আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা আলোচনা করব “অভিবাসী কাকে বলে” এই বিষয়টি নিয়ে। বিষয়টি অনেকের কাছে জটিল মনে হলেও, আমি চেষ্টা করব সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিতে। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
বর্তমানে, “অভিবাসী” শব্দটা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু এর আসল মানে কী? কারা এই অভিবাসী? কেনই বা তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায়? এই প্রশ্নগুলো আমাদের অনেকের মনেই ঘোরাফেরা করে। আজকের লেখায় আমি চেষ্টা করব এই বিষয়গুলো সহজভাবে বুঝিয়ে দিতে, যাতে আপনি অভিবাসন সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পান।
অভিবাসী: সহজ ভাষায় সংজ্ঞা
সহজ ভাষায়, অভিবাসী (immigrant) হলেন সেই ব্যক্তি যিনি নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য যান। শুধুমাত্র বেড়াতে যাওয়া বা অল্প কিছুদিনের জন্য কাজে যাওয়াকে অভিবাসন বলা হয় না। অভিবাসনের মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন দেশে বসবাস করা এবং সেখানে নিজের জীবন ও জীবিকা তৈরি করা।
অভিবাসন একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কেউ ভালো চাকরির আশায় দেশ ছাড়ে, আবার কেউ উন্নত জীবনযাপনের জন্য। এছাড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা শিক্ষার সুযোগের অভাবেও মানুষ অভিবাসী হতে বাধ্য হয়।
অভিবাসন কেন হয়? কারণগুলো কী?
অভিবাসনের পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। এই কারণগুলো সাধারণত অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত হয়ে থাকে। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো:
-
অর্থনৈতিক কারণ: ভালো চাকরি, বেশি বেতন, উন্নত জীবনযাত্রার আশায় মানুষ অন্য দেশে যায়। অনেক সময় নিজের দেশে কাজের সুযোগ কম থাকায় বিদেশে কাজের সন্ধান করা হয়।
-
সামাজিক কারণ: উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মানুষ অভিবাসী হয়। এছাড়া, পারিবারিক পুনর্মিলনও একটি বড় কারণ।
-
রাজনৈতিক কারণ: যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিপীড়ন বা জাতিগত সংঘাতের কারণে মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
- পরিবেশগত কারণ: প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, খরা বা বন্যার কারণে মানুষ তাদের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।
কারা অভিবাসী নয়?
সবাই কিন্তু অভিবাসী নন। কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষ অন্য দেশে গেলেও তাদের অভিবাসী বলা যায় না। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
-
পর্যটকেরা: যারা শুধুমাত্র বেড়ানোর উদ্দেশ্যে অন্য দেশে যান, তারা অভিবাসী নন। তারা নির্দিষ্ট সময় পর নিজের দেশে ফিরে আসেন।
-
অল্প সময়ের জন্য কাজের সূত্রে যাওয়া ব্যক্তি: যারা কোনো বিশেষ কাজের জন্য কিছুদিনের জন্য অন্য দেশে যান এবং কাজ শেষে ফিরে আসেন, তারাও অভিবাসী নন।
-
শিক্ষার্থীরা: যারা পড়াশোনার জন্য অন্য দেশে যান এবং পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসার পরিকল্পনা থাকে, তারাও অভিবাসী নন।
বিভিন্ন প্রকার অভিবাসী: প্রকারভেদ ও উদাহরণ
অভিবাসীদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, তাদের উদ্দেশ্য, থাকার মেয়াদ এবং আইনি অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
স্থায়ী অভিবাসী
स्थायी অভিবাসী (Permanent Immigrant) তারাই, যারা অন্য দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পান। এক্ষেত্রে, তারা সেই দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন এবং সবধরণের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন।
উদাহরণ: একজন ব্যক্তি যিনি আমেরিকাতে গ্রীন কার্ড পেয়েছেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, তিনি একজন স্থায়ী অভিবাসী।
অস্থায়ী অভিবাসী
অস্থায়ী অভিবাসী (Temporary Immigrant) নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অন্য দেশে বসবাসের অনুমতি পান। তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হলে নিজ দেশে ফিরে যেতে হয়।
উদাহরণ: কোনো ব্যক্তি যদি কাজের জন্য ৩ বছরের ভিসা নিয়ে জার্মানিতে যান, তবে তিনি একজন অস্থায়ী অভিবাসী।
শরণার্থী
শরণার্থী (Refugee) হলেন তারা, যারা যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা নিপীড়নের কারণে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তারা সাধারণত নিজেদের দেশে ফিরতে পারেন না যতক্ষণ না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
