শুরু করা যাক!
আচ্ছা, কখনও কি ভেবেছেন, কেন আপেল গাছ থেকে পড়লে সোজা মাটিতেই এসে পরে? কেন আকাশে ছুড়ে মারা বলটা আবার আপনার হাতেই ফিরে আসে? এর পেছনে রয়েছে এক অদৃশ্য শক্তি, যার নাম অভিকর্ষ। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা অভিকর্ষ (Gravity) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
যদি সহজ ভাষায় বলি, অভিকর্ষ হচ্ছে সেই শক্তি যা প্রতিটি বস্তুকে একে অপরের দিকে টানে। আপনার আর আমার মধ্যেও অভিকর্ষ বল কাজ করছে, তবে সেটা এতটাই সামান্য যে আমরা টের পাই না। কিন্তু পৃথিবী অনেক বড় আর ভারী, তাই এর অভিকর্ষ বল অনেক বেশি শক্তিশালী।
অভিকর্ষ কী? (What is Gravity?)
অভিকর্ষ হলো মহাবিশ্বের সেই সর্বজনীন আকর্ষণীয় শক্তি, যা দুটি বস্তুকে একে অপরের দিকে টানে। এই আকর্ষণীয় বল বস্তুর ভরের (mass) উপর নির্ভর করে। ভর যত বেশি, আকর্ষণ তত বেশি।
ভর ও অভিকর্ষের সম্পর্ক
ভর (Mass) কোনো বস্তুর মধ্যে থাকা পদার্থের পরিমাণ। যে বস্তুর ভর বেশি, তার অভিকর্ষ বলও বেশি। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীর ভর চাঁদের চেয়ে অনেক বেশি, তাই পৃথিবীর অভিকর্ষ বলও বেশি।
অভিকর্ষ কীভাবে কাজ করে?
অভিকর্ষ বল সবসময় দুটি বস্তুর মধ্যে কাজ করে। এই বলের কারণে পৃথিবী তার চারপাশে সবকিছুকে ধরে রাখে। শুধু তাই নয়, এই বলের কারণেই চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে এবং পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে।
অভিকর্ষের ইতিহাস (History of Gravity)
অভিকর্ষের ধারণা কিন্তু একদিনে আসেনি। বহু বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রম আর গবেষণার ফলে আমরা আজ এটা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। চলুন, ইতিহাসের কিছু ঝলক দেখে আসি:
প্রাচীন ধারণা
প্রাচীনকালে মানুষ মনে করত, সবকিছুই কোনো ঐশ্বরিক শক্তির কারণে ঘটছে। তারা অভিকর্ষের আসল কারণ বুঝতে পারেনি।
নিউটনের অবদান (Newton’s Contribution)
স্যার আইজ্যাক নিউটন প্রথম ব্যক্তি যিনি অভিকর্ষ নিয়ে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেন। ১৬৮৭ সালে তার “Principia Mathematica” গ্রন্থে তিনি মহাকর্ষীয় সূত্র (Law of Universal Gravitation) প্রকাশ করেন। এই সূত্র অনুযায়ী, দুটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণীয় বল তাদের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। সহজভাবে বললে, বস্তু যত ভারী হবে, তাদের মধ্যে আকর্ষণ তত বেশি হবে, আর তাদের মধ্যে দূরত্ব যত বাড়বে, আকর্ষণ তত কমবে।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (Einstein’s Theory of Relativity)
নিউটনের সূত্র অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক ফলাফল দিলেও, কিছু ক্ষেত্রে এটি যথেষ্ট ছিল না। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আলবার্ট আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (Theory of Relativity) দিয়ে অভিকর্ষের একটি নতুন ধারণা দেন। আইনস্টাইন বলেন, অভিকর্ষ কোনো বল নয়, বরং স্থান-কালের বক্রতা (curvature of space-time)। তার মতে, কোনো ভারী বস্তু স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়, এবং এর ফলে অন্য বস্তুগুলো সেই বক্র পথে চলতে বাধ্য হয়।
অভিকর্ষের প্রভাব (Effects of Gravity)
আমাদের জীবনে অভিকর্ষের প্রভাব অনেক। এটা না থাকলে আমাদের জীবনযাত্রা কেমন হতো, তা কল্পনাও করা যায় না। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আলোচনা করা হলো:
পৃথিবীর আকর্ষণ
পৃথিবীর অভিকর্ষের কারণে আমরা ভূপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। এটি আমাদের চারপাশে সবকিছুকে ধরে রেখেছে। যদি অভিকর্ষ না থাকত, তাহলে আমরা সবাই মহাশূন্যে ভেসে বেড়াতাম!
