি ভবন এবং ৮,৭০০টি কক্ষ রয়েছে।
- প্রাচীর: প্রায় ১০ মিটার উঁচু এবং ৩,৪০০ মিটার দীর্ঘ একটি বিশাল প্রাচীর শহরটিকে ঘিরে রেখেছে।
- খুঁটি: এখানকার স্তম্ভগুলো মূল্যবান কাঠ দিয়ে তৈরি, যা দূরবর্তী প্রদেশ থেকে আনা হয়েছিল।
- রং: ভবনগুলোর ছাদে এবং দেয়ালে উজ্জ্বল লাল ও সোনালী রঙের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো, যা রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক।
নিষিদ্ধ শহরের ভেতরের জীবনযাত্রা
নিষিদ্ধ শহরের জীবনযাত্রা ছিল সম্রাট এবং তার পারিষদবর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখানে সম্রাট থাকতেন জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদে, আর তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকত অসংখ্য দাস-দাসী ও কর্মচারী।
- সম্রাটের দিনলিপি: সম্রাটের প্রতিটি দিন শুরু হতো কঠোর নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে। তিনি দিনের অনেকটা সময় কাটাতেন রাষ্ট্রীয় কাজে, দরবারে কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করতেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন।
- ** হারেমের জীবন:** সম্রাটের হারেমে থাকতেন অসংখ্য উপপত্নী, যাদের জীবন ছিল প্রাচুর্যে ভরা, কিন্তু তারা সম্রাটের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিলেন।
- কর্মচারী ও দাস-দাসী: নিষিদ্ধ শহরে কর্মরত কর্মচারী ও দাস-দাসীদের জীবন ছিল অত্যন্ত কঠিন। তারা সম্রাটের সেবায় সর্বদা নিয়োজিত থাকতেন এবং সামান্য ভুল ত্রুটির জন্য কঠোর শাস্তি পেতেন।
নিষিদ্ধ শহরের ইতিহাস
নিষিদ্ধ শহরের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ এবং আকর্ষণীয়। ১৪০৬ সালে মিং সাম্রাজ্যের সম্রাট ইয়ংলো এর নির্মাণ শুরু করেন, যা ১৪২০ সালে শেষ হয়। নির্মাণের পর থেকে এটি চীনের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
নিষিদ্ধ শহরের নির্মাণ
এই বিশাল স্থাপত্য তৈরি করতে ১৪ বছর সময় লেগেছিল। নির্মাণকাজে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কারিগর ও শিল্পী অংশ নিয়েছিলেন। পাথর, কাঠসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
বিভিন্ন রাজবংশের শাসন
মিং রাজবংশের পর কিং রাজবংশও এই শহর থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করে। প্রতিটি রাজবংশই নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী শহরের কিছু অংশে পরিবর্তন ও সংস্কার করে।
নিষিদ্ধ শহরের আধুনিকীকরণ
১৯১২ সালে চীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নিষিদ্ধ শহরের গুরুত্ব কমতে থাকে। ১৯২৫ সালে এটিকে একটি জাদুঘর হিসেবে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে এটি চীনের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
নিষিদ্ধ শহর কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
নিষিদ্ধ শহর শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এটি চীনের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক। এর গুরুত্বের কয়েকটি দিক নিচে উল্লেখ করা হলো:
- রাজনৈতিক কেন্দ্র: প্রায় ৫০০ বছর ধরে এটি চীনের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল। এখান থেকেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো এবং সম্রাটরা দেশ শাসন করতেন।
- সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য: নিষিদ্ধ শহর চীনা সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এর স্থাপত্য, শিল্পকর্ম ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো চীনা ঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে।
- পর্যটন কেন্দ্র: বর্তমানে এটি চীনের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এই ঐতিহাসিক শহরটি দেখতে আসেন।
নিষিদ্ধ শহর নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- শোনা যায়, নিষিদ্ধ শহরের নকশা তৈরি করেছিলেন লিউ বোয়ান নামের এক স্থপতি, যিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ।
- শহরের দেয়ালগুলো বিশেষ ধরনের মর্টার দিয়ে তৈরি, যা ডিমের সাদা অংশ, চুন এবং অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে বানানো হয়েছিল। এটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, বহু বছর ধরে টিকে আছে।
- নিষিদ্ধ শহরের ভেতরের ফোয়ারাগুলোতে পানি গরম করার জন্য জটিল হিটিং সিস্টেম ব্যবহার করা হতো, যা সেই সময়ের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের প্রমাণ দেয়।
নিষিদ্ধ শহর পরিদর্শনের টিপস
যদি আপনি নিষিদ্ধ শহর পরিদর্শনে যেতে চান, তাহলে কিছু টিপস আপনার জন্য:
- সেরা সময়: এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পরিদর্শনের জন্য সেরা। এই সময়ে আবহাওয়া সাধারণত ভালো থাকে।
- টিকেট: আগে থেকে অনলাইনে টিকেট কেটে রাখলে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো এড়ানো যায়।
- পোশাক: হাঁটার জন্য আরামদায়ক জুতো পরুন, কারণ পুরো শহর ঘুরতে অনেক হাঁটতে হবে।
- গাইড: একজন গাইডের সাহায্য নিলে শহরের ইতিহাস ও স্থাপত্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
নিষিদ্ধ শহর সম্পর্কে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
এখানে নিষিদ্ধ শহর নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
নিষিদ্ধ শহর কোথায় অবস্থিত?
