আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? আজ আমরা পদার্থবিজ্ঞানের (physics) খুব মজার একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করব – পীড়ন ও বিকৃতি (Stress and Strain)! জিনিসটা শুনতে একটু কঠিন লাগলেও, আমি কথা দিচ্ছি, এই ব্লগপোস্ট পড়ার পর আপনার কাছে এটা একদম জলের মতো সোজা হয়ে যাবে। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
কাজের খাতিরে বা নিজের প্রয়োজনে আমাদের প্রায়ই বিভিন্ন বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করতে হয়। এই বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর আকার বা আকৃতির পরিবর্তন হয়, আবার অনেক সময় হয়ও না। কিন্তু এর পেছনে যে বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে, সেটা কি আমরা জানি? পীড়ন আর বিকৃতি সেই বিজ্ঞানটাকেই আমাদের সামনে তুলে ধরে।
পীড়ন ও বিকৃতি: বেসিক ধারণা (Stress and Strain: Basic Concept)
পীড়ন আর বিকৃতি বোঝার আগে, একটা সাধারণ উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনি একটা রাবার ব্যান্ড নিলেন এবং সেটাকে দুই দিক থেকে টানলেন। কী হবে? রাবার ব্যান্ডটা লম্বা হয়ে যাবে, তাই না? এখানে আপনি রাবার ব্যান্ডের ওপর একটা বাহ্যিক বল (external force) প্রয়োগ করেছেন। এই বলের কারণে রাবার ব্যান্ডের ভেতরে একটা প্রতিরোধ বলের (resisting force) সৃষ্টি হয়, যা বস্তুটিকে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চায়।
পীড়ন (Stress) কী?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, পীড়ন হলো বস্তুর ভেতরে একক ক্ষেত্রফলের (unit area) ওপর প্রযুক্ত প্রতিরোধ বল। যখন আপনি রাবার ব্যান্ড টানেন, তখন রাবার ব্যান্ডের উপাদানের মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধকারী শক্তি কাজ করে, সেটাই হলো পীড়ন।
গাণিতিকভাবে, পীড়ন (σ) = প্রযুক্ত বল (F) / ক্ষেত্রফল (A)
অর্থাৎ, σ = F/A
পীড়নের একক (unit) হলো প্যাসকেল (Pascal) বা নিউটন প্রতি বর্গমিটার (N/m²)।
বিভিন্ন ধরনের পীড়ন (Types of Stress)
পীড়ন সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে:
- টান পীড়ন (Tensile Stress): যখন কোনো বস্তুকে টেনে লম্বা করার চেষ্টা করা হয়, তখন যে পীড়ন সৃষ্টি হয়, তাকে টান পীড়ন বলে। যেমন: রাবার ব্যান্ড টানা।
- সংনমন পীড়ন (Compressive Stress): যখন কোনো বস্তুকে চেপে ছোট করার চেষ্টা করা হয়, তখন যে পীড়ন সৃষ্টি হয়, তাকে সংনমন পীড়ন বলে। যেমন: স্পঞ্জকে চাপ দেওয়া।
- শিয়ার পীড়ন (Shear Stress): যখন কোনো বস্তুর একটি স্তরের ওপর অন্য একটি স্তরকে পিছলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন যে পীড়ন সৃষ্টি হয়, তাকে শিয়ার পীড়ন বলে। যেমন: একটি বইয়ের ওপর হাত রেখে ধাক্কা দেওয়া।
বিকৃতি (Strain) কী?
বিকৃতি হলো বস্তুর আকারের আপেক্ষিক পরিবর্তন। অর্থাৎ, বল প্রয়োগের আগে বস্তুর আকার যা ছিল এবং বল প্রয়োগের পরে তার আকারে যে পরিবর্তন হয়েছে, এই দুইয়ের অনুপাতই হলো বিকৃতি।
গাণিতিকভাবে, বিকৃতি (ε) = আকারের পরিবর্তন (ΔL) / আদি আকার (L)
অর্থাৎ, ε = ΔL/L
বিকৃতির কোনো একক নেই, কারণ এটি দুটি একই রাশির অনুপাত।
বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি (Types of Strain)
পীড়নের মতো, বিকৃতিও বিভিন্ন ধরনের হতে পারে:
- দৈর্ঘ্য বিকৃতি (Tensile Strain): যখন কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হয়, তখন তাকে দৈর্ঘ্য বিকৃতি বলে।
- আয়তন বিকৃতি (Volumetric Strain): যখন কোনো বস্তুর আয়তনের পরিবর্তন হয়, তখন তাকে আয়তন বিকৃতি বলে।
- শিয়ার বিকৃতি(Shear Strain): যখন কোনো বস্তুর আকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু আয়তন একই থাকে, তখন তাকে শিয়ার বিকৃতি বলে।
পীড়ন ও বিকৃতির মধ্যে সম্পর্ক: স্থিতিস্থাপকতা (Relationship between Stress and Strain: Elasticity)
পীড়ন এবং বিকৃতি একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এদের মধ্যে সম্পর্ক বুঝতে হলে স্থিতিস্থাপকতা (elasticity) সম্পর্কে জানতে হবে। স্থিতিস্থাপকতা হলো কোনো বস্তুর ওপর থেকে বাহ্যিক বল সরিয়ে নিলে তার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা।
হুকের সূত্র (Hooke’s Law)
হুকের সূত্র অনুযায়ী, স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে পীড়ন বিকৃতির সাথে সরাসরি সমানুপাতিক। এর মানে হলো, পীড়ন যত বাড়বে, বিকৃতিও তত বাড়বে।
গাণিতিকভাবে, পীড়ন ∝ বিকৃতি
বা, পীড়ন = স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক × বিকৃতি
(Stress = Elastic Modulus × Strain)
এখানে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক (Elastic Modulus) হলো বস্তুর উপাদানের একটি বৈশিষ্ট্য, যা নির্দেশ করে বস্তুটি কতটা স্থিতিস্থাপক।
স্থিতিস্থাপক সীমা (Elastic Limit)
প্রত্যেক বস্তুরই একটা স্থিতিস্থাপক সীমা থাকে। এই সীমা পর্যন্ত বল প্রয়োগ করলে বস্তু তার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু যদি বলের পরিমাণ এই সীমা ছাড়িয়ে যায়, তবে বস্তু স্থায়ীভাবে বিকৃত হয়ে যায় অথবা ভেঙে যায়।
বাস্তব জীবনে পীড়ন ও বিকৃতির উদাহরণ (Examples of Stress and Strain in Real Life)
পীড়ন ও বিকৃতির ধারণা আমাদের চারপাশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান। কয়েকটি উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
- বিল্ডিং এবং সেতু নির্মাণ (Building and Bridge Construction): বিল্ডিং এবং সেতু নির্মাণের সময় ইঞ্জিনিয়াররা পীড়ন ও বিকৃতির হিসাব করে ডিজাইন করেন, যাতে কাঠামোগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয় এবং ভেঙে না যায়।
- যানবাহন তৈরি (Vehicle Manufacturing): গাড়ির বডি, বিমানের কাঠামো ইত্যাদি তৈরির সময় পীড়ন ও বিকৃতির বিষয়গুলো মাথায় রাখা হয়, যাতে যানগুলো নিরাপদে চলতে পারে।
- দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য জিনিসপত্র (Everyday Items): চেয়ার, টেবিল, কলম, মোবাইল ফোন – সবকিছু তৈরির সময় পীড়ন ও বিকৃতির ধারণা কাজে লাগানো হয়।
কঠিন পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা (Elasticity of Solids)
কঠিন পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রধান তিনটি হলো:
- ইয়ং-এর গুণাঙ্ক (Young’s Modulus): এটি টান পীড়ন এবং দৈর্ঘ্য বিকৃতির অনুপাত। এটি বস্তুর দৈর্ঘ্য বরাবর স্থিতিস্থাপকতা নির্দেশ করে।
- আয়তন গুণাঙ্ক (Bulk Modulus): এটি চাপ পীড়ন এবং আয়তন বিকৃতির অনুপাত। এটি বস্তুর আয়তনগত স্থিতিস্থাপকতা নির্দেশ করে।
- দৃঢ়তা গুণাঙ্ক (Shear Modulus): এটি শিয়ার পীড়ন এবং শিয়ার বিকৃতির অনুপাত। এটি বস্তুর আকারগত স্থিতিস্থাপকতা নির্দেশ করে।
নিচের টেবিলে বিভিন্ন পদার্থের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক দেওয়া হলো:
পদার্থ | ইয়ং-এর গুণাঙ্ক (GPa) | আয়তন গুণাঙ্ক (GPa) | দৃঢ়তা গুণাঙ্ক (GPa) |
---|---|---|---|
ইস্পাত | 200 | 160 | 80 |
অ্যালুমিনিয়াম | 70 | 75 | 25 |
তামা | 110 | 140 | 45 |
রাবার | 0.01-0.1 | 1 | 0.002-0.005 |
পীড়ন ও বিকৃতি: কিছু গাণিতিক সমস্যা ও সমাধান (Mathematical Problems and Solutions)
এবার আমরা পীড়ন ও বিকৃতি সম্পর্কিত কিছু গাণিতিক সমস্যা দেখব।
উদাহরণ ১:
একটি তারের দৈর্ঘ্য 2 মিটার এবং প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল 4 mm²। যদি তারটিকে 100 N বল দিয়ে টানা হয়, তবে পীড়ন কত হবে?
সমাধান:
পীড়ন (σ) = প্রযুক্ত বল (F) / ক্ষেত্রফল (A)
ক্ষেত্রফল A = 4 mm² = 4 × 10⁻⁶ m²
সুতরাং, σ = 100 N / (4 × 10⁻⁶ m²) = 25 × 10⁶ N/m² = 25 MPa
উদাহরণ ২:
একটি ইস্পাতের তারের দৈর্ঘ্য 5 মিটার। এটিকে টানার ফলে এর দৈর্ঘ্য 0.05 মিটার বৃদ্ধি পেল। বিকৃতি কত হবে?
সমাধান:
বিকৃতি (ε) = আকারের পরিবর্তন (ΔL) / আদি আকার (L)
সুতরাং, ε = 0.05 m / 5 m = 0.01
নিত্যদিনের জীবনে পীড়ন ও বিকৃতি (Stress and Strain in Everyday Life)
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পীড়ন ও বিকৃতির ব্যবহার অনেক। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- কাপড় তৈরি: কাপড় তৈরির সময় সুতাগুলোর ওপর টান প্রয়োগ করা হয়, যা টান পীড়নের উদাহরণ।
- জুতা তৈরি: জুতার সোল তৈরির সময় বিভিন্ন ধরনের পীড়ন ও বিকৃতি বিবেচনা করা হয়, যাতে এটি টেকসই হয়।
- খাবার তৈরি: রুটি বা পরোটা বানানোর সময় আটার ওপর বল প্রয়োগ করা হয়, যা পীড়ন ও বিকৃতির সৃষ্টি করে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে পীড়ন ও বিকৃতি নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
-
স্থিতিস্থাপকতা কাকে বলে?
উত্তরঃ স্থিতিস্থাপকতা হলো কোনো বস্তুর ওপর থেকে বাহ্যিক বল সরিয়ে নিলে তার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা।
-
হুকের সূত্র কী?
উত্তরঃ হুকের সূত্র অনুযায়ী, স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে পীড়ন বিকৃতির সাথে সরাসরি সমানুপাতিক।
-
পীড়ন এবং চাপের মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তরঃ পীড়ন হলো বস্তুর ভেতরের প্রতিরোধকারী বল, যা বাহ্যিক বলের কারণে সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, চাপ হলো কোনো বস্তুর ওপর প্রযুক্ত বাহ্যিক বল।
-
পয়সনের অনুপাত (Poisson’s ratio) কি?
উত্তরঃ পয়সনের অনুপাত হলো পার্শ্বীয় বিকৃতি (lateral strain) এবং অনুদৈর্ঘ্য বিকৃতির (longitudinal strain) অনুপাত। যখন কোনো বস্তুকে টানা হয়, তখন একদিকে তার দৈর্ঘ্য বাড়ে, অন্যদিকে প্রস্থ কমে যায়। এই দুই ধরনের বিকৃতির অনুপাতই হলো পয়সনের অনুপাত। এর মান সাধারণত 0 থেকে 0.5 এর মধ্যে থাকে।
-
পীড়ন কত প্রকার ও কি কি?
উত্তরঃ পীড়ন মূলত তিন প্রকার: টান পীড়ন, সংনমন পীড়ন এবং শিয়ার পীড়ন।
-
বিকৃতি কত প্রকার ও কি কি?
উত্তরঃ বিকৃতিও তিন প্রকার: দৈর্ঘ্য বিকৃতি, আয়তন বিকৃতি এবং শিয়ার বিকৃতি।
পীড়ন ও বিকৃতি পরিমাপের পদ্ধতি (Methods for Measuring Stress and Strain)
পীড়ন ও বিকৃতি পরিমাপ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
- স্টেইন গেজ (Strain Gauge): এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি। স্টেইন গেজ হলো একটি ছোট সেন্সর, যা বস্তুর ওপর লাগানো হয়। যখন বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করা হয়, তখন স্টেইন গেজের রোধের (resistance) পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকৃতি মাপা যায়।
- অপটিক্যাল পদ্ধতি (Optical Methods): এই পদ্ধতিতে আলো ব্যবহার করে বস্তুর বিকৃতি মাপা হয়। ডিজিটাল ইমেজ correlation (DIC) একটি জনপ্রিয় অপটিক্যাল পদ্ধতি।
- এক্স-রে ডিফ্রাকশন (X-ray Diffraction): এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বস্তুর ভেতরের পীড়ন মাপা যায়। এটি সাধারণত কঠিন পদার্থের স্ফটিক (crystal) গঠন বিশ্লেষণ করে পীড়ন নির্ণয় করে।
- ফাইব্র অপটিক সেন্সর (Fiber Optic Sensors): এই সেন্সরগুলো আলো পরিবহনের মাধ্যমে বিকৃতি মাপে। এগুলো ছোট এবং হালকা হওয়ায় সহজে ব্যবহার করা যায়।
উপসংহার (Conclusion)
আশা করি, পীড়ন ও বিকৃতি নিয়ে আপনার মনে আর কোনো প্রশ্ন নেই। এই বিষয়গুলো পদার্থবিজ্ঞান এবং প্রকৌশলবিদ্যার (engineering) জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম পীড়ন কী, বিকৃতি কী, এদের মধ্যে সম্পর্ক কী এবং বাস্তব জীবনে এদের ব্যবহার কোথায়।
যদি আপনার মনে এখনও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট সেকশনে জানান। আর যদি এই ব্লগপোস্টটি ভালো লেগে থাকে, তবে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন! আল্লাহ হাফেজ!