জোয়ার-ভাটা (Tides)
চাঁদের অভিকর্ষ বলের কারণে সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা হয়। চাঁদ পৃথিবীকে আকর্ষণ করে, ফলে সমুদ্রের জল ফুলে ওঠে। যখন চাঁদ সরে যায়, তখন জল নেমে যায়।
গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথ (Orbit of Planets)
সূর্যের অভিকর্ষের কারণে পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলো একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্যের চারপাশে ঘোরে। যদি সূর্যের অভিকর্ষ না থাকত, তাহলে গ্রহগুলো মহাশূন্যে ছিটকে যেত।
অভিকর্ষ এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবন (Gravity and Our Daily Life)
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অভিকর্ষের প্রভাব অনেক বেশি। হয়তো আমরা সবসময় এটা নিয়ে ভাবি না, কিন্তু এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নিয়ন্ত্রণ করে।
হাঁটাচলা এবং দৌড়ানো
অভিকর্ষের কারণেই আমরা মাটিতে পা রেখে হাঁটতে বা দৌড়াতে পারি। এটি আমাদের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
খাবার গ্রহণ
আমরা যখন খাবার খাই, তখন অভিকর্ষের কারণেই তা আমাদের পাকস্থলীতে পৌঁছায়। যদি অভিকর্ষ না থাকত, তাহলে খাবার আমাদের মুখেই আটকে থাকত!
খেলাধুলা
ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলার ওপর অভিকর্ষের প্রভাব রয়েছে। খেলোয়াড়দের বল ছোড়া, লাফানো এবং সবকিছুতেই অভিকর্ষ কাজ করে। ক্রিকেট ম্যাচে ব্যাটসম্যান যখন ছক্কা মারে, তখন বলটি অভিকর্ষের টানেই আবার মাটিতে নেমে আসে।
অভিকর্ষ নিয়ে কিছু মজার তথ্য (Fun Facts About Gravity)
- পৃথিবীর সব জায়গায় অভিকর্ষের মান সমান নয়। মেরু অঞ্চলে অভিকর্ষের মান সবচেয়ে বেশি, আর বিষুব রেখায় সবচেয়ে কম।
- মহাশূন্যে নভোচারীরা ভরশূন্য অনুভব করেন, কারণ সেখানে তারা পৃথিবীর অভিকর্ষ ক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে থাকেন।
- চাঁদে অভিকর্ষ পৃথিবীর প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ। তাই চাঁদে কোনো জিনিস তুললে সেটা পৃথিবীর চেয়ে ছয়গুণ হালকা মনে হয়।
অভিকর্ষের ব্যতিক্রম (Exceptions of Gravity)
যদিও অভিকর্ষ একটি সর্বজনীন শক্তি, কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়।
মহাশূন্যের শূন্য অভিকর্ষ (Zero Gravity in Space)
মহাশূন্যে, নভোচারীরা প্রায়শই “শূন্য অভিকর্ষ” অনুভব করেন। এর মানে এই নয় যে সেখানে অভিকর্ষ নেই, বরং তারা একটি ক্রমাগত পতনশীল অবস্থায় থাকেন।
ব্ল্যাক হোলের অভিকর্ষ (Gravity of Black Holes)
ব্ল্যাক হোল হলো মহাবিশ্বের এমন একটি স্থান, যেখানে অভিকর্ষ এতটাই শক্তিশালী যে আলো পর্যন্ত পালাতে পারে না।
অভিকর্ষ নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (Frequently Asked Questions – FAQs)
অভিকর্ষ নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
অভিকর্ষ কী দিয়ে তৈরি?
অভিকর্ষ কোনো বস্তু দিয়ে তৈরি নয়, এটি একটি শক্তি। এই শক্তি প্রতিটি বস্তুকে একে অপরের দিকে টানে।
পৃথিবীর অভিকর্ষ কত?
