শুরু করছি! ধরুন, আপনার একটা দারুণ আইডিয়া আছে, কিন্তু সেটা বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো সময় বা দক্ষতা নেই। অথবা, এমন কিছু কাজ আছে যা আপনার ব্যবসার জন্য খুব দরকারি, কিন্তু সেগুলো করতে গিয়ে আপনার মূল কাজে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ঠিক এই সময়েই কিন্তু আউটসোর্সিং আপনার সেরা বন্ধু হতে পারে! আসুন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা জেনে নিই “আউটসোর্সিং কাকে বলে” এবং কেন এটি এখন এত জনপ্রিয়।
আউটসোর্সিং কী? (Outsourcing Ki?)
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, আউটসোর্সিং মানে হলো নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করানো। আপনার কোম্পানির কিছু কাজ, যা হয়তো নিয়মিত করার প্রয়োজন হয়, কিন্তু আপনার মূল ব্যবসার অংশ নয়, সেই কাজগুলো অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করিয়ে নেওয়াকেই আউটসোর্সিং বলে। অনেকটা “কাজটা আমি নিজে না করে অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নিলাম” টাইপের ব্যাপার।
আউটসোর্সিং -কে অন্যভাবে বলতে গেলে, যখন কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তি তার নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া বা কাজ তৃতীয় কোনো পক্ষকে চুক্তিভিত্তিক (contractual basis) সম্পন্ন করার জন্য দেয়, তখন তাকে আউটসোর্সিং বলে। এই তৃতীয় পক্ষ সাধারণত সেই কাজে বিশেষভাবে দক্ষ হয়ে থাকে।
আউটসোর্সিং কেন এত জনপ্রিয়?
আউটসোর্সিং জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ তুলে ধরা হলো:
- খরচ কমানো: অনেক সময় অন্য কোনো দেশ বা অঞ্চলের কোম্পানি একই কাজ কম খরচে করে দিতে পারে। এতে আপনার কোম্পানির খরচ বাঁচে।
- দক্ষতা বৃদ্ধি: কিছু বিশেষ কাজ করার জন্য আপনার কোম্পানিতে হয়তো সেই মুহূর্তে দক্ষ লোক নেই। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আপনি সেই কাজটি দক্ষ কাউকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারেন।
- সময় বাঁচানো: কিছু কাজ করতে অনেক সময় লাগে, যা আপনার মূল ব্যবসায়ের গতি কমিয়ে দিতে পারে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সেই সময় বাঁচিয়ে আপনি আপনার মূল কাজে মনোযোগ দিতে পারেন।
- গুণগত মান বৃদ্ধি: যেহেতু কাজটি একজন বিশেষজ্ঞ করছেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই এর গুণগত মান ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- নতুন প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়ার ব্যবহার : তৃতীয় পক্ষ আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়ার ব্যবহার করে, যা আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
আউটসোর্সিং এর প্রকারভেদ (Types of Outsourcing)
আউটসোর্সিং বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, কাজের ধরন এবং দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে। নিচে বহুল ব্যবহৃত কয়েকটি প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
১. অফশোর আউটসোর্সিং (Offshore Outsourcing)
যখন একটি কোম্পানি তার কাজ অন্য কোনো দেশের কোম্পানিকে দিয়ে করায়, তখন তাকে অফশোর আউটসোর্সিং বলে। এক্ষেত্রে, সাধারণত খরচ কমানোই মূল উদ্দেশ্য থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশে শ্রমিকের মজুরি বিভিন্ন রকম হয়।
২. নিয়ারশোর আউটসোর্সিং (Nearshore Outsourcing)
যখন একটি কোম্পানি তার পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের কোম্পানিকে কাজ দেয়, তখন তাকে নিয়ারশোর আউটসোর্সিং বলে। এক্ষেত্রে, ভাষার সমস্যা এবং সংস্কৃতির পার্থক্য কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩. অনশোর আউটসোর্সিং (Onshore Outsourcing)
যখন একটি কোম্পানি তার নিজের দেশের অন্য কোনো শহর বা অঞ্চলের কোম্পানিকে কাজ দেয়, তখন তাকে অনশোর আউটসোর্সিং বলে। এক্ষেত্রে, যোগাযোগ এবং কাজের তত্ত্বাবধান করা সহজ হয়।
৪. মাল্টিসোর্সিং (Multisourcing)
মাল্টিসোর্সিং হল একটি কৌশল যেখানে একটি কোম্পানি বিভিন্ন উৎস থেকে আউটসোর্সিং পরিষেবা গ্রহণ করে।
৫. বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) Business Process Outsourcing (BPO)
বিপিও হল একটি নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক কাজ বা প্রক্রিয়ার আউটসোর্সিং।
*ফ্রন্ট-অফিস বিপিও: গ্রাহক পরিষেবা, বিক্রয় এবং বিপণন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত।
*ব্যাক-অফিস বিপিও: মানব সম্পদ, অর্থ, অ্যাকাউন্টিং এবং তথ্য প্রযুক্তি পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত।
আউটসোর্সিং কিভাবে কাজ করে? (Outsourcing Kivabe Kaj Kore?)
