আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “নদীতীরে সূর্যাস্ত“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।
নদীতীরে সূর্যাস্ত
ভূমিকা : বিশ্বসৃষ্টির কোনো সুদূর অতীতে প্রকৃতির বুকে প্রথমে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত সংঘটিত হয়েছিল, অজানার অতল তলে সেই তথ্যটি চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে। তারও কত যুগ পরে মানুষের চোখে প্রথম প্রতিভাত হয়েছিল সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য। সেই তথ্যটিও আজ আর অবগত হওয়া সম্ভব নয়। তবে অতীতের সেই দূরতম দিনটিতে মানুষ যেমন ভোরের আলো ফোটার প্রথম লগ্নটিতে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিল, ঠিক তেমনি করে প্রদীপ্ত দিনের শেষে সূর্যাস্তের অতল দৃশ্যটিও তার চোখে ধরা দিয়েছিল অপরূপ হয়ে । তারপর কত লক্ষ কোটি বছর অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হয়েছে, কত বিচিত্র হয়েছে। একে একে বেড়ে গেছে পৃথিবীর বয়স, কিন্তু প্রকৃতি ঠিক তেমনি অমলিন রয়েছে। একই নিয়মে পৃথিবীর বুকে রচিত হচ্ছে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্যপট। আর সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ প্রকৃতির কাছে হাত পেতে কখনো নিরাশ হয়নি ।
সূর্যাস্তের দৃশ্য : শোভাময় নদীতীরে সূর্যাস্তের দৃশ্যও প্রকৃতির সৌন্দর্যভাণ্ডারে একটি অনন্য উপাদান । দিবসের অবসানে এ যেন বিদায় বেলার অনন্য উপহার। প্রকৃতি তার তৃষ্ণাকে তৃপ্ত করেছে অকৃপণ দানে । নদনদী, পর্বতমালা, বনরাজি, আকাশ, বৃক্ষলতা প্রকৃতির সমস্ত অংশেই ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি। নদীর বেগবান প্রবাহ, পর্বতমালার সীমাহীন বিস্তার, সূর্যদীপ্ত আকাশে পাখিদের উড়াউড়ি, ফুলের বর্ণশোভা, ছায়াচ্ছন্ন বনরাজির শ্যামল রূপ আরও কত সৌন্দর্য যে সে স্তরে স্তরে সাজিয়ে রেখেছে তার কোনো শেষ নেই, যেন এক অন্তহীন ঐশ্বর্যের অনিশেষ ভাণ্ডার । মানুষ দু চোখ ভরে সেই সৌন্দর্যকে অবলোকন করেছে। দিনের অবসানে সমস্ত কোলাহল শান্ত হয়ে এলে সূর্যের বিদায়ী রূপ তার চিত্তে জাগিয়েছে ধ্যান গম্ভীর শান্ত মহিমা ৷ প্রদীপ্ত সূর্য সারাদিন ধরে আলো ছড়ায় তারপর পশ্চিম আকাশে নেমে আসে অস্তবেলার মুহূর্ত, রক্তরাগ ছড়িয়ে পড়ে দিগন্ত থেকে দিগন্তে । নদীর ঊর্মিমুখর জলরাশিতে সেই রক্তরাগ অপূর্ব দৃশ্যপট রচনা করে, মনে হয় কে যেন নদীর বুকে রাশি রাশি সোনা ছড়িয়ে দিয়েছে। ঢেউয়ের দোলায় সেই তরল স্বর্ণপ্রবাহ এগিয়ে চলে সমুদ্র সংগ্রামে। তাই কবি বলেন-
“জ্বলিতেছে জল তরল অনল
গলিয়া পড়িছে অন্তরতলে দিক বধূ যেন ছল ছল আঁখি অশ্রুজলে।”
আকাশে তখন নীড়ে ফেরা পাখিরা পূর্বদিগন্তের দিকে চলে আসে। ধীরে ধীরে তারা পূর্বের আকাশে মিলিয়ে যায়। সমস্ত প্রকৃতি এসময় স্তব্ধতার প্রহর গোনে। নদীবক্ষে নিস্তরঙ্গ গতিবেগে নৌকাগুলো এগিয়ে চলে । মৃদুমন্দ হিল্লোলে বাতাস বয়ে যায় । প্রকৃতিতে নেমে আসে ক্লান্তি— নৌকার মাঝির মনে নামে এক গভীর অবসাদের ছায়া। ঠিক এ রকম মুহূর্তে ভাটির টানে ভেসে যেতে যেতে তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় সেই অবিনাশী গান—’মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না।’ গ্রামের বধূরা জল নিতে আসে নদীর ঘাটে—তাদের কাঁখের কলসিতে জলরাশি উচ্ছলিত হয়ে ওঠে।