পৃথিবীর অভিকর্ষের গড় মান প্রায় ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড² (9.8 m/s²)। এর মানে হলো, কোনো বস্তুকে ছেড়ে দিলে সেটি প্রতি সেকেন্ডে ৯.৮ মিটার করে নিচের দিকে পড়তে থাকবে।
চাঁদে কি অভিকর্ষ আছে?
হ্যাঁ, চাঁদে অভিকর্ষ আছে, তবে তা পৃথিবীর চেয়ে কম। চাঁদের অভিকর্ষ পৃথিবীর প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ।
অভিকর্ষ কিভাবে মাপা হয়?
অভিকর্ষ মাপার জন্য ব্যারোমিটার, গ্র্যাভিমিটারসহ বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
কৃত্রিম অভিকর্ষ কি সম্ভব?
বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম অভিকর্ষ তৈরির জন্য বিভিন্ন উপায় নিয়ে কাজ করছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো ঘূর্ণন (rotation)। একটি মহাকাশ স্টেশনকে যদি ঘোরানো যায়, তাহলে সেখানে কৃত্রিম অভিকর্ষ তৈরি করা সম্ভব।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কিভাবে কাজ করে?
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দুটি বস্তুর ভরের উপর নির্ভর করে কাজ করে। বস্তু যত ভারী, তার আকর্ষণ তত বেশি। এই শক্তি দূরত্বের সাথে সাথে দুর্বল হয়ে যায়।
এই সেই কয়েকটি প্রশ্ন যা সাধারণত মানুষের মাথায় ঘোরে৷ নিচে আরও কিছু প্রশ্ন দেওয়া হলো:
-
অভিকর্ষ ত্বরণ কাকে বলে?
কোনো বস্তুর ওপর অভিকর্ষ বলের কারণে যে ত্বরণ সৃষ্টি হয়, তাকে অভিকর্ষ ত্বরণ বলে। -
অভিকর্ষ ক্ষেত্র কাকে বলে?
কোনো বস্তুর চারপাশে যে অঞ্চল জুড়ে তার অভিকর্ষীয় প্রভাব বিদ্যমান, তাকে অভিকর্ষ ক্ষেত্র বলে। -
মহাকর্ষীয় ধ্রুবক কাকে বলে?
মহাকর্ষীয় ধ্রুবক হলো সেই ধ্রুব সংখ্যা, যা দুটি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বলের মান নির্ধারণ করে।
-
পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষ কত?
পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষের মান শূন্য। -
অভিকর্ষ বলের সূত্র কি?
দুটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল তাদের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।
অভিকর্ষ নিয়ে আধুনিক গবেষণা (Modern Research on Gravity)
বিজ্ঞানীরা এখনো অভিকর্ষ নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা জানতে চান, কীভাবে অভিকর্ষ কোয়ান্টাম স্তরে কাজ করে এবং কৃষ্ণ গহ্বরের (black hole) ভেতরে কী ঘটে।
কোয়ান্টাম অভিকর্ষ (Quantum Gravity)
কোয়ান্টাম অভিকর্ষ হলো পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে অভিকর্ষকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে মেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
কৃষ্ণ গহ্বর এবং সিঙ্গুলারিটি (Black Holes and Singularity)
কৃষ্ণ গহ্বর হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তুগুলোর মধ্যে একটি। বিজ্ঞানীরা জানতে চান, এর ভেতরে অভিকর্ষ কীভাবে কাজ করে এবং সিঙ্গুলারিটি কী।
শেষ কথা (Conclusion)
অভিকর্ষ আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি আমাদের চারপাশে সবকিছুকে ধরে রেখেছে এবং আমাদের জীবনযাত্রাকে সম্ভব করেছে। স্যার আইজ্যাক নিউটন থেকে শুরু করে আলবার্ট আইনস্টাইন পর্যন্ত অনেক বিজ্ঞানী এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বর্তমানেও বিজ্ঞানীরা অভিকর্ষ নিয়ে গবেষণা করছেন এবং নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করছেন।
আশা করি, আজকের ব্লগ পোস্টটি থেকে আপনি অভিকর্ষ সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর যদি এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকে, তবে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
এবার বলুন তো, অভিকর্ষ নিয়ে আপনার সবচেয়ে মজার অভিজ্ঞতা কী? কমেন্টে জানান!