আসুন শুরু করি!
আচ্ছা, কখনো কি এমন হয়েছে যে আপনি একটি আম গাছ থেকে পড়তে দেখেছেন, আর আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে – কেন আমটি উপরে না গিয়ে সোজা নিচে পড়ল? অথবা, আপনি একটি ঢিল ছুঁড়লেন, আর সেটি কিছুদূর গিয়ে মাটিতে পড়ল? এর পেছনে একটাই কারণ, আর সেটা হল “অভিকর্ষ বল” ( অভিকর্ষ বল কাকে বলে)। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই অভিকর্ষ বল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, একদম সহজ ভাষায়। যেন আপনি, আমি, আমরা সবাই বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে পারি।
অভিকর্ষ বল কী? (What is Gravity?)
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অভিকর্ষ বল হলো সেই আকর্ষণ শক্তি যা দুটি বস্তুকে একে অপরের দিকে টানে। যাদের ভর আছে, এমন যেকোনো দুটি বস্তুর মধ্যেই এই আকর্ষণ বিদ্যমান। আমাদের এই মহাবিশ্বের সবকিছুই একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এই বলের কারণে।
বিষয়টা আরও একটু বুঝিয়ে বলা যাক। ধরুন, আপনার হাতে একটা আপেল আছে। আপেলটির ভর আছে, আবার পৃথিবীরও ভর আছে। তাই আপেল এবং পৃথিবী উভয়েই একে অপরের দিকে টান অনুভব করে। যেহেতু পৃথিবীর ভর আপেলের চেয়ে অনেক বেশি, তাই আপেলটি পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে – মানে নিচে পড়ে। নিউটনের ভাষায়, এটাই অভিকর্ষ বল!
আরও গভীরে: অভিকর্ষ বলের সংজ্ঞা (Definition of Gravitational Force)
পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়, “দুটি বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ বল, যা বস্তুদ্বয়ের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক, তাকে অভিকর্ষ বল বলে।”
এই সংজ্ঞাটা একটু কঠিন মনে হচ্ছে, তাই না? চলুন, একটু ভেঙে বলা যাক:
- ভরের গুণফলের সমানুপাতিক: মানে, বস্তুগুলোর ভর যত বেশি হবে, তাদের মধ্যে আকর্ষণ তত বেশি হবে।
- মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক: মানে, বস্তুগুলোর মধ্যে দূরত্ব যত বাড়বে, আকর্ষণ তত কমবে। আর এই কমাটা হবে দূরত্বের বর্গ অনুসারে। তার মানে দূরত্ব দ্বিগুণ হলে আকর্ষণ চারগুণ কমে যাবে!
অভিকর্ষ বলের ইতিহাস (History of Gravitational Force)
অভিকর্ষ বলের ধারণা কিন্তু একদিনে আসেনি। বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে গবেষণা করেছেন।
প্রাচীন ধারণা (Ancient Theories)
প্রাচীনকালে মানুষ মনে করত, সবকিছুই পৃথিবীর কেন্দ্রে এসে মিশে যায়। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ভারী বস্তু হালকা বস্তুর চেয়ে দ্রুত মাটিতে পড়ে। তবে এইসব ধারণার কোনো বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি ছিল না।
নিউটনের অবদান (Newton’s Contribution)
স্যার আইজ্যাক নিউটন সর্বপ্রথম অভিকর্ষ বলের একটি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেন। ১৬৮৭ সালে তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ “ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা”-তে তিনি মহাকর্ষের সূত্র (Law of Universal Gravitation) প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণ বল বস্তুদ্বয়ের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক ও তাদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (Einstein’s Theory of Relativity)
আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে তার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (Theory of Relativity) দিয়ে অভিকর্ষ বলের ধারণাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি বলেন, অভিকর্ষ বল কোনো আকর্ষণ শক্তি নয়, বরং স্থান-কালের বক্রতার (Curvature of Space-Time) ফল। তার মতে, ভর স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়, এবং এর ফলে অন্যান্য বস্তু সেই বক্র পথে চলতে বাধ্য হয়।
অভিকর্ষ বলের প্রভাব (Effects of Gravitational Force)
আমাদের জীবনে অভিকর্ষ বলের প্রভাব ব্যাপক। এটা না থাকলে আমাদের জীবনযাত্রা কেমন হতো, সেটা কল্পনাও করা যায় না।
পৃথিবীতে আমাদের টিকে থাকা (Our Existence on Earth)
অভিকর্ষ বলের কারণেই আমরা পৃথিবীর পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। এটা না থাকলে আমরা সবাই মহাশূন্যে ভেসে বেড়াতাম!
গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথে ঘূর্ণন (Planetary Orbits)
সূর্যের অভিকর্ষ বলের কারণে পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে। যদি অভিকর্ষ বল না থাকত, তাহলে গ্রহগুলো মহাশূন্যে ছিটকে যেত।
জোয়ার-ভাটা (Tides)
চাঁদের অভিকর্ষ বলের কারণে সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা হয়। চাঁদ পৃথিবীকে যে বলে আকর্ষণ করে, তার প্রভাবে সমুদ্রের পানি ফুলে ওঠে।
বৃষ্টি এবং নদীর স্রোত (Rain and River Flow)
বৃষ্টির পানি অভিকর্ষ বলের টানেই আকাশ থেকে নিচে নেমে আসে। আর নদীর পানি উঁচু স্থান থেকে নিচু স্থানের দিকে প্রবাহিত হয় অভিকর্ষ বলের কারণেই।
অভিকর্ষজ ত্বরণ (Acceleration due to Gravity)
কোনো বস্তু যখন অভিকর্ষ বলের প্রভাবে মুক্তভাবে নিচে পড়ে, তখন তার মধ্যে যে ত্বরণ সৃষ্টি হয়, তাকে অভিকর্ষজ ত্বরণ বলে। একে সাধারণত ‘g’ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। পৃথিবীর পৃষ্ঠে এর মান প্রায় ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড²।
অভিকর্ষজ ত্বরণের তাৎপর্য (Significance of Acceleration due to Gravity)
অভিকর্ষজ ত্বরণ আমাদের জানায়, কোনো বস্তু প্রতি সেকেন্ডে কত দ্রুত নিচে পড়ছে। এর মান স্থানভেদে সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে, কারণ পৃথিবীর আকৃতি পুরোপুরি গোল নয় এবং এর ভর সর্বত্র সমানভাবে বণ্টিত নয়।
অভিকর্ষজ ত্বরণের পরিমাপ (Measurement of Acceleration due to Gravity)
বিভিন্ন স্থানে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান নির্ণয় করার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। এর মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন এবং ঘনত্বের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন, মেরু অঞ্চলে এর মান বিষুব অঞ্চলের চেয়ে একটু বেশি।
মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র (Gravitational Field)
মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র হলো কোনো বস্তুর চারপাশে সেই অঞ্চল, যেখানে অন্য কোনো বস্তু রাখলে সেটি অভিকর্ষ বল অনুভব করে।”
মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের তীব্রতা (Intensity of Gravitational Field)
মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে একক ভরের কোনো বস্তু যে বল অনুভব করে, তাকে ঐ বিন্দুর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের তীব্রতা বলে।
মহাকর্ষীয় বিভব (Gravitational Potential)
মহাকর্ষীয় বিভব হলো কোনো বস্তুকে অসীম দূরত্ব থেকে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে আনতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়।”
বিভিন্ন গ্রহে অভিকর্ষ বল (Gravity on Different Planets)
বিভিন্ন গ্রহের ভর এবং আকারের ভিন্নতার কারণে অভিকর্ষ বলের মানও ভিন্ন হয়।
গ্রহের নাম | অভিকর্ষজ ত্বরণ (g) (মি/সেকেন্ড²) | পৃথিবীর তুলনায় আপেক্ষিক অভিকর্ষ |
---|---|---|
বুধ | ৩.৭ | ০.৩৮ |
শুক্র | ৮.৯ | ০.৯০ |
পৃথিবী | ৯.৮ | ১.০০ |
মঙ্গল | ৩.৭ | ০.৩৮ |
বৃহস্পতি | ২৪.৮ | ২.৫৪ |
শনি | ১০.৪ | ১.০৬ |
ইউরেনাস | ৮.৭ | ০.৮৯ |
নেপচুন | ১১.২ | ১.১৪ |
এই তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, বৃহস্পতি গ্রহে অভিকর্ষ বলের মান সবচেয়ে বেশি, আর বুধ ও মঙ্গলে প্রায় সমান এবং পৃথিবীর চেয়ে কম।
অভিকর্ষ বলের ব্যবহার (Uses of Gravitational Force)
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অভিকর্ষ বলের অনেক ব্যবহার রয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন (Electricity Generation)
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে অভিকর্ষ বলকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
পরিবহন (Transportation)
পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় অভিকর্ষ বলের ধারণা কাজে লাগে। ঢালু পথে গাড়ি সহজে চলতে পারে।
নির্মাণ কাজ (Construction Work)
নির্মাণ কাজে ভারোত্তোলন এবং অন্যান্য কাজে অভিকর্ষ বলের ধারণা ব্যবহার করা হয়।
অভিকর্ষ বল নিয়ে কিছু মজার তথ্য (Fun Facts About Gravity)
- মহাশূন্যে নভোচারীরা ভেসে বেড়ান, কারণ সেখানে অভিকর্ষ বল খুবই কম।
- চাঁদে অভিকর্ষ বল পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ। তাই সেখানে কোনো জিনিসকে তুললে তা পৃথিবীর চেয়ে ছয়গুণ হালকা মনে হবে।
- ব্ল্যাক হোলের অভিকর্ষ বল এত বেশি যে, আলো পর্যন্ত এর থেকে পালাতে পারে না!
