অংশীদারি ব্যবসা: একসাথে পথ চলার সহজ উপায়!
আচ্ছা, ব্যবসা শুরু করতে চান? একা হাতে সব সামলাতে ভয় লাগছে? তাহলে অংশীদারি ব্যবসা হতে পারে আপনার জন্য দারুণ একটা অপশন! ভাবছেন, এটা আবার কী জিনিস? আসুন, সহজ ভাষায় জেনে নেওয়া যাক।
অংশীদারি ব্যবসা মানে হলো যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একটি চুক্তি বা agreement এর মাধ্যমে একসাথে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এখানে সবাই মিলে পুঁজি বিনিয়োগ করে, লাভ-লোকসান ভাগ করে নেয় এবং ব্যবসার দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করে। অনেকটা যেন একটা পরিবার, যেখানে সবাই মিলেমিশে কাজ করে!
অংশীদারি ব্যবসা কী? (What is Partnership Business?)
আইন অনুযায়ী, যখন কয়েকজন ব্যক্তি মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে কোন চুক্তির মাধ্যমে একত্রিত হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে, তখন তাকে অংশীদারি ব্যবসা বলে। এই ব্যবসায় অংশীদাররা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে ব্যবসার নিয়মকানুন ঠিক করে নেয়।
অংশীদারি ব্যবসার সংজ্ঞা (Definition of Partnership Business)
স্যার জন স্যালমন্ডের মতে, “অংশীদারি হলো এমন একটি সম্পর্ক যেখানে কিছু ব্যক্তি মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে তাদের পুঁজি ও শ্রম একত্রিত করে।” তার মানে, এখানে শুধু টাকাই নয়, আপনার মেধা এবং পরিশ্রমও কাজে লাগে।
অংশীদারি ব্যবসার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Partnership Business)
এই ব্যবসার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যা একে অন্য ব্যবসা থেকে আলাদা করে:
- চুক্তি (Agreement): এটি অংশীদারি ব্যবসার মূল ভিত্তি। অংশীদারদের মধ্যে একটি লিখিত বা মৌখিক চুক্তি থাকে।
- একাধিক সদস্য (Multiple Members): এখানে কমপক্ষে দুইজন সদস্য থাকতে হয়। তবে, কোম্পানি আইন অনুযায়ী এর একটা সর্বোচ্চ সীমা আছে। সাধারণত, এটা ২০ জনের বেশি হওয়া উচিত না।
- মুনাফা ও লোকসান বণ্টন (Profit and Loss Sharing): অংশীদাররা পূর্ব নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী লাভ ও লোকসান ভাগ করে নেয়।
- অসীম দায় (Unlimited Liability): অংশীদারি কারবারের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এর দায় অসীম।
- পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস (Mutual Trust and Faith): অংশীদারদের মধ্যে অবশ্যই ভালো বোঝাপড়া থাকতে হবে। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে ব্যবসা চালানো মুশকিল।
- আইনগত সত্তা (Legal Entity): এটির আইনগত সত্তা নেই। তাই অংশীদারদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না।
অংশীদারি ব্যবসার প্রকারভেদ (Types of Partnership Business)
অংশীদারি ব্যবসা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন:
মেয়াদের ভিত্তিতে (Based on Duration)
- ঐচ্ছিক অংশীদারি (Optional Partnership): এই ধরনের ব্যবসায় অংশীদাররা যতদিন ইচ্ছা ব্যবসা চালাতে পারে। তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে এটি চলে।
- নির্দিষ্ট মেয়াদী অংশীদারি (Fixed Term Partnership): এখানে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবসা শুরু করা হয়। সময় শেষ হলে এটি আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়।
দায়িত্বের ভিত্তিতে (Based on Liability)
- সীমাবদ্ধ দায়যুক্ত অংশীদারি (Limited Liability Partnership – LLP): এই ক্ষেত্রে, কোনো অংশীদারের দায় তার বিনিয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এর ফলে ব্যক্তিগত সম্পদ ঝুঁকির মধ্যে আসে না।
- সীমাহীন দায়যুক্ত অংশীদারি (Unlimited Liability Partnership): এখানে অংশীদারদের দায় সীমাহীন। অর্থাৎ, ব্যবসার ঋণ পরিশোধের জন্য তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও ব্যবহার করা হতে পারে।
উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে (Based on Purpose)
- সাধারণ অংশীদারি (General Partnership): এই ধরনের ব্যবসায় অংশীদাররা সবাই মিলেমিশে ব্যবসার দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করে।
- বিশেষ অংশীদারি (Special Partnership): কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই অংশীদারি গঠিত হয়। উদ্দেশ্য সফল হলে এটি ভেঙে দেওয়া হয়।
অংশীদারি চুক্তির বিষয়বস্তু (Contents of Partnership Deed)
অংশীদারি চুক্তি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এতে ব্যবসার নিয়মকানুন, অংশীদারদের অধিকার ও দায়-দায়িত্ব ইত্যাদি উল্লেখ থাকে। এই চুক্তিতে সাধারণত যা থাকে:
- অংশীদারদের নাম ও ঠিকানা
- প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা
- ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য
- অংশীদারদের মূলধনের পরিমাণ
- লাভ-লোকসান বণ্টনের অনুপাত
- ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের নিয়মাবলী
- ব্যাংক হিসাব পরিচালনা সংক্রান্ত নিয়ম
- কোনো অংশীদারের মৃত্যু অথবা অবসর গ্রহণ সংক্রান্ত নিয়মাবলী
- বিরোধ নিষ্পত্তির উপায়
অংশীদারি ব্যবসার সুবিধা (Advantages of Partnership Business)
অংশীদারি ব্যবসার অনেক সুবিধা আছে, যা নতুন উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা আলোচনা করা হলো:
- সহজে গঠন করা যায় (Easy to Form): এটি সহজেই গঠন করা যায়। এর জন্য খুব বেশি আইনি জটিলতা নেই।
- বেশি মূলধন সংগ্রহ (More Capital Collection): যেহেতু একাধিক অংশীদার থাকে, তাই বেশি মূলধন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
- যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Joint Decision Making): সবাই মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে।
- ঝুঁকি ভাগাভাগি (Risk Sharing): লোকসান হলে সবাই মিলে ভাগ করে নেয়, তাই individual এর উপর চাপ কম থাকে।
- বেশি ঋণ পাওয়ার সুযোগ (Opportunity to Get More Loans): একাধিক সদস্য থাকার কারণে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়া সহজ হয়।
- কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি (Increased Enthusiasm): সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাজের স্পৃহা বাড়ে।
অংশীদারি ব্যবসার অসুবিধা (Disadvantages of Partnership Business)
কিছু অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও, অংশীদারি ব্যবসা অনেকের জন্য লাভজনক হতে পারে। নিচে কিছু অসুবিধা উল্লেখ করা হলো:
- অসীম দায় (Unlimited Liability): অংশীদারদের দায় সীমাহীন হওয়ায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
- সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা (Complexity in Decision Making): একাধিক সদস্য থাকায় অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়।
- বিশ্বাসের অভাব (Lack of Trust): অংশীদারদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব দেখা দিলে ব্যবসায় খারাপ প্রভাব পরে।
- মূলধনের অভাব (Lack of Capital): প্রয়োজনীয় মুহূর্তে পর্যাপ্ত মূলধন পাওয়া নাও যেতে পারে।
- গোপনীয়তার অভাব (Lack of Confidentiality): ব্যবসার গোপনীয়তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
- দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার অনিশ্চয়তা (Uncertainty of Survival): যেকোনো সময় অংশীদারি ভেঙে যেতে পারে।
অংশীদারি ব্যবসা শুরু করার নিয়ম (Rules for Starting a Partnership Business)
অংশীদারি ব্যবসা শুরু করতে তেমন কোনো জটিল নিয়ম নেই। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ আলোচনা করা হলো:
- অংশীদার নির্বাচন (Partner Selection): প্রথমে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার নির্বাচন করতে হবে।
- চুক্তি তৈরি (Agreement Making): একটি লিখিত চুক্তি তৈরি করতে হবে, যেখানে ব্যবসার নিয়মকানুন উল্লেখ থাকবে।
- নাম নিবন্ধন (Name Registration): স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যবসার নাম নিবন্ধন করতে হবে।
- ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ (Trade License Collection): ব্যবসা পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে।
- ব্যাংক হিসাব খোলা (Bank Account Opening): ব্যবসার নামে একটি ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে।
অংশীদারি ব্যবসা চুক্তিপত্র লেখার নিয়ম (Rules for Writing a Partnership Agreement)
অংশীদারি চুক্তিপত্র লেখার সময় কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে:
- চুক্তিটি স্পষ্ট ও সহজ ভাষায় লিখতে হবে।
- অংশীদারদের নাম, ঠিকানা, এবং অন্যান্য পরিচয় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
- ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য এবং পরিধি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে হবে।
- মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণ এবং লাভ-লোকসান বণ্টনের অনুপাত উল্লেখ করতে হবে।
- চুক্তির মেয়াদকাল উল্লেখ করতে হবে।
- বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া উল্লেখ করতে হবে।
অংশীদারি ব্যবসা বাংলাদেশে কতটা জনপ্রিয়? (How Popular is Partnership Business in Bangladesh?)