উদাহরণ: সিরিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে অনেক মানুষ জার্মানি ও অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা শরণার্থী হিসেবে পরিচিত।
আশ্রয়প্রার্থী
আশ্রয়প্রার্থী (Asylum Seeker) হলেন তারা, যারা অন্য দেশে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন এবং তাদের আবেদন এখনো প্রক্রিয়াকরণের অধীনে রয়েছে। তাদের শরণার্থী হিসেবে গণ্য করা হয় না যতক্ষণ না তাদের আবেদন মঞ্জুর হয়।
উদাহরণ: কোনো ব্যক্তি যদি বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে নিপীড়িত হয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয়ের আবেদন করেন, তবে তিনি আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
প্রকারভেদ | থাকার মেয়াদ | উদ্দেশ্য | উদাহরণ |
---|---|---|---|
স্থায়ী অভিবাসী | স্থায়ী | স্থায়ীভাবে বসবাস ও নাগরিকত্ব লাভ | গ্রীন কার্ডধারী আমেরিকান |
অস্থায়ী অভিবাসী | নির্দিষ্ট সময় | কাজ, পড়াশোনা বা অন্য কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য | ৩ বছরের ভিসা নিয়ে জার্মানিতে কর্মরত ব্যক্তি |
শরণার্থী | অনির্দিষ্টকাল (পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত) | যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা নিপীড়ন থেকে বাঁচা | সিরিয়ার শরণার্থী |
আশ্রয়প্রার্থী | আবেদন প্রক্রিয়াকরণের সময়কাল | আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা | রাজনৈতিক কারণে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশী |
অভিবাসন প্রক্রিয়া: ধাপে ধাপে গাইডলাইন
যদি আপনি অভিবাসী হওয়ার কথা ভাবছেন, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেনে রাখা দরকার। নিচে একটি সাধারণ গাইডলাইন দেওয়া হলো:
-
গন্তব্য নির্বাচন: প্রথমে ঠিক করুন আপনি কোন দেশে যেতে চান। সেই দেশের সুযোগ-সুবিধা, সংস্কৃতি এবং অভিবাসন নীতি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন।
-
ভিসার জন্য আবেদন: আপনার উদ্দেশ্য অনুযায়ী সঠিক ভিসার জন্য আবেদন করুন। ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের ওয়েবসাইট থেকে জানতে পারবেন।
-
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র: ভিসার আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যেমন পাসপোর্ট, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, কাজের অভিজ্ঞতা, আর্থিক প্রমাণ ইত্যাদি সংগ্রহ করুন।
-
ভাষা ও সংস্কৃতি: নতুন দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা নিন। এটি আপনাকে সেখানে সহজে মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
-
আবাসন ও চাকরি: যাওয়ার আগে সেখানে থাকার জায়গা এবং চাকরির সন্ধান করুন।
-
আইন ও নিয়মকানুন: নতুন দেশের আইন ও নিয়মকানুন সম্পর্কে জেনে সেগুলো মেনে চলুন।
অভিবাসনের সুবিধা ও অসুবিধা
অভিবাসনের যেমন অনেক সুবিধা আছে, তেমনি কিছু অসুবিধাও রয়েছে। নিচে উভয় দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো:
সুবিধা
-
উন্নত জীবনযাত্রা: অনেক দেশে উন্নত জীবনযাত্রা, ভালো স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ পাওয়া যায়।
-
অর্থনৈতিক সুযোগ: ভালো চাকরি এবং বেশি বেতনের সুযোগ থাকে, যা জীবনযাত্রার মান উন্নত করে।
-
সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা: নতুন সংস্কৃতি ও ভাষার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, যা ব্যক্তিগত উন্নয়ন ঘটায়।
- নতুন দক্ষতা অর্জন: বিদেশে কাজ করার মাধ্যমে নতুন দক্ষতা অর্জন করা যায়, যা কর্মজীবনে অনেক কাজে লাগে।
অসুবিধা
-
ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য: নতুন ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা হতে পারে।
-
পরিবার থেকে দূরে থাকা: পরিবার ও বন্ধুদের ছেড়ে অন্য দেশে একা থাকতে হতে পারে, যা মানসিক কষ্টের কারণ হতে পারে।
-
চাকরি খোঁজার সমস্যা: নতুন দেশে চাকরি খুঁজে পেতে সময় লাগতে পারে এবং শুরুতে কম বেতনে কাজ করতে হতে পারে।
- বৈষম্য ও কুসংস্কার: অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্য ও কুসংস্কারের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অভিবাসন নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
অভিবাসন নিয়ে অনেকের মনেই অনেক প্রশ্ন থাকে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. অবৈধ অভিবাসী কারা?
