আজকে আমরা কথা বলব এমন একটা বিষয় নিয়ে, যেটা হয়তো আপনি শুনেছেন, কিন্তু পুরোপুরি ধারণা নেই। সেটা হলো অগ্রাধিকার শেয়ার (Preference Share)। শেয়ার বাজারের দুনিয়ায় এই জিনিসটা কি, কেন এটা সাধারণ শেয়ার থেকে আলাদা, আর আপনার জন্য এটা কতটা কাজের, সেই সবকিছু সহজ করে বুঝিয়ে দেব।
অগ্রাধিকার শেয়ার: বিনিয়োগের জগতে একটি বিশেষ স্থান
অগ্রাধিকার শেয়ার হলো কোম্পানির মালিকানার একটা অংশ, তবে সাধারণ শেয়ারের থেকে এর কিছু বিশেষ সুবিধা আছে। এই শেয়ারহোল্ডাররা লভ্যাংশ (ডিভিডেন্ড) পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পান এবং কোম্পানি যদি কখনো ভেঙে যায় বা দেউলিয়া হয়ে যায়, সেক্ষেত্রেও তাদের মূলধন ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের আগে থাকে।
অগ্রাধিকার শেয়ার আসলে কী?
সহজ ভাষায়, অগ্রাধিকার শেয়ার হলো এমন এক ধরনের শেয়ার যা বিনিয়োগকারীদের কিছু বিশেষ অধিকার দিয়ে থাকে। এই অধিকারগুলোর মধ্যে প্রধান হলো লভ্যাংশ বিতরণে অগ্রাধিকার এবং কোম্পানির সম্পদ বিতরণে অগ্রাধিকার। তার মানে, কোম্পানি লাভ করলে অগ্রাধিকার শেয়ারহোল্ডাররা আগে লভ্যাংশ পাবেন, এবং কোম্পানি যদি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সম্পত্তি বিক্রি করে প্রথমে তাদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।
অগ্রাধিকার শেয়ারের বৈশিষ্ট্য
অগ্রাধিকার শেয়ারের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যা একে অন্য শেয়ার থেকে আলাদা করে। চলুন, সেই বৈশিষ্ট্যগুলো একটু বিস্তারিত জেনে নেই:
লভ্যাংশ পাওয়ার অগ্রাধিকার
অগ্রাধিকার শেয়ারহোল্ডাররা সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের আগে লভ্যাংশ পান। এর মানে হলো, কোম্পানি লাভ করলে প্রথমে এদের লভ্যাংশ দিতে হবে। এই লভ্যাংশের হার সাধারণত আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে।
সম্পদ বিতরণে অগ্রাধিকার
যদি কখনো কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়, তাহলে ঋণদাতাদের (creditors) পরে এবং সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের আগে অগ্রাধিকার শেয়ারহোল্ডাররা কোম্পানির সম্পত্তি থেকে তাদের বিনিয়োগের অংশ ফেরত পান।
নির্দিষ্ট লভ্যাংশ হার (Fixed Dividend Rate)
এই শেয়ারের লভ্যাংশ সাধারণত নির্দিষ্ট করা থাকে। তাই বিনিয়োগকারীরা আগে থেকেই জানতে পারেন যে তারা কতটা লভ্যাংশ পেতে পারেন।
ভোটাধিকার সীমিত অথবা অনুপস্থিত (Limited or No Voting Rights)
সাধারণত, অগ্রাধিকার শেয়ারহোল্ডারদের ভোটাধিকার থাকে না। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন লভ্যাংশ না পেলে বা কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তারা ভোট দিতে পারেন।
অগ্রাধিকার শেয়ার কত প্রকার?
বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে অগ্রাধিকার শেয়ারকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। নিচে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
পরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Convertible Preference Share)
এই ধরনের শেয়ারকে নির্দিষ্ট সময় পর সাধারণ শেয়ারে পরিবর্তন করা যায়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা চাইলে তাদের শেয়ারকে সাধারণ শেয়ারে পরিবর্তন করে কোম্পানির আরও বেশি মালিকানা পেতে পারেন।
অ-পরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Convertible Preference Share)
এই শেয়ারগুলোকে সাধারণ শেয়ারে পরিবর্তন করা যায় না। এগুলি শুধুমাত্র অগ্রাধিকার শেয়ার হিসেবেই থাকে।
সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার (Cumulative Preference Share)
যদি কোনো বছর কোম্পানি লাভ করতে না পারে, এবং লভ্যাংশ দিতে না পারে, তাহলে সেই লভ্যাংশ জমে থাকে। পরবর্তীতে যখন কোম্পানি লাভ করবে, তখন আগের বছরের বকেয়া লভ্যাংশসহ এই শেয়ারহোল্ডারদের পরিশোধ করা হবে।
অ-সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Cumulative Preference Share)
এই ক্ষেত্রে, যদি কোনো বছর কোম্পানি লাভ করতে না পারে, তাহলে সেই বছরের লভ্যাংশ আর পাওয়া যায় না। অর্থাৎ, লভ্যাংশ বকেয়া থাকে না।
অংশগ্রহণমূলক অগ্রাধিকার শেয়ার (Participating Preference Share)
এই ধরনের শেয়ারহোল্ডাররা নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পাওয়ার পরেও কোম্পানির অতিরিক্ত লাভে অংশ নিতে পারেন।
অ-অংশগ্রহণমূলক অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Participating Preference Share)
এরা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পান এবং কোম্পানির অতিরিক্ত লাভে কোনো অংশ নিতে পারেন না।
কেন আপনি অগ্রাধিকার শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন?
অগ্রাধিকার শেয়ার বিনিয়োগের কিছু বিশেষ সুবিধা রয়েছে। সেইগুলো আলোচনা করা হলো:
নিরাপত্তা (Safety)
সাধারণ শেয়ারের তুলনায় অগ্রাধিকার শেয়ার তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। কারণ কোম্পানি দেউলিয়া হলে অগ্রাধিকার শেয়ারহোল্ডাররা প্রথমে তাদের বিনিয়োগের অর্থ ফেরত পান।
আয় (Income)
এগুলো বিনিয়োগকারীদের একটি নির্দিষ্ট আয়ের সুযোগ করে দেয়, যা তাদের বিনিয়োগের উপর একটি স্থিতিশীল রিটার্ন নিশ্চিত করে।
ঝুঁকি কম (Lower Risk)
সাধারণ শেয়ারের তুলনায় এর দাম কম ওঠানামা করে, তাই এটি কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ঝুঁকিগুলো কী কী?
সব বিনিয়োগের মতোই, অগ্রাধিকার শেয়ারের কিছু ঝুঁকিও আছে। সেগুলো হলো:
ভোটাধিকারের অভাব (Lack of Voting Rights)
অগ্রাধিকার শেয়ারহোল্ডারদের সাধারণত ভোটাধিকার থাকে না, তাই তারা কোম্পানির সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে পারেন না।
শেয়ারের দামের ওঠানামা (Price Fluctuation)
যদিও এটি সাধারণ শেয়ারের চেয়ে কম, তবুও বাজারের পরিস্থিতির কারণে অগ্রাধিকার শেয়ারের দাম ওঠানামা করতে পারে।
সুদের হারের ঝুঁকি (Interest Rate Risk)
সুদের হার বাড়লে অগ্রাধিকার শেয়ারের দাম কমে যেতে পারে।
অগ্রাধিকার শেয়ার বনাম সাধারণ শেয়ার: পার্থক্যগুলো কী কী?
অগ্রাধিকার শেয়ার এবং সাধারণ শেয়ারের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিচে একটি টেবিলের মাধ্যমে এই পার্থক্যগুলো তুলে ধরা হলো:
বৈশিষ্ট্য | অগ্রাধিকার শেয়ার | সাধারণ শেয়ার |
---|---|---|
লভ্যাংশ (Dividend) | অগ্রাধিকার ভিত্তিতে লভ্যাংশ পান | অগ্রাধিকার শেয়ারহোল্ডারদের পরে লভ্যাংশ পান |
ভোটাধিকার (Voting Rights) | সাধারণত থাকে না, তবে কিছু ক্ষেত্রে থাকে | সাধারণত ভোটাধিকার থাকে |
ঝুঁকি (Risk) | সাধারণ শেয়ারের চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ | বেশি ঝুঁকিপূর্ণ |
সম্পদ বিতরণ (Asset Distribution) | কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে প্রথমে এরা পান | সবার শেষে এদের অধিকার আসে |
কীভাবে অগ্রাধিকার শেয়ার কিনবেন?
