পরমাণুর নিউক্লিয়াস: বিজ্ঞানের গভীরে ডুব
পরমাণু! ছোটবেলার বিজ্ঞান ক্লাসে এই শব্দটি শুনে কেমন যেন একটা বিস্ময় কাজ করত, তাই না? ভাবতাম, এত ছোট জিনিস, যা খালি চোখে দেখাই যায় না, তার ভেতরে আবার কী কী থাকতে পারে! আজ আমরা সেই পরমাণুর একেবারে কেন্দ্রে ডুব দেব, মানে নিউক্লিয়াস নিয়ে কথা বলব। আপনি যদি বিজ্ঞান ভালোবাসেন বা শুধু কৌতূহলী হন, তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য। পরমাণুর নিউক্লিয়াস আসলে কী, তা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, আর এর ভেতরের জগৎটাই বা কেমন – সবকিছু সহজভাবে জেনে নেওয়া যাক।
পরমাণুর নিউক্লিয়াস কী?
পরমাণুর নিউক্লিয়াস হলো কোনো পরমাণুর একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত অংশ। এটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন (proton) এবং চার্জবিহীন নিউট্রন (neutron) নামক দুটি কণা দিয়ে গঠিত। এই নিউক্লিয়াস পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভর ধারণ করে, যদিও এর আকার পরমাণুর তুলনায় খুবই ছোট। অনেকটা যেন একটা ফুটবল মাঠের মধ্যে একটা মার্বেল!
নিউক্লিয়াসের গঠন: প্রোটন ও নিউট্রনের খেলা
নিউক্লিয়াসের মূল উপাদান হলো প্রোটন ও নিউট্রন। এদেরকে একত্রে নিউক্লিয়নও বলা হয়।
প্রোটন (Proton)
- ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণা।
- নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে।
- কোনো মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা (atomic number) হলো তার নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটনের সংখ্যা।
নিউট্রন (Neutron)
- চার্জবিহীন বা নিস্তড়িৎ কণা।
- নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে।
- পরমাণুর ভর সংখ্যা (mass number) হলো প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা।
এই প্রোটন আর নিউট্রনগুলো একটা শক্তিশালী বলের মাধ্যমে নিউক্লিয়াসের মধ্যে বাঁধা থাকে। এই বলকে বলা হয় সবল নিউক্লিয় বল (strong nuclear force)। এই বল এত শক্তিশালী যে, এটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটনগুলোকে একে অপরের কাছ থেকে বিকর্ষণ করা সত্ত্বেও একত্রে ধরে রাখতে পারে।
নিউক্লিয়াসের আকার ও ভর
নিউক্লিয়াসের আকার পরমাণুর আকারের তুলনায় অনেক ছোট। একটি নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ প্রায় 10^-15 মিটার (1 ফেমটোমিটার)। অন্যদিকে, একটি পরমাণুর ব্যাসার্ধ প্রায় 10^-10 মিটার। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, নিউক্লিয়াস কতটা ছোট!
অন্যদিকে, নিউক্লিয়াস পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভর ধারণ করে। প্রোটন ও নিউট্রনের ভর ইলেকট্রনের ভরের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কারণে নিউক্লিয়াসের ভরই পরমাণুর প্রধান ভর।
নিউক্লিয়াসের গুরুত্ব
পরমাণুর নিউক্লিয়াস কেন এত গুরুত্বপূর্ণ জানেন? এর কয়েকটি কারণ আলোচনা করা যাক:
- মৌলের পরিচয়: নিউক্লিয়াসের প্রোটন সংখ্যা (পারমাণবিক সংখ্যা) একটি মৌলকে অন্য মৌল থেকে আলাদা করে। যেমন, হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন থাকে, হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসে দুটি প্রোটন থাকে।
- রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য: পরমাণুর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য মূলত এর ইলেকট্রন বিন্যাসের ওপর নির্ভর করে, যা নিউক্লিয়াসের প্রোটন সংখ্যা দ্বারা নির্ধারিত হয়।
- ভর ও স্থিতিশীলতা: নিউক্লিয়াসের ভর পরমাণুর স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। নিউক্লিয়াসের গঠন এবং এর ভেতরের কণাগুলোর মিথস্ক্রিয়া পরমাণুর স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।
নিউক্লিয় বিক্রিয়া ও তেজস্ক্রিয়তা
নিউক্লিয়াস শুধু পরমাণুর কেন্দ্র নয়, এটি বিভিন্ন বিক্রিয়ার উৎসও। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিউক্লিয় বিক্রিয়া (nuclear reaction) এবং তেজস্ক্রিয়তা (radioactivity)।
নিউক্লিয় বিক্রিয়া (Nuclear Reaction)
নিউক্লিয় বিক্রিয়া হলো সেই প্রক্রিয়া, যেখানে দুটি নিউক্লিয়াস বা একটি নিউক্লিয়াস এবং অন্য কোনো কণা आपसে সংঘর্ষের মাধ্যমে নতুন নিউক্লিয়াস এবং কণা তৈরি করে। এই বিক্রিয়াগুলোতে প্রচুর পরিমাণে শক্তি নির্গত হতে পারে। এর সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো পারমাণবিক বোমা এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
