আজকে আমরা কথা বলব অর্থনীতির একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে – অর্থের যোগান (Money Supply)। জিনিসটা শুনতে একটু কঠিন লাগলেও, আসলে কিন্তু তেমন কিছুই না। ধরুন, আপনার পকেটে কত টাকা আছে, আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কত টাকা জমা আছে – এই সবকিছু মিলিয়েই কিন্তু দেশের অর্থের যোগান তৈরি হয়। তাহলে চলুন, একটু সহজভাবে জেনে নেয়া যাক অর্থের যোগান আসলে কী, এটা কীভাবে কাজ করে, আর কেনই বা এটা অর্থনীতির জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থের যোগান: সহজ ভাষায় সংজ্ঞা
অর্থের যোগান বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে অর্থনীতিতে জনগণের হাতে থাকা মুদ্রার পরিমাণকে বোঝায়। এই মুদ্রা শুধুমাত্র পকেটের নোট বা কয়েন নয়, বরং ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখা অর্থ – সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। সহজভাবে বলতে গেলে, দেশের ভেতরে কত টাকা লেনদেনের জন্য প্রস্তুত আছে, সেটাই হল অর্থের যোগান।
অর্থের যোগানের মূল উপাদান
অর্থের যোগানকে বুঝতে হলে এর উপাদানগুলো সম্পর্কে জানা দরকার। প্রধান উপাদানগুলো হলো:
- মুদ্রা (Currency): জনগণের হাতে থাকা নোট ও কয়েন।
- চাহিদা депозит (Demand Deposits): বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে থাকা চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাবের টাকা, যা চাহিবামাত্র তোলা যায়।
- সময় депозит (Time Deposits): একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যাংকে জমা রাখা টাকা (যেমন: ফিক্সড ডিপোজিট)।
অর্থের যোগান কেন গুরুত্বপূর্ণ?
অর্থের যোগান অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
- মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: অর্থের যোগান বেড়ে গেলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে (মুদ্রাস্ফীতি)। আবার যোগান কমে গেলে চাহিদা কমে গিয়ে মন্দা দেখা দিতে পারে। তাই অর্থের যোগান স্থিতিশীল রাখা দরকার।
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: সঠিক পরিমাণে অর্থের যোগান থাকলে বাজারে কেনাবেচা বাড়ে, বিনিয়োগ বাড়ে এবং কর্মসংস্থানও বাড়ে।
- সুদের হার নির্ধারণ: অর্থের যোগানের ওপর ভিত্তি করে ঋণের সুদের হার কম বা বেশি হতে পারে।
অর্থের যোগান কিভাবে মাপা হয়?
বিভিন্ন দেশে অর্থের যোগান মাপার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তবে বহুল ব্যবহৃত কয়েকটি পদ্ধতি হলো:
M0, M1, M2, এবং M3: অর্থের যোগানের প্রকারভেদ
অর্থের যোগানকে সাধারণত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়: M0, M1, M2, এবং M3। এদের মধ্যে পার্থক্য হলো তারল্যের (liquidity) মাত্রা। তারল্য মানে হলো কত সহজে কোনো সম্পদকে cash এ পরিবর্তন করা যায়।
-
M0: এটা হলো সবচেয়ে তারল্যপূর্ণ (highly liquid) অর্থ। এর মধ্যে আছে জনগণের হাতে থাকা নগদ টাকা এবং ব্যাংকের কাছে থাকা নগদ টাকা।
-
M1: M0 এর সাথে যোগ হয় demand deposit (যেমন: saving account, current account)। এগুলো থেকেও খুব সহজে টাকা তোলা যায়।
-
M2: M1 এর সাথে যোগ হয় time deposit (ফিক্সড ডিপোজিট) এবং savings deposit। এগুলো তুলতে একটু সময় লাগে, কিন্তু তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।
- M3: এটা হলো সবচেয়ে ব্যাপক ধারণা। M2 এর সাথে বিভিন্ন financial institute এর term funding ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী deposit ও যোগ করা হয়।
অর্থের যোগান | সংজ্ঞা | তারল্য (Liquidity) |
---|---|---|
M0 | জনগণের হাতে থাকা নগদ টাকা + ব্যাংকের কাছে থাকা নগদ টাকা | সর্বোচ্চ |
M1 | M0 + demand deposit (saving account, current account) | বেশি |
M2 | M1 + time deposit (ফিক্সড ডিপোজিট) + savings deposit | মাঝারি |
M3 | M2 + বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের term funding ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী deposit | কম |
অর্থের যোগান এবং সুদের হার
অর্থের যোগান এবং সুদের হারের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। যখন বাজারে অর্থের যোগান বাড়ে, তখন ব্যাংকগুলো সহজে ঋণ দিতে পারে, ফলে সুদের হার কমে যায়। আবার যখন অর্থের যোগান কমে যায়, তখন ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়, এবং সুদের হার বেড়ে যায়।
নীতিনির্ধারণে সুদের হারের প্রভাব
কেন্দ্রীয় ব্যাংক (যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক) অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে সুদের হারকে প্রভাবিত করতে পারে। সুদের হার কম থাকলে মানুষ বেশি ঋণ নেয়, ফলে বিনিয়োগ বাড়ে এবং অর্থনীতিতে গতি আসে। আবার সুদের হার বেশি থাকলে মানুষ কম ঋণ নেয়, ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
-
নীতি সুদহার (Policy Rate) পরিবর্তন: রেপো (Repo) এবং রিভার্স রেপো (Reverse Repo) হারের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যে সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তা পরিবর্তন করে অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
-
সংরক্ষণ অনুপাত (Reserve Requirement) পরিবর্তন: ব্যাংকগুলোকে তাদের মোট আমানতের একটা অংশ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে হয়। এই অনুপাত পরিবর্তন করেও অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
-
উন্মুক্ত বাজার কার্যক্রম (Open Market Operations): বন্ড বা ট্রেজারি বিল কিনে বা বিক্রি করেও বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্ন (FAQ)
এখানে অর্থের যোগান নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
অর্থের যোগান বাড়লে কি হয়?
অর্থের যোগান বাড়লে বাজারে টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়ে এবং দামও বাড়তে পারে। অতিরিক্ত অর্থের যোগান মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করতে পারে।
অর্থের যোগান কমলে কি হয়?
অর্থের যোগান কমলে বাজারে টাকার অভাব দেখা দেয়। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, চাহিদা কমে যায় এবং ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। অনেক সময় অর্থনৈতিক মন্দাও দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে অর্থের যোগান কিভাবে পরিমাপ করা হয়?
বাংলাদেশে বাংলাদেশ ব্যাংক M0, M1, M2, এবং M3 – এই চারটি পদ্ধতিতে অর্থের যোগান পরিমাপ করে।
তারল্য কি?
তারল্য (Liquidity) মানে হলো কোনো সম্পদকে কত সহজে cash এ পরিবর্তন করা যায়। যে সম্পদ যত সহজে cash এ পরিবর্তন করা যায়, সেটি তত বেশি তারল্যপূর্ণ।
অর্থের যোগান অর্থনীতিকে কিভাবে প্রভাবিত করে?
অর্থের যোগান অর্থনীতির অনেক দিককে প্রভাবিত করে, যেমন – মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।
অর্থনীতিতে অর্থের যোগানের ভূমিকা কী?
অর্থের যোগান অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সঠিক পরিমাণে অর্থের যোগান থাকলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং উন্নয়ন দ্রুত হয়।
আশা করি, অর্থের যোগান নিয়ে আপনার মনে যে প্রশ্নগুলো ছিল, তার উত্তর দিতে পেরেছি। অর্থনীতি এমন একটা বিষয়, যা সবসময় পরিবর্তনশীল। তাই নতুন কিছু জানতে এবং শিখতে থাকুন।
উপসংহার
তাহলে, আমরা দেখলাম অর্থের যোগান (Money Supply) বিষয়টা আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু কিছু নোট আর কয়েনের হিসাব নয়, বরং একটা দেশের অর্থনীতির সুস্থ থাকার অন্যতম চাবিকাঠি। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণে রেখে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে, সুদের হার স্থিতিশীল রাখে এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আপনিও যদি অর্থনীতি সম্পর্কে আরও জানতে চান, তাহলে বিভিন্ন আর্থিক খবরের দিকে নজর রাখতে পারেন। আর হ্যাঁ, এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করতে পারেন। আমি চেষ্টা করব উত্তর দেওয়ার। আজকের মতো এই পর্যন্তই, ভালো থাকবেন।