আউটসোর্সিংয়ের প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। নিচে ধাপগুলো আলোচনা করা হলো:
১. প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করা: প্রথমে, আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে আপনার কোম্পানির কোন কাজগুলো আউটসোর্স করা যেতে পারে।
২. আউটসোর্সিং প্রদানকারী নির্বাচন: এরপর, সেই কাজগুলো করার জন্য উপযুক্ত কোম্পানি বা ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে। তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং মূল্য বিবেচনা করতে হবে।
৩. চুক্তি সম্পাদন: কাজের পরিধি, সময়সীমা, মূল্য এবং অন্যান্য শর্তাবলী উল্লেখ করে একটি চুক্তি করতে হবে।
৪. কাজ শুরু এবং তত্ত্বাবধান: কাজ শুরু হওয়ার পর নিয়মিতভাবে তার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দিকনির্দেশনা দিতে হবে।
5. মূল্যায়ন এবং প্রতিক্রিয়া: কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পরে, তার গুণগত মান মূল্যায়ন করতে হবে এবং আউটসোর্সিং প্রদানকারীর কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া নিতে হবে।
এখানে একটি টেবিলের সাহায্যে বিষয়গুলো আরও সহজে উপস্থাপন করা হলো:
ধাপ | বিবরণ |
---|---|
১ | প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করা |
২ | আউটসোর্সিং প্রদানকারী নির্বাচন |
৩ | চুক্তি সম্পাদন |
৪ | কাজ শুরু এবং তত্ত্বাবধান |
৫ | মূল্যায়ন এবং প্রতিক্রিয়া |
বাংলাদেশে আউটসোর্সিংয়ের সুযোগ (Bangladesh e Outsourcing er Sujog)
বাংলাদেশ এখন একটি উদীয়মান আউটসোর্সিং হাব। এখানে কম খরচে দক্ষ কর্মী পাওয়া যায়। বিশেষ করে, তথ্যপ্রযুক্তি (Information Technology) এবং তৈরি পোশাক (RMG) খাতে আউটসোর্সিংয়ের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং কি একই?
অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং (Freelancing) এবং আউটসোর্সিংকে এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আউটসোর্সিং হলো একটি কোম্পানির কাজ অন্য কোম্পানিকে দেওয়া, অন্যদিকে ফ্রিল্যান্সিং হলো একজন ব্যক্তি স্বাধীনভাবে বিভিন্ন কোম্পানির কাজ করা। ফ্রিল্যান্সিং একটি ব্যক্তি কেন্দ্রিক, যেখানে আউটসোর্সিং একটি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক প্রক্রিয়া।
আউটসোর্সিংয়ের সুবিধা ও অসুবিধা (Advantages and Disadvantages of Outsourcing)
যেকোনো জিনিসেরই কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা থাকে। আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। নিচে এর কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা আলোচনা করা হলো:
সুবিধা:
- খরচ সাশ্রয়
- দক্ষতা বৃদ্ধি
- সময়ের সাশ্রয়
- গুণগত মান বৃদ্ধি
- মূল ব্যবসায় মনোযোগ
- ঝুঁকি হ্রাস
- নমনীয়তা (Flexibility)
অসুবিধা:
- যোগাযোগের সমস্যা
- গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ
- তথ্য গোপনীয়তা ঝুঁকি
- নির্ভরতা বৃদ্ধি
- সাংস্কৃতিক পার্থক্য
- বেকারত্ব বৃদ্ধি (কিছু ক্ষেত্রে)
আউটসোর্সিং করার আগে কিছু টিপস (Outsourcing korar age kichu tips)
আউটসোর্সিং করার আগে কিছু বিষয় মনে রাখা দরকার। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টিপস দেওয়া হলো:
- নিজের প্রয়োজন ভালোভাবে বুঝুন।
- আউটসোর্সিং প্রদানকারীর সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন।
- চুক্তি করার আগে সব শর্তাবলী ভালোভাবে পড়ে নিন।
- নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন।
- কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করুন।
- গুণগত মান নিশ্চিত করুন।
- প্রয়োজনে আইনি পরামর্শ নিন।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (Frequently Asked Questions – FAQs)
আউটসোর্সিং নিয়ে অনেকের মনেই অনেক প্রশ্ন থাকে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. আউটসোর্সিং কি সব ব্যবসার জন্য উপযোগী?
উত্তরঃ না, আউটসোর্সিং সব ব্যবসার জন্য উপযোগী নয়। এটি মূলত সেই সব ব্যবসার জন্য উপযোগী, যেখানে কিছু নির্দিষ্ট কাজ নিয়মিতভাবে করার প্রয়োজন হয়, কিন্তু সেগুলো মূল ব্যবসার অংশ নয়।
২. আউটসোর্সিংয়ের জন্য কোন কাজগুলো সবচেয়ে উপযুক্ত?
উত্তরঃ সাধারণত, তথ্যপ্রযুক্তি, গ্রাহক পরিষেবা, হিসাবরক্ষণ, মানবসম্পদ এবং বিপণন সম্পর্কিত কাজগুলো আউটসোর্সিংয়ের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
৩. কিভাবে একটি ভালো আউটসোর্সিং প্রদানকারী খুঁজে পাব?
উত্তরঃ ভালো আউটসোর্সিং প্রদানকারী খুঁজে বের করার জন্য তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, খ্যাতি এবং গ্রাহক পর্যালোচনা দেখতে পারেন। এছাড়াও, তাদের কাজের নমুনা এবং পূর্ববর্তী কাজের উদাহরণ দেখতে পারেন।
৪. ছোট ব্যবসার জন্য আউটসোর্সিং কতটা কার্যকর?
ছোট ব্যবসার জন্য আউটসোর্সিং খুবই কার্যকর হতে পারে। এর মাধ্যমে তারা তাদের সীমিত সম্পদকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করতে পারে এবং বিশেষ দক্ষতা ও প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারে, যা তাদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে সাহায্য করে।
৫. আউটসোর্সিং কি স্থানীয় চাকরির বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে?
আউটসোর্সিং কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় চাকরির সুযোগ কমাতে পারে, তবে এটি নতুন দক্ষতা এবং শিল্পের বিকাশেও সাহায্য করে। এটি একটি জটিল বিষয় যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় দিকেই প্রভাব ফেলে।
আউটসোর্সিং এর ভবিষ্যৎ (Future of Outsourcing)
আউটসোর্সিং ২০২৩ সালের মধ্যে একটি বিশাল শিল্পে পরিণত হয়েছে এবং ২০২৭ সাল নাগাদ এর বাজার প্রায় ৩৯৫.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস রয়েছে।
আউটসোর্সিংয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Artificial Intelligence) এবং অটোমেশনের (Automation) উন্নতির সাথে সাথে, আউটসোর্সিংয়ের সুযোগ আরও বাড়বে। ভবিষ্যতে, কোম্পানিগুলো তাদের কোর বিজনেস ( মূল ব্যবসা ) এর উপর বেশি মনোযোগ দিতে পারবে এবং অন্যান্য কাজগুলো আউটসোর্স করে করিয়ে নিতে পারবে।
আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি থেকে “আউটসোর্সিং কাকে বলে” এবং এটি কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে আপনারা একটি স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। আউটসোর্সিং আপনার ব্যবসাকে আরও সফল করতে কিভাবে সাহায্য করতে পারে, তা নিয়ে আরও জানতে আমাদের সাথে থাকুন। আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন!