আচ্ছা, ধরুন আপনি রংধনু দেখছেন! রংধনুর সাতটি রঙ যেমন সূর্যের আলোর বর্ণালী, তেমনই পারমাণবিক বর্ণালীও অনেকটা সেরকম। কিন্তু পার্থক্য হলো, রংধনুতে আমরা যা দেখি তা সূর্যের আলোর প্রতিসরণের ফল, আর পারমাণবিক বর্ণালী তৈরি হয় পরমাণুর ভেতরকার ইলেকট্রনের লাফালাফির কারণে! তাহলে চলুন, জেনে নিই এই পারমাণবিক বর্ণালী আসলে কী, কীভাবে তৈরি হয়, আর এর ভেতরের রহস্যটাই বা কী!
পারমাণবিক বর্ণালী: পরমাণুর পরিচয়পত্র
পারমাণবিক বর্ণালী (Atomic Spectrum) হলো কোনো মৌলিক পদার্থকে উত্তপ্ত করলে অথবা তার মধ্যে দিয়ে আলো পাঠালে যে বিশেষ রঙের আলোর রেখা বা ব্যান্ডের সৃষ্টি হয়, সেই আলোর সমষ্টি। প্রত্যেকটি মৌলিক পদার্থের পারমাণবিক বর্ণালী আলাদা হয়, অনেকটা মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো। তাই এই বর্ণালী দেখে সহজেই কোনো পদার্থকে শনাক্ত করা যায়। এই বর্ণালীকে পদার্থের “আঙুলের ছাপ” বলা যেতে পারে।
পারমাণবিক বর্ণালী কিভাবে সৃষ্টি হয়?
ব্যাপারটা একটু মজার। পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে (energy level) ঘোরে। এই স্তরগুলো অনেকটা সিঁড়ির ধাপের মতো, যেখানে প্রতিটি ধাপের শক্তি আলাদা। যখন কোনো ইলেকট্রন বাইরের উৎস থেকে শক্তি শোষণ করে, তখন সে লাফ দিয়ে ভেতরের স্তর থেকে বাইরের কোনো উচ্চ শক্তিস্তরে চলে যায়। কিন্তু এই অবস্থাটা স্থায়ী নয়। ইলেকট্রনটি আবার আগের স্তরে ফিরে আসতে চায়। যখন সে ফিরে আসে, তখন সে অতিরিক্ত শক্তিটুকু আলোর ফোটন হিসেবে ছেড়ে দেয়। এই ফোটনগুলোর নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য (wavelength) থাকে, যা আমাদের চোখে বিভিন্ন রঙের আলো হিসেবে ধরা দেয়। এই আলোর সমষ্টিই হলো পারমাণবিক বর্ণালী।
এই ফোটনগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভর করে ইলেকট্রনটি কোন স্তর থেকে কোন স্তরে ফিরে আসছে তার ওপর। যেহেতু প্রতিটি পরমাণুর শক্তিস্তরগুলো ভিন্ন, তাই তাদের নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যও ভিন্ন হয়। এ কারণেই প্রতিটি মৌলিক পদার্থের পারমাণবিক বর্ণালী আলাদা হয়।
পারমাণবিক বর্ণালীর প্রকারভেদ: নিঃসরণ ও শোষণ
পারমাণবিক বর্ণালী প্রধানত দুই প্রকার: নিঃসরণ বর্ণালী (Emission Spectrum) এবং শোষণ বর্ণালী (Absorption Spectrum)।
নিঃসরণ বর্ণালী (Emission Spectrum)
যখন কোনো গ্যাসীয় পদার্থকে উত্তপ্ত করা হয়, তখন সেটি আলো বিকিরণ করে। এই আলোকরশ্মিকে প্রিজমের মধ্যে দিয়ে চালনা করলে যে বর্ণালী পাওয়া যায়, তাকে নিঃসরণ বর্ণালী বলে। এই বর্ণালীতে উজ্জ্বল রঙের রেখা দেখা যায়, যা একটি কালো পটভূমির ওপর গঠিত হয়। যেমন, সোডিয়াম বাতির আলোকরশ্মি বিশ্লেষণ করলে আমরা উজ্জ্বল হলুদ রঙের রেখা দেখতে পাই।
শোষণ বর্ণালী (Absorption Spectrum)
শোষণ বর্ণালী হলো নিঃসরণ বর্ণালীর ঠিক বিপরীত। যখন কোনো সাদা আলো কোনো গ্যাসীয় পদার্থের মধ্যে দিয়ে যায়, তখন গ্যাসীয় পদার্থটি তার পরমাণুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে নেয়। এরপর সেই আলোকরশ্মিকে প্রিজমের মধ্যে দিয়ে চালনা করলে যে বর্ণালী পাওয়া যায়, তাকে শোষণ বর্ণালী বলে। এই বর্ণালীতে উজ্জ্বল পটভূমির ওপর কালো রঙের রেখা দেখা যায়। সূর্যের আলো যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আসে, তখন বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাস কিছু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে নেয়। এই কারণে সূর্যের আলোতে শোষণ বর্ণালী দেখা যায়।
পারমাণবিক বর্ণালীর গুরুত্ব: কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ?
পারমাণবিক বর্ণালী শুধু সুন্দর দেখতেই নয়, এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারও রয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
-
মৌলিক পদার্থ শনাক্তকরণ: আগেই বলেছি, প্রতিটি মৌলিক পদার্থের পারমাণবিক বর্ণালী আলাদা। তাই কোনো নমুনার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে সহজেই তাতে কী কী মৌল আছে, তা জানা যায়।
-
নক্ষত্রের উপাদান নির্ণয়: নক্ষত্রগুলো অনেক দূরে অবস্থিত। সেখানে গিয়ে সরাসরি উপাদান সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। কিন্তু নক্ষত্রের আলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে নক্ষত্রটি কী কী উপাদান দিয়ে তৈরি।
-
দূষণ শনাক্তকরণ: পারমাণবিক বর্ণালী ব্যবহার করে বায়ু ও জলের দূষণ পরিমাপ করা যায়। কোনো নমুনার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব।
-
ফরেনসিক বিজ্ঞান: অপরাধ বিজ্ঞান বা ফরেনসিক সায়েন্সে পারমাণবিক বর্ণালী ব্যবহার করে বিভিন্ন আলামত পরীক্ষা করা হয়।
-
শিল্প ক্ষেত্রে: বিভিন্ন শিল্প কারখানায়, যেমন – কাঁচ শিল্প, রাসায়নিক শিল্প, এই বর্ণালী ব্যবহার করে গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
পারমাণবিক বর্ণালী সম্পর্কিত কিছু জরুরি প্রশ্ন (FAQ):
এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা পারমাণবিক বর্ণালী সম্পর্কে আপনার ধারণা আরও স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে:
১. পারমাণবিক বর্ণালী কিভাবে পরিমাপ করা হয়? (পারমাণবিক বর্ণালী পরিমাপ)
পারমাণবিক বর্ণালী পরিমাপ করার জন্য স্পেকট্রোমিটার (Spectrometer) নামক একটি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। স্পেকট্রোমিটার আলোকরশ্মিকে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুযায়ী আলাদা করে এবং একটি ডিটেক্টরের মাধ্যমে তা রেকর্ড করে। এই ডেটা বিশ্লেষণ করে বর্ণালীর গঠন এবং তীব্রতা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
২. পারমাণবিক বর্ণালীর রেখাগুলো কেন বিভিন্ন রঙের হয়? (বর্ণালীর রেখার কারণ)
পারমাণবিক বর্ণালীর রেখাগুলোর রঙ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে। প্রতিটি রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভিন্ন হওয়ার কারণে বর্ণালীতে বিভিন্ন রঙের রেখা দেখা যায়। ইলেকট্রন যখন উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে ফিরে আসে, তখন নির্গত ফোটনের শক্তি বিভিন্ন হয়, তাই আলোর রঙও ভিন্ন হয়।
৩. পারমাণবিক শোষণ বর্ণালী কিভাবে তৈরি হয়? (শোষণ বর্ণালী গঠন)
যখন সাদা আলো কোনো গ্যাসীয় পদার্থের মধ্যে দিয়ে যায়, তখন গ্যাসীয় পদার্থের পরমাণুগুলো তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে নেয়। ফলে ওই তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলোর আলোকরশ্মি দুর্বল হয়ে যায় বা অনুপস্থিত থাকে। এরপর সেই আলোকরশ্মিকে প্রিজমের মধ্যে দিয়ে চালনা করলে উজ্জ্বল পটভূমির ওপর কালো রঙের রেখা দেখা যায়। এভাবেই শোষণ বর্ণালী গঠিত হয়।
৪. পারমাণবিক বর্ণালীর ব্যবহার কি শুধু রসায়নেই সীমাবদ্ধ? (বর্ণালীর ব্যবহার ক্ষেত্র)
না, পারমাণবিক বর্ণালীর ব্যবহার শুধু রসায়নেই সীমাবদ্ধ নয়। এর ব্যবহার জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, ফরেনসিক বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত।
৫. দুটি ভিন্ন মৌলের পারমাণবিক বর্ণালী কি একই হতে পারে?
কখনোই না। প্রতিটি মৌলের পারমাণবিক গঠন ভিন্ন হওয়ার কারণে তাদের পারমাণবিক বর্ণালীও ভিন্ন হয়। এই কারণেই পারমাণবিক বর্ণালীকে মৌলের “আঙুলের ছাপ” বলা হয়।
৬. পারমাণবিক বর্ণালীতে রেখাগুলোর উজ্জ্বলতা কী নির্দেশ করে? (বর্ণালীর উজ্জ্বলতা)
পারমাণবিক বর্ণালীতে রেখাগুলোর উজ্জ্বলতা নির্দেশ করে যে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো কতটা তীব্রভাবে নির্গত বা শোষিত হয়েছে। যদি কোনো রেখা বেশি উজ্জ্বল হয়, তার মানে সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বেশি পরিমাণে নির্গত বা শোষিত হয়েছে।
৭. কঠিন পদার্থের পারমাণবিক বর্ণালী কেমন হয়? (কঠিন পদার্থের বর্ণালী)
কঠিন পদার্থের পারমাণবিক বর্ণালী সাধারণত গ্যাসীয় পদার্থের মতো স্পষ্ট হয় না। কঠিন পদার্থের পরমাণুগুলো খুব কাছাকাছি থাকার কারণে তাদের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া ঘটে, যা বর্ণালীর রেখাগুলোকে বিস্তৃত করে দেয়। তাই কঠিন পদার্থের বর্ণালী ব্যান্ড আকারে দেখা যায়, যেখানে রেখাগুলো স্পষ্ট থাকে না।
৮. পারমাণবিক বর্ণালী বিশ্লেষণ করে কিভাবে দূষণ মাপা যায়? (দূষণ পরিমাপে বর্ণালী)
বায়ু বা জলের নমুনায় বিভিন্ন দূষণকারী উপাদান থাকলে তারা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ বা নিঃসরণ করে। এই আলোকরশ্মি বিশ্লেষণ করে দূষণকারী উপাদানের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়।
৯. পারমাণবিক বর্ণালী এবং আণবিক বর্ণালীর মধ্যে পার্থক্য কী? (পারমাণবিক বনাম আণবিক বর্ণালী)
পারমাণবিক বর্ণালী তৈরি হয় পরমাণুর ইলেকট্রন স্তরের পরিবর্তনের কারণে, যেখানে আণবিক বর্ণালী তৈরি হয় অণুর মধ্যে থাকা পরমাণুগুলোর কম্পন (vibration) এবং ঘূর্ণন (rotation) এর কারণে। পারমাণবিক বর্ণালী সাধারণত সরল রেখা দেখায়, অন্যদিকে আণবিক বর্ণালী জটিল ব্যান্ড আকারে দেখা যায়।
১০. পারমাণবিক বর্ণালী আবিষ্কার কে করেন? (বর্ণালীর আবিষ্কারক)
যদিও বিভিন্ন সময়ে অনেক বিজ্ঞানী বর্ণালী নিয়ে কাজ করেছেন, জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট বুনসেন (Robert Bunsen) এবং গুস্তাফ কিরশফ (Gustav Kirchhoff) ১৮৬০ এর দশকে পারমাণবিক বর্ণালীর নিয়মগুলো আবিষ্কার করেন এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখান।
পারমাণবিক বর্ণালী: কিছু মজার তথ্য
-
আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন যে সূর্যের মধ্যে হিলিয়াম (Helium) নামক একটি গ্যাস আছে। মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে হিলিয়াম আবিষ্কৃত হওয়ার আগে সূর্যের আলোতে এর অস্তিত্ব জানা গিয়েছিল!
-
বিভিন্ন আতশবাজিতে যে সুন্দর রং দেখা যায়, তা মূলত বিভিন্ন ধাতব লবণের পারমাণবিক বর্ণালীর কারণেই হয়ে থাকে।
-
ক্রিমসন শিখা (Crimson flame) লিথিয়াম (Lithium) এর কারণে হয়ে থাকে।
-
সবুজ শিখা (Green flame) বেরিয়াম (Barium) এর কারণে হয়ে থাকে।
-
নীল শিখা (Blue flame) কপার (Copper) এর কারণে হয়ে থাকে।
উপসংহার
তাহলে, পারমাণবিক বর্ণালী শুধু আলোর খেলা নয়, এটি পরমাণুর ভেতরের খবর জানার এক দারুণ উপায়। এই বর্ণালী ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের অনেক অজানা রহস্য উন্মোচন করছেন। আপনিও হয়তো ভবিষ্যতে এই বর্ণালী নিয়ে গবেষণা করে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারেন! কেমন লাগলো আজকের আলোচনা? আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না। আর যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন!