আসুন, রসায়নের গভীরে ডুব দেই! অষ্টক নিয়ম: পরমাণুদের স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি
আচ্ছা, কখনো ভেবেছেন কেন কিছু জিনিস খুব সহজে বিক্রিয়া করে, আবার কিছু জিনিস চুপচাপ থাকে, যেন তাদের কোনো হেলদোল নেই? এর উত্তর লুকিয়ে আছে পরমাণুদের ইলেকট্রনShell-এর খেলায়। আর এই খেলার একটা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো অষ্টক নিয়ম (Octet Rule)। চলুন, অষ্টক নিয়ম কী, কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, আর এর কিছু মজার ব্যতিক্রম নিয়ে আলোচনা করি। যেন রসায়ন ক্লাসের কঠিন বিষয়গুলোও আপনার কাছে সহজ হয়ে যায়!
অষ্টক নিয়ম (Octet Rule) কী?
অষ্টক নিয়ম হলো রসায়নের সেই ভিত্তি, যা দিয়ে আমরা বুঝতে পারি কেন পরমাণুরা অণু তৈরি করে। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, প্রত্যেক পরমাণু চায় তার সর্ববহিঃস্থ শক্তিস্তরে (outermost shell) আটটি ইলেকট্রন থাকুক। যাদের এই আটটি ইলেকট্রন থাকে, তারা স্থিতিশীল (stable) এবং সহজে অন্য কারো সাথে বিক্রিয়া করে না। নিষ্ক্রিয় গ্যাস (Noble gases), যেমন হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন—এরা এই দলের সদস্য।
কেন এই নিয়ম?
ভাবুন তো, সবাই যদি নিজের জীবনে পরিপূর্ণ হতে চায়, তাহলে পরমাণুদের দোষ কী? অষ্টক নিয়ম অনেকটা তেমনই। প্রতিটি পরমাণু স্থিতিশীল হতে চায়, আর সর্ববহিঃস্থ স্তরে আটটি ইলেকট্রন থাকলে তারা সেই স্থিতিশীলতা অর্জন করে। এই স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য পরমাণুরা ইলেকট্রন শেয়ার করে বা গ্রহণ-বর্জন করে রাসায়নিক বন্ধন (chemical bonds) তৈরি করে।
অষ্টক নিয়ম কিভাবে কাজ করে?
অষ্টক নিয়ম কাজ করার মূল কৌশল হলো ইলেকট্রন আদান-প্রদান অথবা শেয়ার করা। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
-
সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCI) গঠন: সোডিয়ামের (Na) সর্ববহিঃস্থ স্তরে ১টি ইলেকট্রন থাকে, যা সে ত্যাগ করতে চায়। ক্লোরিনের (CI) সর্ববহিঃস্থ স্তরে ৭টি ইলেকট্রন থাকে, তার ১টি ইলেকট্রন দরকার। তাই সোডিয়াম একটি ইলেকট্রন ক্লোরিনকে দিয়ে দেয়, ফলে উভয়ই অষ্টক পূর্তি করে এবং NaCI (সাধারণ লবণ) গঠিত হয়।
-
জল (H₂O) গঠন: অক্সিজেনের সর্ববহিঃস্থ স্তরে ৬টি ইলেকট্রন থাকে, তার ২টি ইলেকট্রন দরকার। হাইড্রোজেনের ১টি করে ইলেকট্রন আছে। তাই দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু অক্সিজেনের সাথে ইলেকট্রন শেয়ার করে জল তৈরি করে।
অষ্টক নিয়মের ব্যতিক্রম (Exceptions to the Octet Rule)
সব নিয়মেই কিছু ব্যতিক্রম থাকে, আর অষ্টক নিয়মেরও আছে। কিছু পরমাণু আছে, যারা অষ্টক পূরণ না করেও দিব্যি stable। এদের নিয়েই এখন আমরা আলোচনা করব।
অষ্টক সংকোচন (Incomplete Octet)
কিছু যৌগ আছে, যেখানে কেন্দ্রীয় পরমাণুর চারপাশে আটটির কম ইলেকট্রন থাকে। এদের মধ্যে বেরিলিয়াম (Be) এবং বোরন (B) উল্লেখযোগ্য।
-
বেরিলিয়াম ক্লোরাইড (BeCl₂): বেরিলিয়ামের সর্ববহিঃস্থ স্তরে ২টি ইলেকট্রন থাকে। প্রতিটি ক্লোরিন পরমাণুর সাথে একটি করে ইলেকট্রন শেয়ার করার পরেও বেরিলিয়ামের চারপাশে মোট ৪টি ইলেকট্রন থাকে।
-
বোরন ট্রাইফ্লুরাইড (BF₃): বোরনের সর্ববহিঃস্থ স্তরে ৩টি ইলেকট্রন থাকে। প্রতিটি ফ্লুরিন পরমাণুর সাথে একটি করে ইলেকট্রন শেয়ার করার পরেও বোরনের চারপাশে মোট ৬টি ইলেকট্রন থাকে।
কেন এমন হয়?
