আসসালামু আলাইকুম, বন্ধুরা! কেমন আছেন সবাই? “ওহী” শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা পবিত্র অনুভূতি হয়, তাই না? কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানি না ওহী আসলে কী, কত প্রকার, বা এর তাৎপর্যই বা কী। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা ওহীর খুঁটিনাটি সবকিছু সহজ ভাষায় জানার চেষ্টা করব। আশা করি, শেষ পর্যন্ত সাথে থাকবেন!
ওহী: এক ঐশ্বরিক বার্তা
ওহী শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো ইশারা করা, ইঙ্গিত করা, গোপনে কথা বলা, চিঠি লেখা, দ্রুত কোনো সংবাদ প্রেরণ করা ইত্যাদি। ইসলামে ওহী বলতে বোঝায়, আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নবী-রাসূলদের কাছে আসা সরাসরি বা বিশেষ মাধ্যমে পাঠানো বার্তা। এটা অনেকটা যেন আল্লাহ তা’আলার সঙ্গে নবী-রাসূলদের একটা সিক্রেট কথোপকথন!
ওহী কাকে বলে?
ইসলামের পরিভাষায় ওহী হলো আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নবী ও রাসূলগণের নিকট জিবরাঈল (আঃ) অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রেরিত নির্দেশনাবলী। এই নির্দেশনাবলী সরাসরি আল্লাহর বাণী হতে পারে, অথবা কোনো ধারণার মাধ্যমেও হতে পারে যা নবী-রাসূলগণ তাঁদের নিজস্ব ভাষায় প্রকাশ করেছেন। ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির পথপ্রদর্শনের জন্য নবী-রাসূলদের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছে দেন।
ওহীর প্রকারভেদ:
ওহী প্রধানত দুই প্রকার:
১. ওহী মাতলু (Al-Wahy al-Matlu):
* এই প্রকার ওহী হলো কুরআন মাজীদ। এটি আল্লাহ তা'আলার বাণী যা জিবরাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে।
* এই ওহীর শব্দ এবং অর্থ উভয়ই আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত।
* কুরআনের প্রতিটি শব্দ অপরিবর্তিত এবং এটি মানবজাতির জন্য অনুসরণীয়।
২. ওহী গায়ের মাতলু (Al-Wahy Ghair al-Matlu):
* এই প্রকার ওহী হলো হাদীস। এটি নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কথা, কাজ এবং মৌন সম্মতি যা তাঁর সাহাবীরা বর্ণনা করেছেন।
* হাদীসের মূল ধারণা আল্লাহর পক্ষ থেকে এলেও এর শব্দ চয়ন এবং বিন্যাস নবী মুহাম্মদ (সাঃ) করেছেন।
* হাদীস কুরআনের ব্যাখ্যা এবং মুসলিমদের জীবন যাপনের দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
ওহীর অন্যান্য প্রকারভেদ:
ওহীকে আরও কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যা নিচে আলোচনা করা হলো:
সরাসরি প্রত্যাদেশ:
- আল্লাহ সরাসরি নবী-রাসূলদের সাথে কথা বলেছেন। যেমন, মুসা (আঃ) এর সঙ্গে আল্লাহ তা’আলা তুর পাহাড়ে কথা বলেছিলেন।
জিবরাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে ওহী:
- ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহর বাণী নিয়ে নবী-রাসূলদের কাছে আসতেন। কুরআনের অধিকাংশ আয়াত এভাবেই নাজিল হয়েছে।
স্বপ্নের মাধ্যমে ওহী:
- আল্লাহ তা’আলা কোনো কোনো সময় নবী-রাসূলদের স্বপ্নেও ওহী পাঠাতেন।
ইলহাম বা অন্তর্দৃষ্টি:
- নবী-রাসূলগণের অন্তরে আল্লাহ তা’আলা কোনো বিষয় সম্পর্কে ধারণা বা জ্ঞান দান করতেন।
ওহীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
ওহীর গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে এর কয়েকটি তাৎপর্য আলোচনা করা হলো:
- পথনির্দেশ: ওহীর মাধ্যমে মানবজাতি সঠিক পথের সন্ধান পায়। আল্লাহর বিধান ও রাসূলের (সা.) আদর্শ জানতে পারে।
- জ্ঞান অর্জন: ওহী হলো জ্ঞানের মূল উৎস। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহ, সৃষ্টিজগৎ এবং জীবন সম্পর্কে জানতে পারি।
- আইন ও বিধান: ওহীর মাধ্যমে ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান নাজিল হয়েছে, যা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করে।
- ঐক্য ও সংহতি: ওহীর ওপর বিশ্বাস মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে।
ওহী এবং বিজ্ঞান:
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, বিজ্ঞান ও ওহী কি পরস্পরবিরোধী? আসলে তা নয়। বিজ্ঞান হলো আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা, আর ওহী হলো সৃষ্টিকর্তার বাণী। অনেক সময় দেখা যায়, বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করে, তার ইঙ্গিত কুরআনে আগে থেকেই দেওয়া আছে। তাই বিজ্ঞান ও ওহী একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।
কুরআনের কয়েকটি উদাহরণ:
- কুরআনে ভ্রূণের বিকাশ সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, আধুনিক বিজ্ঞানও তা সমর্থন করে।
- মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের কথা কুরআনে বলা হয়েছে, যা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।
ওহী সম্পর্কে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ):
এখানে ওহী নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. ওহী কি শুধু নবীদের কাছে আসে?
উত্তরঃ হ্যাঁ, ওহী শুধুমাত্র নবী ও রাসূলগণের কাছেই আসে। সাধারণ মানুষের কাছে ওহী আসার কোনো সুযোগ নেই।
২. ওহী কি বন্ধ হয়ে গেছে?
উত্তরঃ হ্যাঁ, নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুর সাথে সাথে ওহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আর কোনো নতুন নবী বা রাসূল আসবেন না।
৩. ওহীর জ্ঞান কি যুক্তি দিয়ে বোঝা সম্ভব?
উত্তরঃ ওহীর কিছু বিষয় যুক্তি দিয়ে বোঝা যায়, আবার কিছু বিষয় বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। তবে ওহীর কোনো বিষয় যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক নয়।
৪. ওহী কিভাবে সংরক্ষিত আছে?
উত্তরঃ কুরআন মাজীদ আল্লাহ তা’আলার অলৌকিক ক্ষমতা ও মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত আছে। হাদীসও অত্যন্ত সতর্কতা ও নির্ভরযোগ্যতার সাথে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত হয়েছে।
৫. ওহী অস্বীকার করার পরিণতি কী?
উত্তরঃ ওহী অস্বীকার করা কুফরি। যে ব্যক্তি ওহীর কোনো একটি বিষয়কে অস্বীকার করে, সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।
ওহীর প্রতি আমাদের দায়িত্ব:
ওহীর প্রতি আমাদের কিছু দায়িত্ব আছে। যেমন:
- কুরআন ও হাদীস মনোযোগ দিয়ে পড়া এবং বোঝা।
- ওহীর শিক্ষা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।
- অন্যদের কাছে ওহীর বাণী পৌঁছে দেওয়া।
- ওহীর জ্ঞানকে রক্ষা করা এবং এর মর্যাদা রক্ষা করা।
ওহীর প্রকারভেদ নিয়ে আরো কিছু তথ্য:
ওহীর প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আরও কিছু বিষয় উঠে আসে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হলো:
১. জিবরাঈল (আঃ) এর বিভিন্ন রূপে আগমন:
জিবরাঈল (আঃ) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে নবী (সাঃ) এর কাছে ওহী নিয়ে আসতেন। কখনও তিনি একজন মানুষের রূপে আসতেন, আবার কখনও তাঁর আসল রূপে। প্রতিটি রূপের তাৎপর্য ছিল ভিন্ন।
মানুষের রূপে আগমন:
জিবরাঈল (আঃ) যখন মানুষের রূপে আসতেন, তখন সাধারণত একজন সুদর্শন যুবকের বেশে আসতেন। সাহাবীরাও তাঁকে দেখতে পেতেন।
আসল রূপে আগমন:
জিবরাঈল (আঃ) যখন তাঁর আসল রূপে আসতেন, তখন নবী (সাঃ) এর ওপর গভীর প্রভাব পড়ত। এটি ছিল ওহীর সবচেয়ে শক্তিশালী রূপ।
২. ঘণ্টার ধ্বনির ন্যায় ওহী:
কখনও কখনও নবী (সাঃ) ঘণ্টার ধ্বনির ন্যায় শব্দ শুনতে পেতেন, যা ছিল ওহীর আগমনী বার্তা। এটি ছিল সবচেয়ে কঠিন ধরনের ওহী।
৩. অন্তরের গভীরে স্ফূরণ:
কখনও কখনও নবী (সাঃ) এর অন্তরের গভীরে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কোনো কথা বা ধারণা জাগ্রত হতো। এটি ছিল ওহীর একটি সূক্ষ্ম রূপ।
৪. সরাসরি কথোপকথন:
কিছু বিশেষ মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা সরাসরি নবী (সাঃ) এর সাথে কথা বলতেন। যেমন মেরাজের রাতে আল্লাহ তায়ালা নবী (সাঃ) এর সাথে কথা বলেছিলেন।
বর্তমান জীবনে ওহীর প্রাসঙ্গিকতা:
বর্তমান আধুনিক জীবনেও ওহীর গুরুত্ব কম নয়। বরং এই সময়ে ওহীর শিক্ষা আরও বেশি প্রয়োজন। কারণ, আধুনিক বিশ্বে মানুষ নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ওহীর আলোই পারে এসব সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে।
১. নৈতিক অবক্ষয় রোধ:
আজকের সমাজে নৈতিক অবক্ষয় একটি বড় সমস্যা। ওহীর শিক্ষা মানুষকে সৎ ও নীতিবান হতে সাহায্য করে।
২. সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা:
ইসলামে ন্যায়বিচারের ওপর খুব জোর দেওয়া হয়েছে। ওহীর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, কীভাবে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
৩. পারিবারিক শান্তি স্থাপন:
পারিবারিক জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ওহীর শিক্ষা খুবই জরুরি। স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক স্থাপনের উপায় ওহীতে বলা হয়েছে।
৪. মানসিক প্রশান্তি লাভ:
ওহীর জ্ঞান মানুষকে মানসিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা দেয়। যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখে, তারা কঠিন পরিস্থিতিতেও ধৈর্য ধারণ করতে পারে।
ওহী : কিছু অনুধাবন
ওহী নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, আমার কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা না বললেই নয়। আমি যখন কুরআন পড়ি, তখন মনে হয় যেন আল্লাহ সরাসরি আমার সাথে কথা বলছেন। এটা একটা অসাধারণ অনুভূতি, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
আমার মনে আছে, একবার আমি খুব কঠিন একটা সমস্যার মধ্যে পড়েছিলাম। কোনোভাবেই কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন আমি কুরআন খুলে সূরা বাকারা পড়লাম। সেখানে একটি আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে আমার সাহায্য প্রার্থনা কর।” এই আয়াতটি পড়ার পর আমার মনে শান্তি ফিরে এল এবং আমি নতুন করে চেষ্টা করার সাহস পেলাম।
আসলেই, ওহী আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পথ দেখাতে পারে। শুধু প্রয়োজন একটু মনোযোগ দিয়ে কুরআন ও হাদীস পড়া এবং সে অনুযায়ী জীবনযাপন করা।
ওহী নিয়ে আরও অনেক কথা বলা যায়, কিন্তু পরিসর সীমিত হওয়ায় এখানেই শেষ করছি। আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে আপনারা ওহী সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন।
পরিশেষে, আসুন আমরা সবাই ওহীর শিক্ষাকে নিজেদের জীবনে ধারণ করি এবং একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে অবদান রাখি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।