শুরুতেই একটা প্রশ্ন করি, কখনো ভেবেছেন, পর্যায় সারণীতে (Periodic Table) মৌলগুলো কেন একটা বিশেষ ক্রমে সাজানো থাকে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে “পারমাণবিক সংখ্যা”র (Atomic Number) ধারণার মধ্যে। এই সংখ্যাটিই ঠিক করে দেয় একটা মৌল কী, তার চরিত্র কেমন, এবং অন্য মৌলের সঙ্গে সে কীভাবে বিক্রিয়া করবে। আসুন, আজকের আলোচনায় আমরা পারমাণবিক সংখ্যা কী, এর গুরুত্ব, এবং পর্যায় সারণীতে এর ভূমিকা বিস্তারিতভাবে জেনে নিই।
পারমাণবিক সংখ্যা: একদম গোড়ার কথা
পারমাণবিক সংখ্যা হলো কোনো মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটনের সংখ্যা। প্রত্যেকটা মৌলের জন্য এই সংখ্যাটা নির্দিষ্ট এবং এটা কখনো বদলায় না। যেমন, হাইড্রোজেনের পারমাণবিক সংখ্যা ১, কারণ এর নিউক্লিয়াসে একটা মাত্র প্রোটন আছে। অক্সিজেনের পারমাণবিক সংখ্যা ৮, কারণ এর নিউক্লিয়াসে আটটা প্রোটন আছে।
পারমাণবিক সংখ্যা চেনার উপায়
সহজ ভাষায় বললে, পারমাণবিক সংখ্যা হলো একটা মৌলের “আইডেন্টিটি কার্ড”। যেমন আমাদের দেশে প্রত্যেক নাগরিকের একটা আলাদা ন্যাশনাল আইডি কার্ড থাকে, তেমনি প্রত্যেকটা মৌলের আলাদা পারমাণবিক সংখ্যা থাকে। এই সংখ্যা দেখেই বোঝা যায়, সেটি কোন মৌল।
পারমাণবিক সংখ্যা কীভাবে লেখা হয়?
পারমাণবিক সংখ্যাকে সাধারণত মৌলের প্রতীকের বাঁ দিকে নিচের দিকে লেখা হয়। যেমন, অক্সিজেনের (O) পারমাণবিক সংখ্যা ৮ হলে, সেটাকে 8O হিসেবে লেখা হয়।
পারমাণবিক সংখ্যার গুরুত্ব
পারমাণবিক সংখ্যা শুধু একটা সংখ্যা নয়; এটা একটা মৌলের অনেক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দেয়। এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করা হলো:
মৌলের পরিচয়
আগেই বলেছি, পারমাণবিক সংখ্যা একটা মৌলের পরিচয় বহন করে। পর্যায় সারণীতে প্রত্যেকটা মৌলের স্থান নির্দিষ্ট করা হয় এই সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে।
রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য
একটা মৌলের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, অর্থাৎ সেটি অন্য মৌলের সঙ্গে কীভাবে বিক্রিয়া করবে, তা নির্ভর করে তার ইলেকট্রন বিন্যাসের ওপর। আর ইলেকট্রন বিন্যাস সরাসরি পারমাণবিক সংখ্যার সঙ্গে জড়িত। কারণ, একটা পরমাণুতে যতগুলো প্রোটন থাকে, ঠিক ততগুলো ইলেকট্রন থাকে।
পর্যায় সারণীতে স্থান
পর্যায় সারণীতে মৌলগুলোকে তাদের পারমাণবিক সংখ্যা অনুসারে সাজানো হয়েছে। এর ফলে একই গ্রুপের মৌলগুলোর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য একই রকম হয়।
পর্যায় সারণী (Periodic Table) এবং পারমাণবিক সংখ্যা
পর্যায় সারণী হলো রসায়ন বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারগুলোর মধ্যে একটা। এই সারণীতে মৌলগুলোকে তাদের পারমাণবিক সংখ্যা এবং রাসায়নিক ধর্মের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে।
পর্যায় সারণীর ইতিহাস
১৮৬৯ সালে রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিফ প্রথম পর্যায় সারণী তৈরি করেন। তিনি মৌলগুলোকে তাদের পারমাণবিক ভর অনুসারে সাজিয়েছিলেন এবং দেখেছিলেন যে একই ধরনের বৈশিষ্ট্যযুক্ত মৌলগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ফিরে আসে।
পর্যায় সারণীর আধুনিক রূপ
বর্তমানে যে পর্যায় সারণী আমরা ব্যবহার করি, সেটি মেন্ডেলিফের ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হলেও, এখানে মৌলগুলোকে পারমাণবিক সংখ্যা অনুসারে সাজানো হয়েছে। এর ফলে সারণীটি আরও বেশি যুক্তিযুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত হয়েছে।
পারমাণবিক সংখ্যার ভিত্তিতে পর্যায় সারণীর গঠন
পর্যায় সারণীতে মৌলগুলোকে সারি (Period) এবং গ্রুপে (Group) ভাগ করা হয়েছে। একই গ্রুপের মৌলগুলোর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য সাধারণত একই রকম হয়, কারণ তাদের ইলেকট্রন বিন্যাসের বাইরের স্তরে ইলেকট্রনের সংখ্যা একই থাকে।
আরো গভীরে: আইসোটোপ (Isotope) এবং পারমাণবিক সংখ্যা
আইসোটোপ হলো একই মৌলের ভিন্ন রূপ। এদের প্রোটন সংখ্যা একই থাকে, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন হওয়ার কারণে এদের ভর সংখ্যা (Mass Number) আলাদা হয়।
আইসোটোপ কী?
উদাহরণস্বরূপ, কার্বনের তিনটা আইসোটোপ আছে: কার্বন-১২, কার্বন-১৩, এবং কার্বন-১৪। এদের সবার পারমাণবিক সংখ্যা ৬ (অর্থাৎ ৬টা প্রোটন আছে), কিন্তু এদের নিউট্রন সংখ্যা যথাক্রমে ৬, ৭, এবং ৮।
আইসোটোপের ব্যবহার
বিভিন্ন আইসোটোপ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যেমন, কার্বন-১৪ ব্যবহার করে পুরনো প্রত্নতত্ত্বিক জিনিসপত্রের বয়স নির্ণয় করা হয়। আবার, ইউরেনিয়াম-২৩৫ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়।
পারমাণবিক সংখ্যা এবং ভর সংখ্যা (Mass Number)
পারমাণবিক সংখ্যা এবং ভর সংখ্যা—এই দুটো বিষয় প্রায়ই গুলিয়ে ফেলা হয়। তাই এদের মধ্যেকার পার্থক্যটা ভালোভাবে বোঝা দরকার।
পারমাণবিক সংখ্যা বনাম ভর সংখ্যা
আগেই বলা হয়েছে, পারমাণবিক সংখ্যা হলো নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটনের সংখ্যা। আর ভর সংখ্যা হলো নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন এবং নিউট্রনের মোট সংখ্যা।
ভর সংখ্যা নির্ণয়
ভর সংখ্যা নির্ণয় করার জন্য, কোনো মৌলের পারমাণবিক সংখ্যার সঙ্গে তার নিউট্রন সংখ্যা যোগ করতে হয়। যেমন, অক্সিজেনের পারমাণবিক সংখ্যা ৮ এবং এর নিউক্লিয়াসে ৮টা নিউট্রন থাকলে, তার ভর সংখ্যা হবে ১৬।
পারমাণবিক সংখ্যা: কিছু মজার তথ্য
- হাইড্রোজেন (Hydrogen) হলো সবথেকে হালকা মৌল, যার পারমাণবিক সংখ্যা ১।
- সবথেকে ভারী প্রাকৃতিক মৌল হলো ইউরেনিয়াম (Uranium), যার পারমাণবিক সংখ্যা ৯২।
- কৃত্রিমভাবে তৈরি মৌলগুলোর মধ্যে সবথেকে বেশি পারমাণবিক সংখ্যা হলো ১১৮, যার নাম ওগানেসন (Oganesson)।
কিছু জিজ্ঞাসু প্রশ্ন (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে পারমাণবিক সংখ্যা নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
পারমাণবিক সংখ্যা কীভাবে আবিষ্কৃত হয়?
পারমাণবিক সংখ্যা আবিষ্কারের পেছনে অনেক বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে। তবে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এবং হেনরি মোসলের কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯১৩ সালে মোসলে বিভিন্ন মৌলের এক্স-রে বর্ণালী (X-ray spectra) পরীক্ষা করে দেখেন যে, মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা তার এক্স-রে তরঙ্গের কম্পাঙ্কের (frequency) সঙ্গে সম্পর্কিত।
পারমাণবিক সংখ্যা কি পরিবর্তন করা যায়?
সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পারমাণবিক সংখ্যা পরিবর্তন করা যায় না। কারণ, রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোতে শুধু ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটে, নিউক্লিয়াসের কোনো পরিবর্তন হয় না। তবে, পারমাণবিক বিক্রিয়ায় (Nuclear reaction) পারমাণবিক সংখ্যা পরিবর্তন করা সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, তেজস্ক্রিয় মৌলগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলফা কণা (Alpha particle) নিঃসরণ করে অন্য মৌলে রূপান্তরিত হতে পারে।
পারমাণবিক সংখ্যা এবং রাসায়নিক সংকেত (Chemical Symbol) এর মধ্যে সম্পর্ক কী?
প্রতিটি মৌলের একটা নির্দিষ্ট রাসায়নিক সংকেত আছে, যা দিয়ে সেই মৌলকে প্রকাশ করা হয়। যেমন, হাইড্রোজেনের সংকেত H, অক্সিজেনের সংকেত O, এবং সোডিয়ামের সংকেত Na। এই সংকেতগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং ব্যবহৃত হয়। পর্যায় সারণীতে মৌলের সংকেতের সঙ্গেই তার পারমাণবিক সংখ্যা দেওয়া থাকে।
পারমাণবিক সংখ্যা মনে রাখার সহজ উপায় কী?
সব মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা মনে রাখা কঠিন। তবে, প্রথম ২০টি মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা মনে রাখা দরকারি। এর জন্য বিভিন্ন ছন্দ বা কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন:
- হাইড্রোজেন ১
- হিলিয়াম ২
- লিথিয়াম ৩
- বেরিলিয়াম ৪
- বোরন ৫
- কার্বন ৬
- নাইট্রোজেন ৭
- অক্সিজেন ৮
- ফ্লুরিন ৯
- নিয়ন ১০
এইভাবে একটা ছন্দের মাধ্যমে মনে রাখলে সুবিধা হয়।
পারমাণবিক সংখ্যা নির্ণয়ের গুরুত্ব কী?
পারমাণবিক সংখ্যা নির্ণয় করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি কোনো মৌল আসলে কী এবং তার বৈশিষ্ট্যগুলো কেমন হবে। এটা রসায়ন এবং পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগে।
পারমাণবিক সংখ্যা বিষয়ক কিছু গাণিতিক সমস্যা (Numerical Problems)
-
একটি মৌলের নিউক্লিয়াসে ১১টি প্রোটন ও ১২টি নিউট্রন আছে। মৌলটির পারমাণবিক সংখ্যা ও ভর সংখ্যা নির্ণয় করো।
- সমাধান: মৌলটির পারমাণবিক সংখ্যা ১১ (যেহেতু প্রোটন সংখ্যা ১১) এবং ভর সংখ্যা ২৩ (১১টি প্রোটন + ১২টি নিউট্রন = ২৩)।
-
কার্বনের একটি আইসোটোপের ভর সংখ্যা ১৪। এই আইসোটোপটিতে কয়টি নিউট্রন আছে?
- সমাধান: কার্বনের পারমাণবিক সংখ্যা ৬। সুতরাং, নিউট্রন সংখ্যা = ভর সংখ্যা – পারমাণবিক সংখ্যা = ১৪ – ৬ = ৮টি।
-
অক্সিজেনের একটি পরমাণুতে ৮টি প্রোটন ও ৮টি নিউট্রন আছে। এর পারমাণবিক সংখ্যা ও ভর সংখ্যা কত?
* সমাধান: অক্সিজেনের পারমাণবিক সংখ্যা ৮ (প্রোটন সংখ্যা ৮) এবং ভর সংখ্যা ১৬ (৮টি প্রোটন + ৮টি নিউট্রন = ১৬)।
পারমাণবিক সংখ্যা ব্যবহার করে কীভাবে কোনো মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস বের করা যায়?
ইলেকট্রন বিন্যাস বের করতে হলে প্রথমে জানতে হবে মৌলটির পারমাণবিক সংখ্যা কত। পারমাণবিক সংখ্যা থেকে আমরা জানতে পারি ওই মৌলের পরমাণুতে কতগুলো ইলেকট্রন আছে। এরপর সেই ইলেকট্রনগুলোকে বিভিন্ন শক্তিস্তরে (energy levels) সাজাতে হয়।
পারমাণবিক সংখ্যা কি ভগ্নাংশ হতে পারে?
না, পারমাণবিক সংখ্যা কখনোই ভগ্নাংশ হতে পারে না। কারণ, এটা নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটনের সংখ্যা নির্দেশ করে, যা সবসময় একটা পূর্ণ সংখ্যা হবে।
পারমাণবিক সংখ্যা এবং তেজস্ক্রিয়তা (Radioactivity) এর মধ্যে সম্পর্ক কী?
কিছু মৌলের নিউক্লিয়াস এতটাই অস্থির (unstable) থাকে যে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কণা (particles) এবং শক্তি (energy) নির্গত করে, যা তেজস্ক্রিয়তা নামে পরিচিত। তেজস্ক্রিয় মৌলগুলোর পারমাণবিক সংখ্যা সাধারণত অনেক বেশি হয়। তেজস্ক্রিয়তা মূলত নিউক্লিয়াসের ঘটনা, তাই পারমাণবিক সংখ্যা এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পারমাণবিক সংখ্যা পরিবর্তনে কী ঘটে?
যদি কোনোভাবে একটা মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা পরিবর্তন করা যায়, তাহলে সেটি সম্পূর্ণ নতুন একটা মৌলে পরিণত হবে। যেমন, যদি কোনো বিক্রিয়ায় একটা কার্বন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে একটা প্রোটন যোগ করা যায়, তাহলে সেটি নাইট্রোজেনে (Nitrogen) পরিণত হবে।
শেষ কথা
আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে পারমাণবিক সংখ্যা কী, এর গুরুত্ব, এবং পর্যায় সারণীতে এর ভূমিকা সম্পর্কে আপনারা একটা স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। রসায়ন বিজ্ঞানকে ভালোভাবে বুঝতে হলে এই মৌলিক ধারণাগুলো জানা খুব দরকারি। যদি এই বিষয়ে আরো কিছু জানার থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ, রসায়নের এই মজার জগৎ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে ভুলবেন না!