শুরু করি তাহলে? “পর্বতমালা কাকে বলে” এই প্রশ্নের সহজ উত্তর আর মজার কিছু তথ্য দিয়ে একটা ব্লগ পোস্ট লেখা যাক!
আচ্ছা, কখনো কি মেঘ ছুঁতে ইচ্ছে করেছে? অথবা মনে হয়েছে, যদি পাখির মতো উড়ে গিয়ে দূরের পাহাড়টা দেখে আসতে পারতাম? পাহাড়, পর্বতমালা—এগুলো শুনলেই যেন একটা রোমাঞ্চ জাগে, তাই না? কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো ঠিকভাবে জানি না, পর্বতমালা আসলে কী!
আজ আমরা “পর্বতমালা কাকে বলে” সেই নিয়েই আলোচনা করব। শুধু সংজ্ঞা নয়, পর্বতমালা কীভাবে তৈরি হয়, এর গুরুত্ব কী, আর আমাদের আশেপাশে কী কী পর্বতমালা আছে, সেই সব কিছুই থাকবে আজকের লেখায়। তাহলে, চলুন শুরু করা যাক!
পর্বতমালা কী? (পর্বতমালার সংজ্ঞা)
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, পর্বতমালা হলো অনেকগুলো পর্বত বা পাহাড় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে পরপর বা সারিবদ্ধভাবে অবস্থান করলে তাকে পর্বতমালা বলে। একটি পর্বতমালার পর্বতগুলো একই সময়ে এবং একই ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হতে পারে। এদের উচ্চতা সাধারণত ৬০০ মিটারের বেশি হয়। তবে এর চেয়ে কম উচ্চতার পাহাড়গুলোও কোনো বৃহত্তর পর্বতমালা বা পার্বত্য অঞ্চলের অংশ হতে পারে।
পর্বতমালাকে ইংরেজিতে Mountain Range বা Hill Range বলা হয়।
পর্বত এবং পাহাড়ের মধ্যে পার্থক্য কী?
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, পর্বত আর পাহাড় কি একই জিনিস? একদমই না! এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
বৈশিষ্ট্য | পর্বত | পাহাড় |
---|---|---|
উচ্চতা | সাধারণত ৬০০ মিটারের বেশি | সাধারণত ৬০০ মিটারের কম |
ভূ-গঠন | খাড়া ঢাল এবং তীক্ষ্ণ চূড়া বিশিষ্ট | মৃদু ঢাল এবং গোলাকার চূড়া বিশিষ্ট |
গঠন প্রক্রিয়া | টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি | ক্ষয়, সঞ্চয় এবং টেকটোনিক কারণে গঠিত হতে পারে |
পর্বতমালা কীভাবে গঠিত হয়? (পর্বতমালার গঠন প্রক্রিয়া)
পর্বতমালা সৃষ্টির পেছনে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো:
টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ
পৃথিবীর উপরিভাগ কতগুলো প্লেট দিয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলো যখন একে অপরের দিকে ধাবিত হয় এবং সংঘর্ষ হয়, তখন প্রবল চাপের কারণে ভূমি ভাঁজ হয়ে উপরে উঠে যায়। এই ভাঁজগুলোই ধীরে ধীরে পর্বতমালার আকার নেয়। হিমালয় পর্বতমালা এভাবেই তৈরি হয়েছে।
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত
ভূগর্ভের ম্যাগমা যখন ভূপৃষ্ঠের দুর্বল স্থান দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং জমা হতে থাকে, তখন আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি হয়। ক্রমাগত অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এই আগ্নেয়গিরিগুলো একত্রিত হয়ে পর্বতমালা তৈরি করতে পারে। হাওয়াই দ্বীপের মৌনা লোয়া আগ্নেয়গিরি এর একটি উদাহরণ।
চ্যুতি বা ফল্টিং
ভূ-আলোড়নের কারণে শিলাস্তরে ফাটল সৃষ্টি হলে একটি অংশ অন্য অংশের সাপেক্ষে উপরে উঠে যায় বা নিচে নেমে যায়। এই কারণেও পর্বতমালা গঠিত হতে পারে।
পর্বতমালার প্রকারভেদ
ভূ-গঠন ও উৎপত্তির কারণের ওপর ভিত্তি করে পর্বতমালাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
ভঙ্গিল পর্বতমালা (Fold Mountains)
টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট পর্বতমালা ভঙ্গিল পর্বতমালা নামে পরিচিত। এদের বৈশিষ্ট্য হলো ভাঁজযুক্ত শিলাস্তর। হিমালয়, আল্পস, আন্দিজ পর্বতমালা ভঙ্গিল পর্বতমালার উদাহরণ।
স্তূপ পর্বতমালা (Block Mountains)
চ্যুতি বা ফল্টিংয়ের কারণে ভূপৃষ্ঠের কোনো অংশ উপরে উঠে গেলে স্তূপ পর্বতমালা গঠিত হয়। জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট এর একটি উদাহরণ।
আগ্নেয় পর্বতমালা (Volcanic Mountains)
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে সৃষ্ট পর্বতমালা আগ্নেয় পর্বতমালা নামে পরিচিত। জাপানের মাউন্ট ফুজি এর একটি উদাহরণ।
অবশিষ্ট পর্বতমালা (Residual Mountains)
ক্ষয়কার্যের ফলে প্রাচীন পর্বতমালা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অবশিষ্ট অংশের মাধ্যমে গঠিত পর্বতমালা অবশিষ্ট পর্বতমালা নামে পরিচিত। ভারতের আরাবল্লী পর্বতমালা এর একটি উদাহরণ।
পর্বতমালার গুরুত্ব
আমাদের জীবনে পর্বতমালার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
জলবায়ুর নিয়ন্ত্রণ
পর্বতমালা বায়ুপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে। এর ফলে কোনো অঞ্চলে জলবায়ু শীতল থাকে আবার কোনো অঞ্চলে উষ্ণ।
নদীর উৎস
অধিকাংশ নদীর উৎস হলো পর্বতমালা। বরফগলা পানি ও বৃষ্টির পানি একত্রিত হয়ে নদীর সৃষ্টি করে, যা আমাদের জীবন এবং প্রকৃতির জন্য অপরিহার্য।
জীববৈচিত্র্য
পর্বতমালার বিভিন্ন উচ্চতায় বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী বাস করে। এটি জীববৈচিত্র্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
খনিজ সম্পদ
পর্বতমালার অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান খনিজ সম্পদ পাওয়া যায়, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পর্যটন
পর্বতমালার নৈসর্গিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এটি পর্যটন শিল্পের বিকাশে সাহায্য করে এবং স্থানীয় অর্থনীতির উন্নতি ঘটায়।
বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্বতমালা
বাংলাদেশ মূলত একটি নদীমাতৃক দেশ হলেও এখানে কিছু পাহাড় ও পর্বতমালা রয়েছে। এগুলো আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বতমালা নিচে উল্লেখ করা হলো:
পার্বত্য চট্টগ্রাম
এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত। এই অঞ্চলে ছোট-বড় অনেক পাহাড় রয়েছে। এখানকার প্রধান পর্বতশ্রেণীগুলো হলো:
- লুসাই পাহাড়: এটি মিজোরামের লুসাই পাহাড়ের অংশ, যা বাংলাদেশেও বিস্তৃত।
- মুরং পাহাড়: এটি বান্দরবান জেলায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু পর্বতশ্রেণী।
- কেরালা ডং: এটিও বান্দরবানে অবস্থিত, যা দুর্গম এবং ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত।
সিলেট অঞ্চলের পাহাড়
সিলেট অঞ্চলে বেশ কিছু টিলা ও পাহাড় রয়েছে, যা এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এখানকার উল্লেখযোগ্য পাহাড়গুলো হলো:
- খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়: এই পাহাড়গুলো ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
- আতরমুড়া পাহাড়: এটি সিলেট জেলার একটি উল্লেখযোগ্য পাহাড়।
কিছু মজার তথ্য (পর্বতমালা নিয়ে কিছু তথ্য)
- পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতমালা হলো আন্দিজ পর্বতমালা, যা প্রায় ৭০০০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত।
- হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত মাউন্ট এভারেস্ট পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এর উচ্চতা প্রায় ৮৮৪৮.৮৬ মিটার।
- আল্পস পর্বতমালা ইউরোপের অন্যতম বিখ্যাত পর্বতমালা, যা সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া জুড়ে বিস্তৃত।
- “পর্বত” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ “পর্বত” থেকে, যার অর্থ বিশাল পাথর বা স্তূপ।
প্রশ্নোত্তর (পর্বতমালার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর)
পর্বতমালা এবং পর্বত শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য কী?
পর্বতমালা হলো একটি বৃহত্তর অঞ্চল, যেখানে অনেকগুলো পর্বত সারিবদ্ধভাবে বা কাছাকাছি অবস্থান করে। অন্যদিকে, পর্বতশ্রেণী হলো একটি নির্দিষ্ট সারিতে থাকা পর্বতগুলোর সমষ্টি, যা একটি নির্দিষ্ট দিকে বিস্তৃত। একটি পর্বতমালা অনেকগুলো পর্বতশ্রেণী নিয়ে গঠিত হতে পারে।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কোনটি?
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হলো সাকা হাফং (Saka Haphong), যা বান্দরবান জেলায় অবস্থিত। এর উচ্চতা প্রায় ১০৫২ মিটার (৩৪৫১ ফুট)। যদিও কেউ কেউ মনে করেন কেউক্রাডং (Keokradong) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, তবে সাকা হাফং-এর উচ্চতা বেশি।
পর্বতমালা কি শুধু স্থলভাগেই দেখা যায়?
না, পর্বতমালা শুধু স্থলভাগেই নয়, সমুদ্রের নিচেও দেখা যায়। সমুদ্রের নিচে অবস্থিত পর্বতমালাকে শৈলশিরা (Oceanic Ridge) বলা হয়।
পর্বতমালা আমাদের জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলে?
পর্বতমালার প্রভাব আমাদের জীবনে অনেক। এটি জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে, নদীর উৎস হিসেবে কাজ করে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে, খনিজ সম্পদ সরবরাহ করে এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশে সাহায্য করে। এছাড়াও, এটি আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ।
পর্বতমালা ধসে যাওয়ার কারণ কি?
পর্বতমালা বিভিন্ন কারণে ধসে যেতে পারে, যার মধ্যে অন্যতম হলো:
- প্রাকৃতিক কারণ: ভূমিকম্প, ভারী বৃষ্টিপাত, ভূমিধস, এবং বরফ গলার কারণে পর্বতমালা ধসে যেতে পারে।
- মানবসৃষ্ট কারণ: অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন, বনভূমি ধ্বংস, অপরিকল্পিত নির্মাণ, এবং খনি কার্যক্রমের কারণেও পর্বতমালা ধসে যেতে পারে।
শেষ কথা (উপসংহার)
আশা করি, “পর্বতমালা কাকে বলে” সেই প্রশ্নের উত্তর তোমরা পেয়ে গেছো। শুধু তাই নয়, পর্বতমালা কীভাবে তৈরি হয়, এর প্রকারভেদ, গুরুত্ব এবং আমাদের দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্বতমালা সম্পর্কেও তোমরা জানতে পারলে।
প্রকৃতির এই বিশাল স্তম্ভগুলো শুধু সৌন্দর্য্যের প্রতীক নয়, এগুলো আমাদের পরিবেশ ও জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই, আমাদের উচিত এই পর্বতমালাকে রক্ষা করা এবং এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
যদি তোমাদের মনে পর্বতমালা নিয়ে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারো। আর এই লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলো না।
পরবর্তী ব্লগ পোস্টে আবার দেখা হবে! ততদিন পর্যন্ত ভালো থেকো, সুস্থ থেকো। আর হ্যাঁ, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে ভুলো না!