ধরুন, আপনি আপনার প্রিয় গ্রামের পুকুরপাড়ে বসে আছেন, আর ভাবছেন, “আচ্ছা, যদি আমি এই পুকুরটা ছেড়ে একটু দূরে, হয়তো পাশের শহরে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করি, তাহলে কেমন হয়?” এই ভাবনাটাই কিন্তু অভিবাসনের একটা ছোট উদাহরণ। তাহলে চলুন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা বিস্তারিতভাবে জেনে নিই অভিবাসন (Migration) আসলে কী, কেন মানুষ এটা করে, আর এর ভালো-মন্দ দিকগুলোই বা কী কী!
অভিবাসন কী? (What is Migration?)
সহজ ভাষায়, অভিবাসন মানে হলো মানুষ যখন নিজের বসবাসের স্থান পরিবর্তন করে অন্য কোনো নতুন স্থানে গিয়ে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এই “বসবাসের স্থান পরিবর্তন” হতে পারে দেশের ভেতরে এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে।
অভিবাসন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। মানুষ যুগ যুগ ধরে ভালো জীবনের আশায়, নতুন সুযোগের সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেছে। কেউ যায় উন্নত শিক্ষা বা ভালো চাকরির আশায়, কেউবা আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বাঁচতে।
অভিবাসনের প্রকারভেদ (Types of Migration)
অভিবাসন নানা ধরনের হতে পারে। এদের মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:
-
অভ্যন্তরীণ অভিবাসন (Internal Migration): যখন দেশের ভেতরেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষ বসবাস করতে যায়, তখন তাকে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন বলে। যেমন, গ্রামের মানুষ কাজের জন্য শহরে আসা।
-
আন্তর্জাতিক অভিবাসন (International Migration): যখন মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করে, তখন তাকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন বলে। যেমন, বাংলাদেশ থেকে অনেকে কাজের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে যান, আবার অনেকে উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপ বা আমেরিকাতেও যান।
-
স্বেচ্ছায় অভিবাসন (Voluntary Migration): যখন মানুষ নিজের ইচ্ছায় এবং ভালো সুযোগের আশায় অভিবাসন করে, তখন তাকে স্বেচ্ছায় অভিবাসন বলে।
- বাধ্যতামূলক অভিবাসন (Forced Migration): যখন কোনো দুর্যোগ, যুদ্ধ, বা রাজনৈতিক কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য স্থানে আশ্রয় নেয়, তখন তাকে বাধ্যতামূলক অভিবাসন বলে।
কেন মানুষ অভিবাসন করে? (Why do People Migrate?)
মানুষ বিভিন্ন কারণে অভিবাসন করে থাকে। এর পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ আলোচনা করা হলো:
-
অর্থনৈতিক কারণ (Economic Reasons): ভালো চাকরি, বেশি বেতন, উন্নত জীবনযাত্রার আশায় মানুষ অভিবাসন করে। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে এই ধরনের অভিবাসন বেশি দেখা যায়।
-
সামাজিক কারণ (Social Reasons): ভালো শিক্ষা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়।
-
রাজনৈতিক কারণ (Political Reasons): রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, বা নিপীড়নের কারণে মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
- পরিবেশগত কারণ (Environmental Reasons): প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ বাস্তুহারা হয়ে অন্য স্থানে চলে যায়।
অভিবাসনের কারণ ও প্রভাব (Causes and Effects of Migration)
অভিবাসন একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর কারণ যেমন অনেক, তেমনি এর প্রভাবও সুদূরপ্রসারী।
অভিবাসনের কারণসমূহ (Causes of Migration):
অভিবাসন কেন ঘটে, তার কিছু মূল কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব (Lack of Economic Opportunities):
গ্রাম বা মফস্বল শহরে ভালো কাজের সুযোগের অভাব থাকলে মানুষ উন্নত ভবিষ্যতের আশায় শহরে পাড়ি জমায়।
শিক্ষার সুযোগের অভাব (Lack of Educational Opportunities):
উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য অনেক শিক্ষার্থীকে দেশের বাইরে বা বড় শহরে যেতে হয়, যেখানে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুবিধা রয়েছে।
উন্নত জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষা (Desire for a Better Lifestyle):
একটি উন্নত জীবন, যেখানে ভালো স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন এবং আধুনিক সব সুবিধা রয়েছে, এমন আকাঙ্ক্ষা মানুষকে অভিবাসনে উৎসাহিত করে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাত (Political Instability and Conflict):
যুদ্ধ, রাজনৈতিক সংঘাত বা জাতিগত নিপীড়নের কারণে মানুষ জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ (Natural Disasters):
বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ ঘরবাড়ি হারালে নতুন জীবন শুরু করার জন্য অন্য স্থানে চলে যায়।
অভিবাসনের ইতিবাচক প্রভাব (Positive Effects of Migration):
অভিবাসনের কিছু ভালো দিকও রয়েছে। সেগুলো হলো:
রেমিটেন্স বৃদ্ধি (Increased Remittance):
বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা দেশে টাকা পাঠালে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। এই রেমিটেন্স দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি (Job Creation):
অভিবাসনের ফলে নতুন নতুন শিল্প ও ব্যবসার সৃষ্টি হয়, যা স্থানীয় মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে।
জ্ঞান ও সংস্কৃতির আদান-প্রদান (Exchange of Knowledge and Culture):
বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার মানুষের মধ্যে মেলামেশার সুযোগ তৈরি হয়, যা জ্ঞান এবং সংস্কৃতির আদান-প্রদানে সাহায্য করে।
জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন (Improvement of Living Standards):
অভিবাসীরা সাধারণত তাদের নিজ দেশে পরিবারের জন্য ভালো জীবনযাত্রার সুযোগ তৈরি করে, যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাহায্য করে।
অভিবাসনের নেতিবাচক প্রভাব (Negative Effects of Migration):
কিছু খারাপ দিকও রয়েছে, যা আমাদের জানা দরকার।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি (Population Growth):
শহরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি হয়, যা পরিবেশ ও জীবনযাত্রার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
বস্তি সমস্যা (Slum Problems):
শহরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়লে বস্তি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
সামাজিক বৈষম্য (Social Inequality):
অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই চাকরি বা ভালো কাজের সুযোগ না পেয়ে হতাশায় ভোগে, যা সমাজে বৈষম্য বাড়ায়।
অপরাধ বৃদ্ধি (Increased Crime Rate):
বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়লে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়ে যায়।
অভিবাসন এবং বাংলাদেশ (Migration and Bangladesh)
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে যায়। এদের মধ্যে কেউ শ্রমিক, কেউ শিক্ষার্থী, আবার কেউ ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই অভিবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অভিবাসন (Migration in the Context of Bangladesh)
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কাজের জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। বিশেষ করে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। এছাড়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতেও অনেক বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
অভ্যন্তরীণ অভিবাসন (Internal Migration):
বাংলাদেশের শহরগুলোতে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে, গ্রামের মানুষেরা কাজের সন্ধানে আসে। এর ফলে শহরগুলোর ওপর জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে, যা নানা সমস্যা তৈরি করছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন (International Migration):
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বহু লোক কাজের জন্য বিদেশে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই ভালো বেতন এবং উন্নত জীবনযাত্রার আশায় যায়।
অভিবাসন সংক্রান্ত কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (Frequently Asked Questions – FAQs)
অভিবাসন নিয়ে আপনাদের মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। তাই নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. “অভিবাসন কাকে বলে?” – এই প্রশ্নের সহজ উত্তর কী?
সহজ উত্তর হলো, যখন কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়ে বসবাস শুরু করে, তখন তাকে অভিবাসন বলে।
২. “অভিবাসন কত প্রকার?” – প্রকারভেদগুলো কী কী?
অভিবাসন প্রধানত দুই প্রকার: অভ্যন্তরীণ অভিবাসন (দেশের ভেতরে) এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন (এক দেশ থেকে অন্য দেশে)। এছাড়া, স্বেচ্ছায় অভিবাসন ও বাধ্যতামূলক অভিবাসনও রয়েছে।
৩. “অভিবাসনের কারণগুলো কী?” – প্রধান কয়েকটি কারণ উল্লেখ করুন।
প্রধান কারণগুলো হলো অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, ভালো শিক্ষার সুযোগের অভাব, উন্নত জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
৪. “অভিবাসনের ফলে কী কী সমস্যা হতে পারে?” – কয়েকটি সমস্যা আলোচনা করুন।
অভিবাসনের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বস্তি সমস্যা, সামাজিক বৈষম্য এবং অপরাধের মতো সমস্যা হতে পারে।
৫. “অভিবাসনের ইতিবাচক দিকগুলো কী?” – কয়েকটি উদাহরণ দিন।
অভিবাসনের ইতিবাচক দিকগুলো হলো রেমিটেন্স বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জ্ঞান ও সংস্কৃতির আদান-প্রদান এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন।
৬. “অভিবাসন কি খারাপ?” – একটি নিরপেক্ষ মতামত দিন।
অভিবাসন সবসময় খারাপ নয়। এটা নির্ভর করে কেন এবং কীভাবে অভিবাসন হচ্ছে তার ওপর। সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অভিবাসনের খারাপ দিকগুলো কমিয়ে আনা সম্ভব।
৭. “অভিবাসন কমাতে কী করা যায়?”
অভিবাসন কমাতে হলে নিজ এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে এবং জীবনযাত্রার সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
অভিবাসন: একটি চলমান প্রক্রিয়া (Migration: An Ongoing Process)
অভিবাসন একটি চলমান প্রক্রিয়া। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেছে। সময়ের সাথে সাথে এর কারণ এবং ধরণে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়া আজও চলছে।
আমাদের উচিত অভিবাসনের কারণগুলো বোঝা এবং এর ভালো ও খারাপ দিকগুলো বিবেচনা করে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া। তাহলেই আমরা অভিবাসনকে একটি ইতিবাচক দিকে পরিচালিত করতে পারব।
লেখকের শেষ কথা
আশা করি, আজকের ব্লগ পোস্টটি থেকে আপনারা “অভিবাসন কাকে বলে” এবং এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। অভিবাসন একটি জটিল বিষয়, তবে সঠিক জ্ঞান এবং সচেতনতার মাধ্যমে আমরা এর সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে পারি এবং অসুবিধাগুলো কমিয়ে আনতে পারি। যদি আপনার এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। ধন্যবাদ!