আসুন, মহাকর্ষীয় ত্বরণের রহস্যভেদ করি! পদার্থবিদ্যাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, একদম সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছি।
কখনো ভেবেছেন, কেন আপেল গাছ থেকে পড়লে সোজা মাটিতেই এসে পরে? কেন ক্রিকেট বল উপরের দিকে ছুড়লে আবার নিচে নেমে আসে? এর পেছনে কাজ করছে এক অদৃশ্য শক্তি – মহাকর্ষ বল। আর এই মহাকর্ষ বলের প্রভাবে কোনো বস্তুর যে ত্বরণ হয়, সেটাই হলো অভিকর্ষ ত্বরণ।
অভিকর্ষ ত্বরণ (Acceleration due to Gravity): সহজ ভাষায় সংজ্ঞা
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অভিকর্ষ ত্বরণ হলো পৃথিবীর আকর্ষণে কোনো বস্তুর বেগ প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ বাড়ে, সেটাই। এটাকে সাধারণত “g” দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এর মান প্রায় 9.8 m/s²। তার মানে, কোনো বস্তুকে ফেললে তার বেগ প্রতি সেকেন্ডে 9.8 মিটার করে বাড়তে থাকবে।
অভিকর্ষ ত্বরণ কিভাবে কাজ করে?
মনে করুন, আপনি একটি বল উপর দিকে ছুঁড়লেন। বলটি যখন উপরের দিকে উঠতে থাকে, তখন অভিকর্ষ বল এর গতিকে কমিয়ে দেয়। একটা সময় বলটি থেমে যায়, তারপর আবার নিচের দিকে নামতে শুরু করে। নিচে নামার সময় অভিকর্ষ বল বলের গতি বাড়াতে থাকে।
অভিকর্ষ ত্বরণের মান (Value of g)
অভিকর্ষ ত্বরণের আদর্শ মান হলো 9.80665 m/s², তবে একে প্রায় 9.8 m/s² ধরা হয়। এই মানটি পৃথিবীর সকল স্থানে সমান নয়। কয়েকটি কারণে এর মান পরিবর্তিত হয়। যেমন –
- উচ্চতা: পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে যত উপরে ওঠা যায়, অভিকর্ষ ত্বরণের মান তত কমতে থাকে। কারণ, পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে দূরত্ব বাড়লে মহাকর্ষ বলের প্রভাব কমে যায়।
- অক্ষাংশ: পৃথিবীর আকৃতি পুরোপুরি গোল না হওয়ার কারণে অক্ষাংশের পরিবর্তনের সাথে সাথে অভিকর্ষ ত্বরণের মানেরও পরিবর্তন হয়। মেরু অঞ্চলে অভিকর্ষ ত্বরণের মান সবচেয়ে বেশি (প্রায় 9.83 m/s²) এবং বিষুবরেখায় এর মান সবচেয়ে কম (প্রায় 9.78 m/s²)।
- গভীরতা: পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে, অভিকর্ষ ত্বরণের মান কমতে থাকে, কারণ উপরে থাকা পৃথিবীর ভর নিজের কেন্দ্রের দিকে টানে।
অভিকর্ষ ত্বরণ এবং মহাকর্ষীয় ধ্রুবক (Gravitational Constant or G)
অভিকর্ষ ত্বরণ এবং মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী, দুটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল তাদের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এই সূত্রে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক (G) ব্যবহার করা হয়।
G এর মান হলো 6.674 × 10⁻¹¹ N(m/kg)²। অভিকর্ষ ত্বরণ (g) এবং মহাকর্ষীয় ধ্রুবক (G) এর মধ্যে সম্পর্ক হলো: g = GM/R², যেখানে M হলো পৃথিবীর ভর এবং R হলো পৃথিবীর ব্যাসার্ধ।
অভিকর্ষ ত্বরণের প্রভাব
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অভিকর্ষ ত্বরণের অনেক প্রভাব রয়েছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- বস্তুর ওজন: কোনো বস্তুর ওজন হলো পৃথিবীর আকর্ষণে সেই বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল। অভিকর্ষ ত্বরণ না থাকলে কোনো বস্তুর ওজন থাকত না।
- নদীর প্রবাহ: নদী সবসময় উঁচু স্থান থেকে নিচু স্থানের দিকে প্রবাহিত হয়, কারণ অভিকর্ষ বল পানিকে নিচের দিকে টানে।
- বৃষ্টি: বৃষ্টির ফোঁটা আকাশ থেকে মাটিতে পরে অভিকর্ষ টানের কারণেই।
- গাছপালা: গাছপালা মাটি থেকে রস টেনে নেয় অভিকর্ষ বলের কারণে।
অভিকর্ষ ত্বরণ পরিমাপের পদ্ধতি
অভিকর্ষ ত্বরণ পরিমাপের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটা নিচে উল্লেখ করা হলো:
- পেন্ডুলামের সাহায্যে: একটি সরল পেন্ডুলামের দোলনকাল পরিমাপ করে অভিকর্ষ ত্বরণ নির্ণয় করা যায়। দোলনকালের সূত্র ব্যবহার করে g এর মান বের করা হয়।
- মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর সাহায্যে: কোনো বস্তুকে উপর থেকে ফেলে দিয়ে তার পতনের সময় নির্ণয় করে অভিকর্ষ ত্বরণ মাপা যায়। এক্ষেত্রে বস্তুর সরণ এবং সময় পরিমাপ করে গতির সূত্র ব্যবহার করে g এর মান বের করা হয়।
- গ্রাভিমিটারের সাহায্যে: গ্রাভিমিটার হলো একটি বিশেষ যন্ত্র, যা অভিকর্ষ ত্বরণের সূক্ষ্ম পরিবর্তন পরিমাপ করতে পারে। এই যন্ত্র ব্যবহার করে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান এবং ভূতাত্ত্বিক জরিপ করা হয়।
অভিকর্ষ ত্বরণ : কিছু মজার তথ্য
- চাঁদে অভিকর্ষ ত্বরণের মান পৃথিবীর মানের প্রায় ১/৬ ভাগ। তাই সেখানে কোনো কিছুকে লাফিয়ে তুললে তা পৃথিবীর চেয়ে অনেক উপরে উঠবে।
- অন্যান্য গ্রহের অভিকর্ষ ত্বরণের মান ভিন্ন ভিন্ন। বৃহস্পতি গ্রহে অভিকর্ষ ত্বরণের মান পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ২.৫ গুণ বেশি।
- যদি কোনো কারণে পৃথিবীর অভিকর্ষ ত্বরণ হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সবকিছু মহাশূন্যে ভেসে যাবে!