বাংলাদেশে অংশীদারি ব্যবসা বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসার জন্য এটি একটি ভালো বিকল্প। অনেক মানুষ একসাথে মিলেমিশে ব্যবসা করতে আগ্রহী, তাই এই ধরনের ব্যবসার প্রচলন বাড়ছে।
বাংলাদেশে অংশীদারি ব্যবসার ভবিষ্যৎ (Future of Partnership Business in Bangladesh)
বাংলাদেশে অংশীদারি ব্যবসার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কারণ, এখানে তরুণ উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়ছে, যারা একসাথে কাজ করতে আগ্রহী। এছাড়া, সরকারও এই ধরনের ব্যবসাকে উৎসাহিত করছে। ফলে, ভবিষ্যতে অংশীদারি ব্যবসা আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়।
অংশীদারি ব্যবসা নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে অংশীদারি ব্যবসা নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
- অংশীদারি ব্যবসা শুরু করার জন্য কতজন সদস্য প্রয়োজন?
অংশীদারি ব্যবসা শুরু করার জন্য কমপক্ষে দুইজন সদস্য প্রয়োজন। তবে, কোম্পানি আইন অনুযায়ী এর সর্বোচ্চ সীমা সাধারণত ২০ জন।
- অংশীদারি চুক্তিতে কী কী বিষয় উল্লেখ থাকে?
অংশীদারি চুক্তিতে অংশীদারদের নাম, ঠিকানা, ব্যবসার উদ্দেশ্য, মূলধনের পরিমাণ, লাভ-লোকসান বণ্টনের নিয়ম, ইত্যাদি উল্লেখ থাকে।
- অংশীদারি ব্যবসার দায় কেমন হয়?
অংশীদারি ব্যবসার দায় সাধারণত অসীম হয়। অর্থাৎ, ব্যবসার ঋণ পরিশোধের জন্য অংশীদারদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও ব্যবহার করা হতে পারে। তবে, সীমিত দায়যুক্ত অংশীদারির ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়।
- অংশীদারি ব্যবসা কি একক মালিকানার চেয়ে ভালো?
এটা নির্ভর করে আপনার পরিস্থিতির উপর। যদি আপনি একা ব্যবসা করতে চান, তাহলে একক মালিকানা ভালো। কিন্তু যদি আপনি বেশি মূলধন এবং যৌথ সিদ্ধান্ত নিতে চান, তাহলে অংশীদারি ব্যবসা ভালো।
- অংশীদারি ব্যবসা কিভাবে নিবন্ধন করতে হয়?
অংশীদারি ব্যবসা নিবন্ধন করার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয় এবং কিছু ফি পরিশোধ করতে হয়।
- অংশীদারদের মধ্যে বিরোধ হলে কী করা উচিত?
অংশীদারদের মধ্যে বিরোধ হলে প্রথমে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে আদালতের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
- অংশীদারি ব্যবসার মূল ভিত্তি কি?
অংশীদারি ব্যবসার মূল ভিত্তি হলো অংশীদারদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস এবং একটি সুস্পষ্ট চুক্তি।
- অংশীদারি ব্যবসার সুবিধা কি কি?
অংশীদারি ব্যবসার সুবিধা হল সহজে গঠন করা যায়, বেশি মূলধন সংগ্রহ করা যায়, যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়, ঝুঁকি ভাগাভাগি করা যায় এবং বেশি ঋণ পাওয়ার সুযোগ থাকে।
- অংশীদারি ব্যবসার অসুবিধা কি কি?
অংশীদারি ব্যবসার অসুবিধা হল অসীম দায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা, বিশ্বাসের অভাব, মূলধনের অভাব, গোপনীয়তার অভাব এবং দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার অনিশ্চয়তা।
- অংশীদারি চুক্তিপত্র কেন জরুরি?
অংশীদারি চুক্তিপত্র জরুরি কারণ এটি ব্যবসার নিয়মকানুন, অংশীদারদের অধিকার ও দায়-দায়িত্ব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে এবং ভবিষ্যতে বিরোধ এড়াতে সাহায্য করে।
উপসংহার
অংশীদারি ব্যবসা একটি চমৎকার উপায়, যদি আপনি একসাথে কাজ করতে আগ্রহী হন এবং ঝুঁকি ভাগ করে নিতে চান। তবে, এটি শুরু করার আগে ভালোভাবে জেনে বুঝে চুক্তি করে নেওয়া উচিত। মনে রাখবেন, সঠিক পরিকল্পনা, পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সহযোগিতার মাধ্যমে আপনি আপনার ব্যবসাকে সফলতার শিখরে নিয়ে যেতে পারেন।
তাহলে, আর দেরি কেন? আপনার বন্ধুদের সাথে আলোচনা করুন, পরিকল্পনা করুন এবং শুরু করে দিন আপনার অংশীদারি ব্যবসা! কোন প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।