জিনিসটা কী, মশাই? পলিমার!
আচ্ছা, আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনার হাতে থাকা পলিথিনের ব্যাগটা কী দিয়ে তৈরি? কিংবা আপনার পরনের জামাকাপড়টাই বা কী দিয়ে বানানো? উত্তরটা হলো – পলিমার! পলিমার নামটা একটু কঠিন হলেও, জিনিসটা কিন্তু খুবই সহজ। এটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ। আসুন, আজ আমরা পলিমারের অন্দরমহলে একটু ঢুঁ মেরে আসি!
পলিমার কী: একটা সহজ ধারণা
পলিমার হলো ছোট ছোট অনেকগুলো অণু জুড়ে তৈরি হওয়া একটা বিশাল আকারের অণু। অনেকটা যেন অনেকগুলো ইঁট গেঁথে একটা দেওয়াল তৈরি করা। এখানে ছোট ছোট অণুগুলোকে বলা হয় ” monomer ” ( মনোমার )। আর এই মনোমারগুলো যখন রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে একটা বড় কাঠামো তৈরি করে, তখন তাকে আমরা বলি ” polymer ” ( পলিমার )।
“পলিমার” শব্দটির মানে কী?
“পলিমার” শব্দটা এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। “পলি” মানে হলো “বহু” বা “অনেক” আর “মেরোস” মানে হলো “অংশ” বা “খণ্ড”। তাহলে, পলিমার মানে দাঁড়ালো – অনেকগুলো ছোট ছোট অংশ জুড়ে তৈরি হওয়া কিছু।
পলিমার কীভাবে তৈরি হয়?
পলিমার তৈরির প্রক্রিয়াকে বলা হয় পলিমারাইজেশন ( Polymerization )। এই প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো মনোমার একসাথে যুক্ত হয়ে একটা পলিমার চেইন তৈরি করে। পলিমারাইজেশন বিভিন্ন উপায়ে হতে পারে, যেমন –
- যোগ পলিমারাইজেশন (Addition Polymerization): এখানে মনোমারগুলো সরাসরি একে অপরের সাথে যুক্ত হয়, কোনো কিছু বাদ যায় না। অনেকটা যেন লেগোর ব্লক জুড়ে একটা কিছু বানানো।
- কন্ডেন্সেশন পলিমারাইজেশন (Condensation Polymerization): এই প্রক্রিয়ায় মনোমারগুলো যুক্ত হওয়ার সময় ছোট অণু, যেমন জল (H₂O) অথবা মিথানল (CH₃OH) নির্গত হয়।
পলিমারের প্রকারভেদ
পলিমার বিভিন্ন রকমের হতে পারে, তাদের গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে। প্রধানত এদেরকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়:
প্রাকৃতিক পলিমার (Natural Polymers)
প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এমন পলিমারগুলোকে প্রাকৃতিক পলিমার বলে। এগুলো সাধারণত জীবজন্তু ও উদ্ভিদের মধ্যে পাওয়া যায়। কিছু উদাহরণ:
স্টার্চ (Starch)
আলু, চাল, গম – এসবের মধ্যে স্টার্চ থাকে। এটা আসলে গ্লুকোজের পলিমার। আমাদের শরীরে শক্তি জোগানো এর প্রধান কাজ।
সেলুলোজ (Cellulose)
গাছপালার কোষ প্রাচীর সেলুলোজ দিয়ে তৈরি। কাগজ, কাঠ, কাপড় – সবকিছুতেই সেলুলোজ আছে।
প্রোটিন (Protein)
আমাদের শরীরের পেশি, চুল, চামড়া – সবকিছু প্রোটিন দিয়ে তৈরি। প্রোটিন হলো অ্যামিনো অ্যাসিডের পলিমার।
ডিএনএ (DNA) ও আরএনএ (RNA)
এগুলো আমাদের বংশগতির ধারক ও বাহক। এগুলো নিউক্লিওটাইডের পলিমার।
কৃত্রিম পলিমার (Synthetic Polymers)
মানুষ তৈরি করে এমন পলিমারগুলোকে কৃত্রিম পলিমার বলে। এগুলো সাধারণত পেট্রোলিয়াম থেকে তৈরি হয়। এদের কিছু উদাহরণ:
পলিথিন (Polythene)
পলিথিনের ব্যাগ, বোতল, খেলনা – সবকিছু পলিথিন দিয়ে তৈরি। এটা ইথিলিনের পলিমার। এই পলিথিন কিভাবে তৈরি হয় জানেন তো?
পলিপ্রোপিলিন (Polypropylene)
পলিপ্রোপিলিনের কন্টেইনার, দড়ি, কার্পেট – এগুলো খুব পরিচিত জিনিস। এটা প্রোপিলিনের পলিমার।
পিভিসি (PVC)
পিভিসির পাইপ, জলের ট্যাঙ্ক, উইন্ডো ফ্রেম – এগুলো বহুল ব্যবহৃত। এটা ভিনাইল ক্লোরাইডের পলিমার।
নাইলন (Nylon)
নাইলনের দড়ি, জামাকাপড়, মোজা – এগুলো খুব টেকসই হয়।
টেফলন (Teflon)
ননস্টিক প্যান, বৈদ্যুতিক তারের ইনসুলেশন – এসব কাজে টেফলন ব্যবহার করা হয়।
পলিমারের বৈশিষ্ট্য
পলিমারের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যা এদেরকে অন্যান্য পদার্থ থেকে আলাদা করে।
- নমনীয়তা (Flexibility): পলিমার সাধারণত নমনীয় হয়, তাই এদেরকে সহজে বাঁকানো বা মোড়ানো যায়।
- টেকসই (Durability): অনেক পলিমার খুব টেকসই হয়, তাই এরা সহজে ভাঙে না বা নষ্ট হয় না।
- রাসায়নিক প্রতিরোধ (Chemical Resistance): কিছু পলিমার অ্যাসিড, ক্ষার বা অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে না।
- বিদ্যুৎ অপরিবাহী (Electrical Insulator): পলিমার সাধারণত বিদ্যুৎ অপরিবাহী হয়, তাই এদেরকে বৈদ্যুতিক তারের ইনসুলেশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- তাপ প্রতিরোধ (Heat Resistance): কিছু পলিমার উচ্চ তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারে।
পলিমার চেনার উপায়
বিভিন্ন পলিমারের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হওয়ার কারণে এদেরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন –
- পলিথিন হালকা এবং জলে ভাসে।
- পিভিসি ভারী এবং জলে ডুবে যায়।
- নাইলন আগুনে পোড়ালে চুলের মতো গন্ধ বের হয়।
দৈনন্দিন জীবনে পলিমারের ব্যবহার
আমরা প্রতি মুহূর্তে পলিমার ব্যবহার করছি! সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের জীবনে পলিমারের ব্যবহার ছড়িয়ে আছে।
- পোশাক (Clothing): আমাদের জামাকাপড়ের একটা বড় অংশ পলিমার দিয়ে তৈরি, যেমন পলিয়েস্টার, নাইলন ইত্যাদি।
- খাবার প্যাকেট (Food Packaging): খাবার জিনিসপত্র প্যাকেট করার জন্য পলিথিন, পলিপ্রোপিলিন ব্যবহার করা হয়।
- ঘরবাড়ি (Home): আমাদের ঘরের আসবাবপত্র, জলের পাইপ, রং – সবকিছুতেই পলিমার ব্যবহার করা হয়।
- পরিবহন (Transportation): গাড়ির টায়ার, গাড়ির বিভিন্ন অংশ, এমনকি রাস্তা তৈরিতেও পলিমার ব্যবহার করা হয়।
- চিকিৎসা (Medical): সিরিঞ্জ, ওষুধের প্যাকেট, কৃত্রিম অঙ্গ – সবকিছুতেই পলিমারের ব্যবহার আছে।
পলিমারের সুবিধা ও অসুবিধা
যেকোনো জিনিসেরই ভালো-খারাপ দুটো দিক থাকে। পলিমারেরও কিছু সুবিধা ও অসুবিধা আছে।
সুবিধা
- পলিমার খুব হালকা হয়, তাই এদের বহন করা সহজ।
- এগুলো সহজে তৈরি করা যায় এবং দামেও সস্তা।
- এদের বিভিন্ন রঙে ও আকারে তৈরি করা যায়।
- অনেক পলিমার পুনর্ব্যবহারযোগ্য (recyclable)।
অসুবিধা
- কিছু পলিমার সহজে ভাঙে বা নষ্ট হয়।
- পলিমার পোড়ালে ক্ষতিকর গ্যাস বের হয়।
- সব পলিমার পুনর্ব্যবহার করা যায় না।
- মাটিতে মিশে যেতে অনেক সময় লাগে, তাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
পলিমার এবং পরিবেশ
পলিমারের ব্যবহার আমাদের জীবনকে সহজ করে দিলেও, এর কিছু খারাপ প্রভাব পরিবেশের উপর পড়ে।
পরিবেশ দূষণ
প্লাস্টিক বা পলিথিন সহজে মাটিতে মেশে না, তাই এগুলো বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকে এবং পরিবেশ দূষণ করে। এছাড়া, এগুলো ড্রেনে আটকে গিয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।
পুনর্ব্যবহার (Recycling)
পলিমারের পুনর্ব্যবহার পরিবেশ দূষণ কমাতে সাহায্য করে। পুরনো প্লাস্টিক রিসাইকেল করে নতুন জিনিস তৈরি করা যায়।
বিকল্প উপায়
প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে কাগজ, পাট, বাঁশ বা অন্যান্য প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া, বায়োডিগ্রেডেবল (biodegradable) পলিমার ব্যবহার করা যেতে পারে, যা সহজে মাটিতে মিশে যায়।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
পলিমার নিয়ে আপনাদের মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। তাই এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
পলিমার কত প্রকার?
পলিমারকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: প্রাকৃতিক পলিমার (Natural Polymers) এবং কৃত্রিম পলিমার (Synthetic Polymers)। এছাড়া, এদের গঠন ও বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে আরও অনেক ভাগে ভাগ করা যায়।
সব পলিমার কি প্লাস্টিক?
না, সব পলিমার প্লাস্টিক নয়। প্লাস্টিক হলো এক ধরনের পলিমার যা সহজে আকার দেওয়া যায়। কিন্তু পলিমার আরও অনেক রকমের হতে পারে, যেমন রাবার, ফাইবার ইত্যাদি।
পলিমার কীভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায়?
পলিমার পুনর্ব্যবহার করার জন্য প্রথমে এগুলোকে আলাদা করতে হয়। তারপর সেগুলোকে ছোট ছোট টুকরা করে গলিয়ে নতুন জিনিস তৈরি করা হয়।
কোন পলিমার পরিবেশ বান্ধব?
বায়োডিগ্রেডেবল পলিমার (Biodegradable Polymers) পরিবেশ বান্ধব। এগুলো প্রাকৃতিকভাবে ভেঙে মাটিতে মিশে যেতে পারে।
পলিমার এবং মনোমারের মধ্যে পার্থক্য কী?
পলিমার হলো অনেকগুলো মনোমার (ছোট অণু) জুড়ে তৈরি হওয়া একটা বড় অণু। মনোমার হলো পলিমারের বিল্ডিং ব্লক। অনেকটা ইঁট এবং দেয়ালের মতো।
পলিমার কিভাবে আমাদের জীবনে সাহায্য করে?
পলিমার আমাদের জীবনে অনেকভাবে সাহায্য করে। পোশাক, খাবার প্যাকেট, ঘরবাড়ি, পরিবহন, চিকিৎসা – সব ক্ষেত্রেই পলিমারের ব্যবহার রয়েছে। এটি আমাদের জীবনকে সহজ ও উন্নত করে।
পলিমার কি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর?
কিছু পলিমার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, কারণ এগুলো সহজে মাটিতে মিশে যায় না এবং পরিবেশ দূষণ করে। তবে রিসাইক্লিং এবং বায়োডিগ্রেডেবল পলিমার ব্যবহারের মাধ্যমে এই ক্ষতি কমানো সম্ভব।
পলিমার নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- প্রাচীনকালে মানুষ প্রাকৃতিক পলিমার যেমন রেশম, উল, চামড়া ব্যবহার করত।
- প্রথম কৃত্রিম পলিমার ছিল বেকেলাইট (Bakelite), যা ১৯০৭ সালে তৈরি করা হয়েছিল।
- প্লাস্টিক দূষণ কমাতে অনেক দেশে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
- বিজ্ঞানীরা এখন এমন পলিমার তৈরির চেষ্টা করছেন, যা সূর্যের আলোতে নিজে থেকেই ভেঙে যাবে।
উপসংহার: পলিমারের ভবিষ্যৎ
পলিমার আমাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর ব্যবহার কমানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে। রিসাইক্লিং এবং বিকল্প পলিমার ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করতে পারি।
আশা করি, “পলিমার কাকে বলে” এই বিষয়ে আপনার ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। যদি আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর এই লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না! তাহলে, আজকের মতো বিদায়। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!