সূর্যাস্তের পরে : ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ়তর হতে থাকে। আকাশ থেকে মিলিয়ে যেতে থাকে সোনালি আভা। তারপর এক সময় সূর্য অদৃশ্য হয়ে যায়। মনে হয় নদীর ঢেউগুলো যেন সেই অস্তগামী সূর্যকে ধরে রাখার জন্যে ব্যাগ্র বাহু মেলে এগিয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে উদ্দাম জলরাশির অতল তলে ডুবে যায় সেই রক্তিম গোলক। দূরে আম্রবীথিকার অন্তরালে পল্লিকুটিরে জ্বলে ওঠে সন্ধ্যাদীপের শিখা। কর্মক্লান্ত মানুষেরা তাদের গৃহাঙ্গনে ফিরে আসে। দিগন্তে অস্তমিত সূর্যের আভা জেগে থাকে আরও কিছুক্ষণ। | তারপর ধীরে ধীরে নেমে আসে স্তব্ধতার রাত । তখন—
“সন্ধ্যা তারা ধীরে
সন্তপর্ণে করে পদার্পণ নদী তীরে অরণ্যশিয়রে ।”
মনের বিচিত্র অনুভূতি : আমার এই অভিভূত মনোভাবের কত না বিচিত্র প্রকাশ ঘটে। মনে হয়, এই যে আমার জীবন, এর সার্থকতা কোথায়? নিজেকে বিচিত্রভাবে উপভোগ করে ছড়িয়ে বিশ্বকে জানতে হবে। কেবল তাই নয়, নিজেকেও উপলব্ধি করতে হবে। আমার প্রকাশ আমার চেনার মধ্যে ‘know thyself’, আর এজন্যেই বুঝি সূর্যাস্তের সৌন্দর্য আমাদের আনন্দ দেয়, মুগ্ধ করে। আর এ সুযোগ পাওয়ার বা করে নেওয়ার মধ্যেই তো জীবনের সার্থকতা। তাই আজ নদীর বেলাভূমির ওপর দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্যের বিচিত্র সৌন্দর্য দেখে আমার চোখ সার্থক, আমার হৃদয় অভিভূত, আমি ধন্য ।
আমার জীবনের পরিধি কতটুকু? মনে হয় কত না বিরাট বিশাল । আসলে কি তা ঠিক? মনে মনে তাই ভাবি, কূপের ব্যাঙের কাছে নদীর পরিচয় অর্থহীন। তাই বৃহতের কাছে যখন আসি তখন নিজের ক্ষুদ্রতা অনুভব করতে পারি, কূপমণ্ডূকতা ঘুচে যায়। আমার চেতনা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। মহৎ কিছু করার প্রেরণা পাই। নিজেকেও বড় করে গড়ে তোলতে প্রতিজ্ঞা করি । আর আমার সমস্ত গর্ব, আমার অহংকার ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। মনে হয় এই উত্তাল তরঙ্গসঙ্কুল নদী আর অন্তহীন আকাশ কি নিথর মৌন নদীর প্রতীক। সৃষ্টিকর্তার রহস্যের মহিমা বুঝতে পারছি না—কেবল অবাক বিস্ময়ে সূর্যাস্ত দেখেছি, দেখেছি সূর্যের কিরণ কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছে নদীর নীল পানিতে ।
আজ পূর্ণ হলো আমার দীর্ঘদিনের সাধ। আমার হৃদয় রাজ্যে কত ভাব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। আর তা প্রকাশ করার শক্তি এবং ভাষা কোনোটাই আমার নেই। অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের তো বর্ণনা হয় না, সে যে শুধু অনুভবের বিষয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, “যে নদীতীরের সূর্যাস্তের শোভা দেখে নি, সে পৃথিবীর কিছুই দেখে নি।” আজ নদী তীরে সূর্যাস্ত দেখার পর সেটাই আমি মর্মে মর্মে অনুভব করছি।
উপসংহার : নদীতীরে সূর্যাস্তের দৃশ্য গভীর ভাবব্যঞ্জনায় মণ্ডিত। অবসাদ এবং প্রশান্তিঘেরা এ দৃশ্য চিন্তালোকে এক অচিহ্নিত অনুভব সঞ্চারিত করে দেয়। ইংরেজ কবি বায়রন বলেছিলেন, “জীবনের সব সন্ধ্যাই অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়, তার মধ্যে কিছু সোনালি সন্ধ্যাও আসে।” নদীতীরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দর্শন করলেই একথার মর্ম পুরোপুরি অনুভব করা যায়। হৃদয়-মন তখন পূর্ণতার অনুভবে ভরে ওঠে। তাই নদীতীরের সূর্যাস্তের শোভা আমার জীবনের অক্ষয় সম্পদ হয়ে থাকবে ।
সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি আমাদের এই পোস্ট থেকে রচনা যেটি তুমি চাচ্ছিলে সেটি পেয়ে গিয়েছ। যদি তুমি আমাদেরকে কোন কিছু জানতে চাও বা এই রচনা নিয়ে যদি তোমার কোনো মতামত থাকে, তাহলে সেটি আমাদের কমেন্টে জানাতে পারো। আজকের পোস্টে এই পর্যন্তই, তুমি আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করে আমাদের বাকি পোস্ট গুলো দেখতে পারো।