যাদের বৈধ ভিসা বা অনুমতি নেই, অথবা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যারা কোনো দেশে অবৈধভাবে বসবাস করেন, তারাই অবৈধ অভিবাসী।
২. দ্বৈত নাগরিকত্ব কি বৈধ?
কিছু দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ আছে, আবার কিছু দেশে নেই৷ তাই, অভিবাসন করার আগে এই বিষয়ে জেনে নেওয়া ভালো।
৩. অভিবাসন কি দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে?
অবশ্যই। দক্ষ অভিবাসীরা অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। তারা নতুন ব্যবসা শুরু করতে পারে, কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন দক্ষতা নিয়ে আসতে পারে।
৪. “রিফিউজি” এবং “মাইগ্রেন্ট”-এর মধ্যে পার্থক্য কী?
রিফিউজি (Refugee) হলেন তারা, যারা যুদ্ধ বা নিপীড়নের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য। অন্যদিকে, মাইগ্রেন্ট (Migrant) শব্দটি সাধারণ অর্থে যে কোনো ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বসবাস বা কাজের জন্য যান।
৫. কোন দেশগুলো অভিবাসনের জন্য সেরা?
এটা নির্ভর করে আপনার ব্যক্তিগত চাহিদা ও পছন্দের ওপর। তবে, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং সুইডেন সাধারণত অভিবাসীদের জন্য ভালো সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে।
অভিবাসন: কিছু দরকারি পরামর্শ
অভিবাসন একটি বড় সিদ্ধান্ত। তাই, তাড়াহুড়ো না করে সবকিছু ভালোভাবে জেনে সিদ্ধান্ত নিন। নিচে কিছু দরকারি পরামর্শ দেওয়া হলো:
-
গবেষণা করুন: যে দেশে যেতে চান, সেই দেশের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আইন ও নিয়মকানুন সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন।
-
ভাষা শিখুন: গন্তব্য দেশের ভাষা শেখাটা খুবই জরুরি। এটি আপনাকে স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ করতে এবং সহজে মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
-
আর্থিক প্রস্তুতি: বিদেশে যাওয়ার আগে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করুন। নতুন দেশে গিয়ে শুরুতে খরচ করার জন্য এবং অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকুন।
-
যোগাযোগ তৈরি করুন: বিদেশে বসবাস করা বাংলাদেশী বা অন্যান্য পরিচিত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করুন। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু জানতে পারবেন।
-
মানসিক প্রস্তুতি: নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার সাথে মানিয়ে নিতে মানসিক প্রস্তুতি নিন। ধৈর্য ধরুন এবং ইতিবাচক মনোভাব রাখুন।
উপসংহার
“অভিবাসী কাকে বলে” – আশা করি আজকের আলোচনা থেকে আপনি এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন। অভিবাসন একটি জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব দিক বিবেচনা করা উচিত। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে জিজ্ঞাসা করতে দ্বিধা করবেন না। আপনার সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য শুভকামনা রইল!