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (Gravitational Waves)
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হলো স্থান-কালের মধ্যে সৃষ্ট আলোড়ন, যা মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘটনাগুলো থেকে উৎপন্ন হয়। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন কোনো ভরযুক্ত বস্তু ত্বরণ লাভ করে, তখন এই তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। কৃষ্ণগহ্বর বা নিউট্রন তারার সংঘর্ষের মতো ঘটনাগুলো মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রধান উৎস। এই তরঙ্গ আলোর গতিতে ছড়িয়ে পরে এবং এদের অস্তিত্ব প্রমাণ করা বিজ্ঞানীদের জন্য এক বিশাল সাফল্য।
অভিকর্ষ ত্বরণ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
অভিকর্ষ ত্বরণ নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন থাকে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
অভিকর্ষ ত্বরণ কাকে বলে?
পৃথিবীর আকর্ষণ বলের কারণে কোনো বস্তুর বেগ বৃদ্ধির হারকে অভিকর্ষ ত্বরণ বলে। এর মান প্রায় 9.8 m/s²।
অভিকর্ষ ত্বরণের একক কি?
অভিকর্ষ ত্বরণের একক হলো মিটার প্রতি সেকেন্ড স্কয়ার (m/s²)।
g এর মান কোথায় সবচেয়ে বেশি?
g এর মান মেরু অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি।
g এর মান কোথায় সবচেয়ে কম?
g এর মান বিষুবরেখায় সবচেয়ে কম।
পৃথিবীর কেন্দ্রে g এর মান কত?
পৃথিবীর কেন্দ্রে g এর মান শূন্য।
অভিকর্ষ ত্বরণ কিভাবে বস্তুর ওজনকে প্রভাবিত করে?
বস্তুর ওজন হলো অভিকর্ষ বলের কারণে সেই বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল। তাই, অভিকর্ষ ত্বরণের পরিবর্তনের সাথে সাথে বস্তুর ওজনেরও পরিবর্তন হয়।
ভর ও ওজনের মধ্যে সম্পর্ক
ভর (Mass) হলো কোনো বস্তুতে পদার্থের পরিমাণ। এটা একটা ধ্রুব রাশি, যা স্থানভেদে পরিবর্তিত হয় না। অন্যদিকে, ওজন (Weight) হলো সেই বস্তুর উপর অভিকর্ষ বলের প্রভাব। যেহেতু অভিকর্ষ ত্বরণ স্থানভেদে ভিন্ন হয়, তাই বস্তুর ওজনও ভিন্ন হতে পারে।
ওজন = ভর × অভিকর্ষ ত্বরণ (W = mg)
অভিকর্ষ ত্বরণ এবং লিফটের গতি
লিফটে চড়লে অভিকর্ষ ত্বরণের একটা মজার প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। যখন লিফট উপরের দিকে যায়, তখন আমাদের ওজন সামান্য বেশি মনে হয়, কারণ লিফটের ত্বরণ অভিকর্ষ ত্বরণের সাথে যোগ হয়। আবার যখন লিফট নিচের দিকে নামে, তখন ওজন কিছুটা কম মনে হয়, কারণ লিফটের ত্বরণ অভিকর্ষ ত্বরণ থেকে বিয়োগ হয়। যদি লিফটের তার ছিঁড়ে যায়, তাহলে লিফট মুক্তভাবে পড়তে থাকলে আরোহীর ওজন শূন্য হয়ে যাবে!
শেষ কথা
অভিকর্ষ ত্বরণ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা শুধু পদার্থবিজ্ঞানের একটা সূত্র নয়, বরং আমাদের চারপাশের সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি পড়ার পর অভিকর্ষ ত্বরণ সম্পর্কে আপনার ধারণা স্পষ্ট হয়েছে এবং আপনি বিষয়টি আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। পদার্থবিদ্যাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, একটু মনোযোগ দিলেই সবকিছু সহজ হয়ে যায়।