নিষিদ্ধ শহর চীনের বেইজিং-এ অবস্থিত। এটি বেইজিং শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত তিয়ানআনমেন স্কয়ারের কাছেই অবস্থিত।
নিষিদ্ধ শহরে কতগুলো কক্ষ আছে?
নিষিদ্ধ শহরে প্রায় ৮,৭০০টি কক্ষ রয়েছে। এই কক্ষগুলো বিভিন্ন প্রাসাদ, মন্দির ও অন্যান্য ভবনে বিস্তৃত।
নিষিদ্ধ শহরে কারা বাস করত?
নিষিদ্ধ শহরে চীনের সম্রাট, তার পরিবার এবং তাদের সেবায় নিয়োজিত কর্মচারী ও দাস-দাসীরা বাস করত। সাধারণ মানুষের এখানে প্রবেশের অনুমতি ছিল না।
নিষিদ্ধ শহর পরিদর্শনের সময়সূচী কি?
নিষিদ্ধ শহর সাধারণত সকাল ৮:৩০ থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে, নভেম্বরের শুরু থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ পর্যন্ত এটি বিকেল ৪:৩০ এ বন্ধ হয়ে যায়। সোমবার দিন এটি বন্ধ থাকে। টিকেট কাটার শেষ সময় সাধারণত বন্ধ হওয়ার ১ ঘণ্টা আগে পর্যন্ত থাকে।
নিষিদ্ধ শহরের স্থাপত্য শৈলী কেমন?
নিষিদ্ধ শহরের স্থাপত্য শৈলী চীনা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এর নকশা, নির্মাণশৈলী এবং রঙের ব্যবহার চীনা রাজকীয় আভিজাত্য ও সংস্কৃতির প্রতীক।
নিষিদ্ধ শহর: কেন একে নিষিদ্ধ বলা হত?
নিষিদ্ধ শহরকে “নিষিদ্ধ” বলার কারণ হলো, এখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। এটি শুধুমাত্র সম্রাট, তার পরিবার এবং বিশেষভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। বিনা অনুমতিতে কেউ প্রবেশ করলে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হতো। তাই এটি সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ ছিল।
নিষিদ্ধ শহরের রহস্য
নিষিদ্ধ শহরের দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। সম্রাটদের গোপন জীবন, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা—এসব নিয়েই তৈরি হয়েছে নানা গল্প। আজও ঐতিহাসিকরা সেই রহস্য উদঘাটনে কাজ করছেন।
ঐতিহাসিক ঘটনাবলী
এই শহরে ঘটে যাওয়া অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা চীনের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। মিং ও কিং রাজবংশের উত্থান-পতন, বিভিন্ন সম্রাটের জীবনকাহিনী এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তন—সবকিছুই এই শহরের সঙ্গে জড়িত।
কিংবদন্তী ও লোককথা
নিষিদ্ধ শহর নিয়ে অনেক কিংবদন্তী ও লোককথা প্রচলিত আছে। শোনা যায়, এখানে নাকি সোনার তৈরি একটি ড্রাগন লুকানো আছে, যা শহরের রক্ষাকর্তা। আবার কেউ বলেন, রাতের বেলা এখানে призрачные সম্রাটদের আনাগোনা দেখা যায়।
নিষিদ্ধ শহরের প্রভাব
নিষিদ্ধ শহর শুধু একটি ঐতিহাসিক স্থান নয়, এর প্রভাব চীনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে আজও বিদ্যমান।
সংস্কৃতির উপর প্রভাব
নিষিদ্ধ শহরের স্থাপত্য, শিল্পকর্ম ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো চীনা সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এর প্রভাব চীনা চিত্রকলা, সাহিত্য ও স্থাপত্যকলায় আজও দেখা যায়।
পর্যটনের উপর প্রভাব
নিষিদ্ধ শহর চীনের পর্যটন শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এখানে আসেন চীনের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে। এটি চীনের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
উপসংহার
নিষিদ্ধ শহর চীনের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এর স্থাপত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজও মানুষকে আকৃষ্ট করে। আপনি যদি ইতিহাস ও সংস্কৃতি ভালোবাসেন, তাহলে বেইজিং-এর এই নিষিদ্ধ শহর আপনার জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে। তাহলে আর দেরি কেন, সময় করে ঘুরে আসুন প্রাচ্যের এই রহস্যময় শহরে।
আশা করি, “নিষিদ্ধ শহর বলা হয় কাকে” এই প্রশ্নের উত্তর আপনারা খুঁজে পেয়েছেন। যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানতে চান, তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।