অগ্রাধিকার শেয়ার কেনা বেশ সহজ। আপনি যেকোনো স্টক ব্রোকারের মাধ্যমে এটি কিনতে পারেন। কেনার আগে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা এবং শেয়ারের বৈশিষ্ট্য ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত।
কোন ব্রোকার ভালো?
বাংলাদেশে অনেক স্টক ব্রোকার আছে, যারা অগ্রাধিকার শেয়ার কেনাবেচার সুযোগ দেয়। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম নিচে দেওয়া হলো:
- IDLC Securities Limited
- BRAC EPL Stock Brokerage Limited
- City Brokerage Limited
কীভাবে একটি ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলবেন?
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে হলে আপনার একটি ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট (Demat Account) থাকা দরকার। এটি খোলাও খুব সহজ। নিচে কয়েকটি ধাপ দেওয়া হলো:
- প্রথমে একটি ভালো স্টক ব্রোকার নির্বাচন করুন।
- তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে অথবা সরাসরি অফিসে গিয়ে ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্ম সংগ্রহ করুন।
- ফর্মটি সঠিকভাবে পূরণ করুন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (যেমন: পরিচয়পত্র, ঠিকানার প্রমাণ, পাসপোর্ট সাইজের ছবি) জমা দিন।
- আপনার আবেদন যাচাই করার পরে ব্রোকার আপনার ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলে দেবে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
অগ্রাধিকার শেয়ার নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন প্রায়ই শোনা যায়। নিচে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
অগ্রাধিকার শেয়ার কি ডিবেঞ্চার থেকে আলাদা?
অবশ্যই! অগ্রাধিকার শেয়ার হলো মালিকানার অংশ, আর ডিবেঞ্চার হলো ঋণ। অগ্রাধিকার শেয়ারহোল্ডাররা লভ্যাংশ পান, অন্যদিকে ডিবেঞ্চারহোল্ডাররা সুদ পান।
কোম্পানিগুলো কেন অগ্রাধিকার শেয়ার ইস্যু করে?
কোম্পানিগুলো সাধারণত মূলধন সংগ্রহের জন্য অগ্রাধিকার শেয়ার ইস্যু করে। এর মাধ্যমে তারা ঋণ না নিয়েই বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা পায়।
কীভাবে বুঝবেন কোন অগ্রাধিকার শেয়ারটি ভালো?
ভালো অগ্রাধিকার শেয়ার চেনার জন্য কোম্পানির আর্থিক অবস্থা, লভ্যাংশের ইতিহাস, এবং শেয়ারের বৈশিষ্ট্যগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
লভ্যাংশ কি সবসময় নিশ্চিত?
অগ্রাধিকার শেয়ারে লভ্যাংশ সাধারণত নিশ্চিত ধরা হয়, তবে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার উপর এটি নির্ভরশীল। লাভ না হলে কোম্পানি লভ্যাংশ দিতে বাধ্য নয়, যদি না সেটি সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার হয়।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানি যেমন বেক্সিমকো (Beximco) এবং স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস (Square Pharmaceuticals) তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য বিভিন্ন সময় অগ্রাধিকার শেয়ার ইস্যু করেছে। এই শেয়ারগুলো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
শেষ কথা
আশা করি, অগ্রাধিকার শেয়ার সম্পর্কে আপনার একটি স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগের আগে সব সময় ভালোভাবে জেনে বুঝে সিদ্ধান্ত নিন।
যদি আপনার আরো কিছু জানার থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ, আপনার বন্ধুদের সাথে এই ব্লগটি শেয়ার করতে ভুলবেন না। হয়তো তাদেরও এই তথ্যগুলো কাজে লাগবে।Happy investing!