এই ধরনের পরমাণুগুলোর আকার ছোট হওয়ার কারণে এবং এদের উচ্চ চার্জ ঘনত্ব (high charge density) থাকার কারণে অষ্টক পূরণের জন্য যথেষ্ট ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারে না।
অষ্টক সম্প্রসারণ (Expanded Octet)
কিছু পরমাণু তাদের সর্ববহিঃস্থ স্তরে আটটির বেশি ইলেকট্রন ধারণ করতে পারে। সাধারণত তৃতীয় পর্যায় সারণির (3rd period) মৌলগুলো—যেমন ফসফরাস (P), সালফার (S), ক্লোরিন (CI)—এই ধরনের যৌগ গঠন করে।
-
ফসফরাস পেন্টাক্লোরাইড (PCI₅): ফসফরাসের চারপাশে ৫টি ক্লোরিন পরমাণু থাকে, যার কারণে ফসফরাসের সর্ববহিঃস্থ স্তরে ১০টি ইলেকট্রন থাকে।
-
সালফার হেক্সাফ্লুরাইড (SF₆): সালফারের চারপাশে ৬টি ফ্লুরিন পরমাণু থাকে, তাই সালফারের সর্ববহিঃস্থ স্তরে ১২টি ইলেকট্রন থাকে।
কী কারণে অষ্টক সম্প্রসারণ ঘটে?
তৃতীয় পর্যায়ের মৌলগুলোর d-অরবিটাল (d-orbital) ব্যবহারের সুযোগ থাকে। এই d-অরবিটাল অতিরিক্ত ইলেকট্রন ধারণ করতে পারে, যার ফলে অষ্টক সম্প্রসারণ সম্ভব হয়।
বিজোড় ইলেকট্রন অণু (Odd-Electron Molecules)
কিছু অণু আছে যেখানে পরমাণুর সংখ্যা বিজোড় (odd number)। এই কারণে কোনো না কোনো পরমাণুর সর্ববহিঃস্থ স্তরে একটি বিজোড় ইলেকট্রন থেকে যায়।
-
নাইট্রিক অক্সাইড (NO): নাইট্রোজেনের ৫টি এবং অক্সিজেনের ৬টি ইলেকট্রন মিলিয়ে মোট ১১টি ইলেকট্রন থাকে। তাই নাইট্রোজেনের চারপাশে একটি বিজোড় ইলেকট্রন থাকে।
-
নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO₂): নাইট্রোজেনের ৫টি এবং দুটি অক্সিজেনের ১২টি ইলেকট্রন মিলিয়ে মোট ১৭টি ইলেকট্রন থাকে। ফলে নাইট্রোজেনের চারপাশে একটি বিজোড় ইলেকট্রন থাকে।
এদের বৈশিষ্ট্য কী?