অভিকর্ষ বল নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs about Gravitational Force)
এখানে অভিকর্ষ বল নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর আলোচনা করা হলো:
অভিকর্ষ বলের সূত্র আবিষ্কার করেন কে?
স্যার আইজ্যাক নিউটন অভিকর্ষ বলের সূত্র আবিষ্কার করেন। তিনি ১৬৮৭ সালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ “ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা”-তে এই সূত্র প্রকাশ করেন।
পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষ বলের মান কত?
theoretically পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষ বলের মান শূন্য। কারণ, কেন্দ্রের চারদিকে সমান ভরের আকর্ষণ পরস্পরকে প্রশমিত করে। আপনি যদি পৃথিবীর কেন্দ্রে যেতে পারতেন, তাহলে নিজেকে ওজনহীন মনে হতো।
অভিকর্ষ বল কি সর্বদা আকর্ষণ করে, নাকি বিকর্ষণও করে?
“ভরযুক্ত বস্তুর ক্ষেত্রে অভিকর্ষ বল কেবল আকর্ষণধর্মী। এর কোনো বিকর্ষণধর্মী প্রভাব নেই।”
আলোর উপর অভিকর্ষ বলের প্রভাব আছে কি?
“হ্যাঁ, আলোর উপর অভিকর্ষ বলের প্রভাব আছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, ভর স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়, যার ফলে আলোর গতিপথও বেঁকে যায়।”
অভিকর্ষ বল এবং মহাকর্ষ বলের মধ্যে পার্থক্য কী?
“মহাকর্ষ বল হলো যেকোনো দুটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল। আর অভিকর্ষ বল হলো পৃথিবী এবং অন্য কোনো বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল। অর্থাৎ, অভিকর্ষ বল মহাকর্ষ বলেরই একটি বিশেষ রূপ।”
“কৃত্রিম অভিকর্ষ” কিভাবে তৈরি করা হয়?
মহাকাশ স্টেশনে বা নভোযানে কৃত্রিম অভিকর্ষ তৈরি করার জন্য ঘূর্ণন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যখন কোনো নভোযান ঘুরতে শুরু করে, তখন এর ভেতরের বস্তুগুলো কেন্দ্রবিমুখী বল (centrifugal force) অনুভব করে, যা অভিকর্ষের মতো কাজ করে। যত দ্রুত নভোযানটি ঘুরবে, ভেতরের “অভিকর্ষ” তত বেশি হবে।
অভিকর্ষ বলের দুর্বলতা কোথায়?
compared to other fundamental forces like the electromagnetic force, the weak nuclear force, and the strong nuclear force. এর দুর্বল হওয়ার মূল কারণ হলো এর মধ্যস্থতাকারী কণা ( mediating praticle) ” graviton ” এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি।
উপসংহার (Conclusion)
অভিকর্ষ বল আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সাথে জড়িত। এটা শুধু একটি আকর্ষণ শক্তি নয়, এটি মহাবিশ্বের গঠন এবং কার্যকারিতার একটি মৌলিক অংশ। আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি পড়ার পর আপনি অভিকর্ষ বল সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। যদি আপনার মনে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন।
যদি এই লেখাটি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আপনার একটি শেয়ার হয়তো অনেকের কাছে এই জটিল বিষয়টি সহজ করে তুলতে পারে।”