আচ্ছা, কখনো কি মনে হয়েছে গাছের পাতা সবুজ কেন? অথবা, ফলগুলো এত রঙিন হয় কী করে? এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক মজার জিনিস – প্লাস্টিড! চলুন, আজকে আমরা প্লাস্টিড নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা করি, একদম ঘরোয়া আড্ডার মতো করে।
প্লাস্টিড কী: কোষের ভেতরে রঙের কারখানা!
প্লাস্টিড হলো উদ্ভিদকোষ (Plant cell) এবং কিছু বিশেষ ধরণের অ্যালগি কোষের (algae cell) মধ্যে থাকা এক প্রকার কোষীয় অঙ্গাণু। এদেরকে কোষের “রঙের কারখানা” বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কেন বলছি, সেটা একটু পরেই বুঝতে পারবেন। প্লাস্টিডগুলো মূলত খাদ্য তৈরি, খাদ্য সঞ্চয় এবং কোষের রঙ নির্ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে থাকে।
সহজ ভাষায়, প্লাস্টিড হলো উদ্ভিদের একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ, যা সালোকসংশ্লেষণ (photosynthesis) প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলো ব্যবহার করে খাদ্য তৈরি করে। শুধু তাই নয়, এরা গাছের বিভিন্ন অংশে, যেমন পাতা, ফুল ও ফলে বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থ (pigments) তৈরি করে আকর্ষণীয় রঙ যোগ করে।
প্লাস্টিডের প্রকারভেদ: কোনটা কী কাজ করে?
প্লাস্টিড কিন্তু এক রকমের হয় না, এদের কাজের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। এদের মধ্যে প্রধান কয়েকটা হলো:
-
ক্লোরোপ্লাস্ট (Chloroplast): সবুজ রঙের প্লাস্টিড। এদের প্রধান কাজ হলো সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করা। ক্লোরোপ্লাস্টের মধ্যে ক্লোরোফিল নামক একটি রঞ্জক পদার্থ থাকে, যা সূর্যের আলো শোষণ করে এই প্রক্রিয়াকে সম্ভব করে তোলে। তাই গাছের পাতা সবুজ দেখায়।
- ক্লোরোপ্লাস্টের গঠন বেশ জটিল। এর মধ্যে থাইলাকয়েড (thylakoid), গ্রানা (grana), স্ট্রোমা (stroma) ইত্যাদি অংশ থাকে, যা সালোকসংশ্লেষণের বিভিন্ন ধাপে সাহায্য করে।
-
ক্রোমোপ্লাস্ট (Chromoplast): বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিড, যেমন লাল, হলুদ, কমলা ইত্যাদি। এরা ফুল ও ফলের রঙ নির্ধারণ করে, যা পরাগায়নে সাহায্য করে।
- ক্রোমোপ্লাস্টের কারণে ফুল এবং ফলগুলো বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে, যা কীটপতঙ্গ এবং অন্যান্য প্রাণীদের আকর্ষণ করে পরাগায়ন ঘটাতে সাহায্য করে। যেমন, টমেটোর লাল রং বা গাজরের কমলা রং এই ক্রোমোপ্লাস্টের অবদান।
-
লিউকোপ্লাস্ট (Leucoplast): বর্ণহীন প্লাস্টিড। এদের প্রধান কাজ হলো খাদ্য সঞ্চয় করা। এরা শ্বেতসার (starch), প্রোটিন এবং ফ্যাট জাতীয় খাদ্য জমা রাখে।
* লিউকোপ্লাস্ট সাধারণত গাছের সেই অংশে থাকে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না, যেমন মূল বা ভূগর্ভস্থ কাণ্ড। আলুর মধ্যে যে শ্বেতসার থাকে, তা এই লিউকোপ্লাস্টের মাধ্যমেই জমা হয়।
প্লাস্টিডের প্রকারভেদ | রং | কাজ | উদাহরণ |
---|---|---|---|
ক্লোরোপ্লাস্ট | সবুজ | সালোকসংশ্লেষণ | পাতার সবুজ রং |
ক্রোমোপ্লাস্ট | লাল, হলুদ, কমলা | ফুলের ও ফলের রং তৈরি | গাজরের কমলা রং |
লিউকোপ্লাস্ট | বর্ণহীন | খাদ্য সঞ্চয় | আলুর শ্বেতসার |
প্লাস্টিডের উৎপত্তি: এরা কি নিজেরা তৈরি হতে পারে?
প্লাস্টিডের উৎপত্তি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেক আলোচনা রয়েছে। Endosymbiotic theory অনুযায়ী, মনে করা হয় যে প্লাস্টিড আসলে একসময় স্বাধীনভাবে বসবাস করা ব্যাকটেরিয়া ছিল। কোনো আদি ইউক্যারিওটিক কোষ (eukaryotic cell) এদের গিলে ফেলেছিল, কিন্তু হজম করতে পারেনি। ধীরে ধীরে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো কোষের মধ্যে অঙ্গাণু হিসেবে কাজ করতে শুরু করে, এবং কালের বিবর্তনে প্লাস্টিডে রূপান্তরিত হয়।
প্লাস্টিডগুলো নিজের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে। এদের মধ্যে নিজস্ব ডিএনএ (DNA) এবং রাইবোসোম (ribosome) থাকে, যা প্রোটিন তৈরি করতে সাহায্য করে। তাই এরা কোষ বিভাজনের সময় নিজেরাই নিজেদের সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম।
প্লাস্টিডের কাজ: শুধু কি রঙ দেওয়া?
আসলে, প্লাস্টিডের কাজ শুধু রঙ দেওয়া নয়। এর আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নিচে কয়েকটি প্রধান কাজ আলোচনা করা হলো:
-
সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis): ক্লোরোপ্লাস্টের প্রধান কাজ হলো সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলো, জল এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করে খাদ্য তৈরি করা। এই প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন উৎপন্ন হয়, যা আমাদের শ্বাস लेने के लिए খুব দরকারি।
-
খাদ্য সঞ্চয়: লিউকোপ্লাস্ট শ্বেতসার, প্রোটিন এবং ফ্যাট জাতীয় খাদ্য সঞ্চয় করে রাখে। গাছের যখন প্রয়োজন হয়, তখন এই সঞ্চিত খাদ্য ব্যবহার করা হয়।
-
রং তৈরি: ক্রোমোপ্লাস্ট ফুল ও ফলের বিভিন্ন রঙ তৈরি করে, যা পরাগায়নে সাহায্য করে। রঙিন ফুল এবং ফল পোকামাকড় ও পাখিদের আকর্ষণ করে, যার ফলে পরাগ সংযোগ সফল হয়।
- অ্যামিনো অ্যাসিড এবং লিপিড তৈরি: প্লাস্টিড কিছু অ্যামিনো অ্যাসিড এবং লিপিড তৈরি করতে পারে, যা কোষের জন্য খুব দরকারি।
- উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা: প্লাস্টিড উদ্ভিদের সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে।
প্লাস্টিড এবং ক্লোরোফিলের মধ্যে সম্পর্ক কী?
ক্লোরোফিল হলো এক প্রকার রঞ্জক পদার্থ, যা ক্লোরোপ্লাস্টের মধ্যে থাকে। ক্লোরোফিলের কাজ হলো সূর্যের আলো শোষণ করা এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সাহায্য করা। ক্লোরোফিলের কারণেই গাছের পাতা সবুজ দেখায়। তাই ক্লোরোপ্লাস্ট এবং ক্লোরোফিল একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
প্লাস্টিড কোথায় থাকে?
প্লাস্টিড মূলত উদ্ভিদকোষে (plant cell) পাওয়া যায়। বিশেষ করে পাতার মেসোফিল (mesophyll) কোষে এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি থাকে, কারণ সেখানেই সালোকসংশ্লেষণ সবচেয়ে বেশি হয়। এছাড়াও, অন্যান্য সবুজ অংশে যেমন কাণ্ড এবং ফুলের বৃতিতেও প্লাস্টিড দেখা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, শেকড়ের কোষে লিউকোপ্লাস্টিড পাওয়া যায়, যা খাদ্য সঞ্চয়ে সাহায্য করে।
প্লাস্টিড কি প্রাণী কোষে থাকে?
উত্তর হলো, না। প্লাস্টিড শুধুমাত্র উদ্ভিদকোষ এবং কিছু অ্যালগি কোষে পাওয়া যায়। প্রাণী কোষে প্লাস্টিড থাকে না। প্রাণীরা তাদের খাদ্য তৈরি করতে পারে না, তাই তাদের প্লাস্টিডের প্রয়োজন হয় না।
প্লাস্টিডের গুরুত্ব: কেন এটা এত জরুরি?
প্লাস্টিডের গুরুত্ব অনেক। এদের ছাড়া উদ্ভিদের জীবন ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো:
-
খাদ্য উৎপাদন: প্লাস্টিড, বিশেষ করে ক্লোরোপ্লাস্ট, সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে। এই খাদ্য উদ্ভিদ নিজের দেহে ব্যবহার করে এবং উদ্বৃত্ত খাদ্য ফল, মূল ও বীজে জমা রাখে, যা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
-
অক্সিজেন উৎপাদন: সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিড অক্সিজেন উৎপন্ন করে, যা প্রাণীজগতের শ্বাসকার্যের জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
-
** ecosystem এর ভারসাম্য রক্ষা:** প্লাস্টিড কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- পুষ্টি সরবরাহ: প্লাস্টিড থেকে উৎপাদিত খাদ্য উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে এবং ফল ও সবজির মাধ্যমে মানুষের শরীরে পুষ্টি সরবরাহ করে।
সুতরাং, প্লাস্টিড শুধু উদ্ভিদের জন্য নয়, সমগ্র জীবজগতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ): আপনার প্রশ্ন, আমার উত্তর
প্লাস্টিড নিয়ে হয়তো আপনার মনে আরও কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
-
প্লাস্টিড কী দিয়ে তৈরি?
প্লাস্টিড মূলত প্রোটিন, লিপিড এবং নিউক্লিক অ্যাসিড দিয়ে তৈরি। এর মধ্যে নিজস্ব ডিএনএ (DNA) এবং রাইবোসোমও (ribosome) থাকে।
-
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্লাস্টিড কোনটি?
ক্লোরোপ্লাস্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে।
-
প্লাস্টিডের কাজ কী?
প্লাস্টিডের প্রধান কাজ হলো খাদ্য তৈরি, খাদ্য সঞ্চয় এবং কোষের রঙ নির্ধারণ করা। এছাড়াও, এটি উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে।
-
প্লাস্টিড কি বংশগত?
হ্যাঁ, প্লাস্টিড বংশগত। এটি মাতৃকোষ থেকে অপত্য কোষে স্থানান্তরিত হয়।
-
প্লাস্টিডের গঠন কেমন?
প্লাস্টিডের গঠন বেশ জটিল। এর মধ্যে দুটি ঝিল্লি (membrane) থাকে: বাইরের ঝিল্লি এবং ভেতরের ঝিল্লি। ভেতরের অংশে স্ট্রোমা (stroma), থাইলাকয়েড (thylakoid) এবং গ্রানা (grana) নামক অংশগুলো থাকে।
প্লাস্টিড নিয়ে আরও কিছু মজার তথ্য:
- প্লাস্টিড এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন, আলোর অভাবে ক্লোরোপ্লাস্ট লিউকোপ্লাস্টে পরিণত হতে পারে।
- কিছু উদ্ভিদের প্লাস্টিডগুলো জেনেটিক্যালি মডিফায়েড (genetically modified) করা যায়, যাতে তারা আরও বেশি খাদ্য উৎপাদন করতে পারে।
- প্লাস্টিড উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করে।
উপসংহার: প্লাস্টিড – জীবনের ভিত্তি
প্লাস্টিড হলো উদ্ভিদকোষের (plant cell) এক অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গাণু, যা সালোকসংশ্লেষণ থেকে শুরু করে খাদ্য সঞ্চয় এবং রঙ নির্ধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে থাকে। এটি শুধু উদ্ভিদের জন্য নয়, বরং সমগ্র জীবজগতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিড না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যেত।
আশা করি, প্লাস্টিড নিয়ে আজকের আলোচনাটি আপনার ভালো লেগেছে। যদি আপনার মনে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট সেকশনে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ, বিজ্ঞানকে ভালোবাসুন, প্রকৃতির রহস্য উদঘাটনে সবসময় আগ্রহী থাকুন!