এই যৌগগুলো সাধারণত খুবই সক্রিয় (reactive) হয় এবং সহজে অন্য যৌগের সাথে বিক্রিয়া করতে পারে।
অষ্টক নিয়মের গুরুত্ব (Importance of Octet Rule)
অষ্টক নিয়ম রসায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এর মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন যৌগের গঠন, স্থিতিশীলতা এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি।
-
যৌগের গঠন বোঝা: কোনো যৌগ কিভাবে গঠিত হবে, সেটি কোন পরমাণু দিয়ে গঠিত এবং তাদের মধ্যে বন্ধন কেমন হবে, তা আমরা অষ্টক নিয়মের সাহায্যে বুঝতে পারি।
-
রাসায়নিক বিক্রিয়া: কোন পরমাণু ইলেকট্রন দেবে আর কে নেবে, সেটিও অষ্টক নিয়ম থেকে বোঝা যায়।
-
স্থিতিশীলতা: কেন কিছু যৌগ স্থিতিশীল এবং কিছু অস্থায়ী, তার ব্যাখ্যাও অষ্টক নিয়ম দিতে পারে।
অষ্টক নিয়ম এবং লুইস ডট গঠন (Octet Rule and Lewis Dot Structures)
লুইস ডট গঠন হলো কোনো অণুতে পরমাণুগুলোর মধ্যে ইলেকট্রন কিভাবে বণ্টিত আছে, তা দেখানোর একটি সহজ উপায়। এই গঠনে পরমাণুর চারপাশে ডট দিয়ে ইলেকট্রন বোঝানো হয়। অষ্টক নিয়ম মেনে লুইস ডট গঠন তৈরি করা হয়।
লুইস ডট গঠন লেখার নিয়ম
- প্রথমে যৌগের প্রতিটি পরমাণুর যোজ্যতা ইলেকট্রন (valence electron) সংখ্যা বের করুন।
- এরপর পরমাণুগুলোকে এমনভাবে সাজান যাতে সবচেয়ে কম তড়িৎ ঋণাত্মক (electronegative) পরমাণু কেন্দ্রে থাকে।
- অষ্টক পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনগুলো চিহ্নিত করুন।
- পরমাণুগুলোর মধ্যে বন্ধন তৈরি করুন (ডট দিয়ে ইলেকট্রন দেখান)।
- অবশিষ্ট ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর চারপাশে বসিয়ে দিন, যাতে অষ্টক পূরণ হয়।
উদাহরণ: কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO₂)
- কার্বনের যোজ্যতা ইলেকট্রন: ৪
- অক্সিজেনের যোজ্যতা ইলেকট্রন: ৬
- মোট ইলেকট্রন: ৪ + (২ x ৬) = ১৬
কার্বন পরমাণু কেন্দ্রে থাকবে, এবং দুটি অক্সিজেন পরমাণু দুই পাশে থাকবে। কার্বন দুটি অক্সিজেন পরমাণুর সাথে দুটি করে ইলেকট্রন শেয়ার করে দ্বিবন্ধন (double bond) তৈরি করবে। ফলে প্রতিটি পরমাণুর অষ্টক পূরণ হবে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQs)
আপনার মনে অষ্টক নিয়ম নিয়ে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। তাই কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
অষ্টক নিয়ম কী সবসময় মেনে চলতে হয়?
না, অষ্টক নিয়ম সবসময় মেনে চলতে হয় না। অষ্টক সংকোচন, সম্প্রসারণ এবং বিজোড় ইলেকট্রন অণুগুলো অষ্টক নিয়মের ব্যতিক্রম।
কোন মৌলগুলো অষ্টক নিয়ম মেনে চলে?
বেশিরভাগ দ্বিতীয় পর্যায়ের (2nd period) মৌলগুলো, যেমন কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন—এরা অষ্টক নিয়ম মেনে চলে।
অষ্টক নিয়ম কেন গুরুত্বপূর্ণ?
অষ্টক নিয়ম রাসায়নিক বন্ধন এবং যৌগের গঠন বুঝতে সহায়ক। এটি স্থিতিশীলতা এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতেও কাজে লাগে।
লুইস ডট গঠন কী?
লুইস ডট গঠন হলো যৌগের পরমাণুগুলোর মধ্যে ইলেকট্রন কিভাবে বণ্টিত আছে, তা দেখানোর একটি পদ্ধতি।
d-অরবিটাল কী এবং এটা কিভাবে অষ্টক সম্প্রসারণে সাহায্য করে?
d-অরবিটাল হলো পরমাণুর ইলেকট্রন স্তরের একটি অংশ, যা তৃতীয় পর্যায়ের মৌলগুলোতে থাকে। এটি অতিরিক্ত ইলেকট্রন ধারণ করতে পারে এবং অষ্টক সম্প্রসারণে সাহায্য করে।
অষ্টক নিয়ম: আধুনিক রসায়নের ভিত্তি
অষ্টক নিয়ম রসায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা আমাদের পরমাণু এবং অণুগুলোর আচরণ বুঝতে সাহায্য করে। যদিও এর কিছু ব্যতিক্রম আছে, তবুও এটি রসায়নের অনেক সমস্যার সমাধানে আমাদের পথ দেখায়। অষ্টক নিয়ম ভালোভাবে বুঝলে রসায়ন আপনার কাছে আরও সহজ হয়ে যাবে, আর আপনি রসায়নের জটিল জগৎকে আরও ভালোভাবে চিনতে পারবেন।
এখন, আপনি যদি রসায়নের আরও গভীরে ডুব দিতে চান, তাহলে পর্যায় সারণি (periodic table), রাসায়নিক বন্ধন (chemical bonding) এবং অন্যান্য মৌলিক ধারণাগুলো ভালোভাবে জেনে নিতে পারেন। শুভকামনা!