আজ আমরা জানবো পরিবেশ কাকে বলে
আচ্ছা, চারদিকে তাকিয়ে দেখুন তো! গাছপালা, নদীনালা, আকাশ, মাটি, ঘরবাড়ি – সবকিছু মিলিয়েই কিন্তু আমাদের পরিবেশ। সহজ ভাষায়, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, যা আমাদের জীবন এবং প্রকৃতির ওপর প্রভাব ফেলে, তাই হলো পরিবেশ। চলুন, একটু গভীরে গিয়ে পরিবেশের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ এবং এর সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
পরিবেশ: একটি সামগ্রিক ধারণা
পরিবেশ শুধু কয়েকটি জড়বস্তু বা উপাদানের সমষ্টি নয়, বরং এটি জীব ও জড়ের মধ্যে এক জটিল সম্পর্ক। মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা এবং এদের সাথে জড়িত ভৌত ও রাসায়নিক উপাদানগুলো একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
পরিবেশের সংজ্ঞা কী?
“পরিবেশ হলো সেই সবকিছু যা একজন জীবকে ঘিরে থাকে এবং তার জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে।” এটি একটি ব্যাপক সংজ্ঞা, যার মধ্যে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক উভয় উপাদানই অন্তর্ভুক্ত।
- প্রাকৃতিক উপাদান: আলো, বাতাস, মাটি, পানি, গাছপালা, জীবজন্তু ইত্যাদি প্রকৃতির নিজস্ব উপাদান।
- সামাজিক উপাদান: ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি মানুষের তৈরি উপাদান।
পরিবেশের প্রকারভেদ
পরিবেশকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- প্রাকৃতিক পরিবেশ (Natural Environment): প্রকৃতির নিজস্ব উপাদান নিয়ে গঠিত। এখানে মানুষের হস্তক্ষেপ কম থাকে।
- সাংস্কৃতিক বা সামাজিক পরিবেশ(Cultural or Social Environment): মানুষের তৈরি উপাদান ও সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে গঠিত।
প্রাকৃতিক পরিবেশ
প্রাকৃতিক পরিবেশ আবার বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত, যেমন:
- বায়ুমণ্ডল (Atmosphere): পৃথিবীর চারপাশের গ্যাসীয় আবরণ। এটি আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস এবং আবহাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- বারিমণ্ডল (Hydrosphere): পৃথিবীর সমস্ত জলীয় অংশ, যেমন – নদী, সমুদ্র, হ্রদ, পুকুর ইত্যাদি।
- ভূমণ্ডল (Lithosphere): পৃথিবীর কঠিন উপরিভাগ, যা মাটি, পাথর এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ দিয়ে গঠিত।
- জীবমণ্ডল (Biosphere): যেখানে উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অন্যান্য জীব বাস করে। এটি বায়ুমণ্ডল, বারিমণ্ডল এবং ভূমণ্ডলের সমন্বয়ে গঠিত।
সামাজিক পরিবেশ
সামাজিক পরিবেশ মানুষের জীবনযাত্রার পদ্ধতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত। এটি আমাদের চারপাশের সব সামাজিক কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে।
- আর্থিক পরিবেশ: মানুষের আয়, সম্পদ, উৎপাদন এবং ভোগের সাথে সম্পর্কিত।
- রাজনৈতিক পরিবেশ: দেশের সরকার, আইনকানুন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দ্বারা প্রভাবিত।
- সাংস্কৃতিক পরিবেশ: মানুষের রীতিনীতি, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ এবং বিশ্বাস দ্বারা গঠিত।
পরিবেশের উপাদান
পরিবেশের উপাদানগুলোকে প্রধানত দুইটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:
- জীব উপাদান (Biotic Components): জীবন্ত সবকিছু, যেমন – মানুষ, উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব ইত্যাদি।
- অজীব উপাদান (Abiotic Components): জড় পদার্থ, যেমন – মাটি, পানি, বাতাস, আলো, তাপমাত্রা, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি।
জীব উপাদান
জীব উপাদানগুলো একে অপরের উপর নির্ভরশীল। উদ্ভিদ সূর্যের আলো ব্যবহার করে খাদ্য তৈরি করে, যা প্রাণীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। অণুজীব মৃত জীবদেহকে পচিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়, যা উদ্ভিদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
অজীব উপাদান
অজীব উপাদানগুলো জীবজগতের জন্য অপরিহার্য। আলো, বাতাস, পানি ছাড়া কোনো জীব বাঁচতে পারে না। মাটির উর্বরতা উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাপমাত্রা জীবজগতের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে।
পরিবেশের গুরুত্ব
আমাদের জীবনে পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশ আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য – সবকিছু সরবরাহ করে। পরিবেশের উপাদানগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় একটি উপাদানের পরিবর্তন অন্য উপাদানকেও প্রভাবিত করে।
খাদ্য ও পুষ্টি
পরিবেশ আমাদের খাদ্য এবং পুষ্টির প্রধান উৎস। উদ্ভিদ এবং প্রাণী থেকে আমরা খাদ্য পাই। মাটি, পানি এবং আলো উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য, যা আমাদের খাদ্যের যোগান দেয়।
বিশুদ্ধ বাতাস ও পানি
পরিবেশ আমাদের বিশুদ্ধ বাতাস ও পানি সরবরাহ করে। গাছপালা বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ছাড়ে, যা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অপরিহার্য। নদী, পুকুর এবং হ্রদ থেকে আমরা পানি পাই, যা আমাদের জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা
প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, খরা, ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে। বনভূমি ভূমিধস এবং বন্যা প্রতিরোধ করে। উপকূলীয় বনভূমি ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ কমায়।
পরিবেশ দূষণ
পরিবেশ দূষণ হলো পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন, যা জীবজগতের জন্য ক্ষতিকর। দূষণ বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন – শিল্পকারখানা, যানবাহন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, নগরায়ণ ইত্যাদি।
দূষণের প্রকারভেদ
দূষণ প্রধানত কয়েক প্রকার:
- বায়ু দূষণ: বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাস ও ধূলিকণার মিশ্রণ।
- পানি দূষণ: পানিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ও জীবাণুর মিশ্রণ।
- মাটি দূষণ: মাটিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ও বর্জ্যের মিশ্রণ।
- শব্দ দূষণ: অতিরিক্ত শব্দ, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
দূষণের কারণ
- শিল্পকারখানা: শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও বর্জ্য বায়ু ও পানি দূষণ করে।
- যানবাহন: যানবাহনের ধোঁয়া বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ।
- কৃষি কার্যক্রম: রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার মাটি ও পানি দূষণ করে।
- নগরায়ণ: অপরিকল্পিত নগরায়ণ পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ।
পরিবেশ সুরক্ষার উপায়
পরিবেশ সুরক্ষার জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় – প্রতিটি স্তরে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে।
- বৃক্ষরোপণ: বেশি করে গাছ লাগাতে হবে, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে।
- দূষণ নিয়ন্ত্রণ: কলকারখানার বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলতে হবে। যানবাহনের ধোঁয়া কমাতে হবে।
- পুনর্ব্যবহার: পুরনো জিনিসপত্র পুনর্ব্যবহার করতে হবে, যাতে বর্জ্য কম হয়।
- সচেতনতা: পরিবেশ সুরক্ষার জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
ব্যক্তিগত উদ্যোগ
- বিদ্যুৎ ও পানি সাশ্রয় করুন।
- প্লাস্টিক ব্যবহার কমান এবং পুনর্ব্যবহার করুন।
- গণপরিবহন ব্যবহার করুন অথবা হেঁটে বা সাইকেলে চলাচল করুন।
- বাড়ির আশেপাশে গাছ লাগান এবং পরিচর্যা করুন।
সামাজিক উদ্যোগ
- পরিবেশ সুরক্ষার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন।
- বিদ্যালয় ও কলেজে পরিবেশ ক্লাব গঠন করুন।
- পরিবেশ দিবস ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরুন।
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ
- পরিবেশ সুরক্ষার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করুন।
- দূষণকারী শিল্পকারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।
- বনায়ন কর্মসূচি জোরদার করুন।
- পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত করুন।
পরিবেশ নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
পরিবেশ কাকে বলে বুঝিয়ে বলুন?
সহজ ভাষায়, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে – গাছপালা, নদীনালা, মাটি, বাতাস, মানুষ, জীবজন্তু – সবকিছু মিলিয়েই পরিবেশ। এটি আমাদের জীবন এবং প্রকৃতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
পরিবেশ কত প্রকার?
পরিবেশ প্রধানত দুই প্রকার: প্রাকৃতিক পরিবেশ (Natural Environment) এবং সামাজিক পরিবেশ (Social Environment)। প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রকৃতির নিজস্ব উপাদান দিয়ে গঠিত, আর সামাজিক পরিবেশ মানুষের তৈরি উপাদান ও সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে গঠিত।
পরিবেশের উপাদানগুলো কী কী?
পরিবেশের উপাদানগুলোকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: জীব উপাদান (Biotic Components) এবং অজীব উপাদান (Abiotic Components)। জীব উপাদানের মধ্যে রয়েছে জীবন্ত সবকিছু, যেমন – মানুষ, উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব ইত্যাদি। অজীব উপাদানের মধ্যে রয়েছে জড় পদার্থ, যেমন – মাটি, পানি, বাতাস, আলো, তাপমাত্রা, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি।
পরিবেশ দূষণ কাকে বলে?
পরিবেশ দূষণ হলো পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থার পরিবর্তন, যা জীবজগতের জন্য ক্ষতিকর। দূষণ বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন – শিল্পকারখানা, যানবাহন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, নগরায়ণ ইত্যাদি।
পরিবেশ সুরক্ষার উপায়গুলো কী কী?
পরিবেশ সুরক্ষার অনেক উপায় আছে, যেমন – বেশি করে গাছ লাগানো, দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা, পুরনো জিনিসপত্র পুনর্ব্যবহার করা এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য জনসচেতনতা বাড়ানো। এছাড়া, বিদ্যুৎ ও পানি সাশ্রয় করা, প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো এবং গণপরিবহন ব্যবহার করাও পরিবেশ সুরক্ষার অংশ।
পরিবেশ রক্ষায় আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পরিবেশ রক্ষায় আমাদের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরি করতে হলে পরিবেশের সুরক্ষার বিকল্প নেই।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার
নবায়নযোগ্য জ্বালানি, যেমন – সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ ইত্যাদি ব্যবহার করে আমরা পরিবেশ দূষণ কমাতে পারি। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দিকে ঝুঁকতে হবে।
পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি
পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্পকারখানা ও যানবাহন থেকে নির্গত দূষণ কমানো যায়৷ এর মাধ্যমে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব হ্রাস করা সম্ভব।
শিক্ষা ও সচেতনতা
পরিবেশ শিক্ষা এবং সচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে হবে৷ ছোটবেলা থেকেই পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ তৈরি করতে হবে৷
উপসংহার
পরিবেশ আমাদের জীবন এবং প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সুরক্ষা আমাদের নিজেদের সুরক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আসুন, আমরা সবাই মিলেমিশে পরিবেশকে রক্ষা করি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলি। আপনার ছোট একটি পদক্ষেপও পরিবেশের জন্য অনেক বড় পরিবর্তন আনতে পারে। তাহলে, আজ থেকেই শুরু হোক পরিবেশ রক্ষার যাত্রা। কি বলেন, আপনিও তো আমার সাথে একমত, তাই না?