প্রকারভেদ
নিউক্লিয় বিক্রিয়া বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন:
- ফিশন (Fission): একটি ভারী নিউক্লিয়াস ভেঙে দুটি ছোট নিউক্লিয়াসে পরিণত হওয়া। উদাহরণ: ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর ফিশন।
- ফিউশন (Fusion): দুটি হালকা নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে একটি ভারী নিউক্লিয়াসে পরিণত হওয়া। উদাহরণ: সূর্যের মধ্যে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হওয়া।
তেজস্ক্রিয়তা (Radioactivity)
তেজস্ক্রিয়তা হলো কিছু unstable পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কণা (যেমন আলফা কণা, বিটা কণা) এবং শক্তি (গামা রশ্মি) নির্গত হওয়ার প্রক্রিয়া। এই কণা এবং রশ্মিগুলো জীবন্ত কোষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
প্রকারভেদ
তেজস্ক্রিয়তা প্রধানত তিন প্রকার:
- আলফা ক্ষয় (Alpha decay): নিউক্লিয়াস থেকে একটি আলফা কণা (দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন সমন্বিত হিলিয়াম নিউক্লিয়াস) নির্গত হওয়া।
- বিটা ক্ষয় (Beta decay): নিউক্লিয়াস থেকে একটি বিটা কণা (ইলেকট্রন বা পজিট্রন) নির্গত হওয়া।
- গামা ক্ষয় (Gamma decay): নিউক্লিয়াস থেকে গামা রশ্মি (উচ্চ শক্তি সম্পন্ন ফোটন) নির্গত হওয়া।
নিউক্লিয়াসের ব্যবহার
নিউক্লিয়াসের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছে। এর কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যবহার নিচে উল্লেখ করা হলো:
- বিদ্যুৎ উৎপাদন: পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের ফিশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাপ উৎপন্ন করে সেই তাপ দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়।
- চিকিৎসা বিজ্ঞান: তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়। যেমন, কোবাল্ট-৬০ ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
- কৃষি: তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে ফসলের জাত উন্নয়ন এবং পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
- শিল্প: বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে নিউক্লিয় তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহার করে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়।
নিউক্লিয়াস নিয়ে কিছু মজার তথ্য
পরমাণুর নিউক্লিয়াস সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য জেনে আপনার বিজ্ঞান ভীতি কিছুটা হলেও দূর হবে আশা করি:
- আমাদের শরীর যে কার্বন দিয়ে তৈরি, তা মূলত নক্ষত্রের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে! তার মানে আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে নক্ষত্রের অংশ।
- পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী চুম্বক তৈরি করার জন্য বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়ার স্পিন ব্যবহার করেন।
- নিউক্লিয়াসের ভেতরের কণাগুলো আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে ঘোরে!
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
নিউক্লিয়াস নিয়ে আপনাদের মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। তাই কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কী কী থাকে?
পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন (ধনাত্মক চার্জযুক্ত) ও নিউট্রন (চার্জবিহীন) থাকে।
পারমাণবিক সংখ্যা (atomic number) কী?
কোনো মৌলের নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটনের সংখ্যাকে পারমাণবিক সংখ্যা বলে।
ভর সংখ্যা (mass number) কী?
কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যাকে ভর সংখ্যা বলে।
তেজস্ক্রিয়তা (radioactivity) কী?
কিছু পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কণা ও শক্তি নির্গত হওয়ার প্রক্রিয়া।
পরিশেষ
পরমাণুর নিউক্লিয়াস সত্যিই এক বিস্ময়কর জগৎ। এই ক্ষুদ্র অংশের জ্ঞান আমাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিদ্যা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আপনিও যদি বিজ্ঞান ভালোবাসেন, তাহলে নিউক্লিয়াস নিয়ে আরও পড়াশোনা করতে পারেন। কে জানে, হয়তো আপনিই একদিন নতুন কোনো আবিষ্কার করে ফেলবেন!
যদি এই লেখাটি ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং আপনার মতামত কমেন্টে জানান। আপনার আগ্রহই আমাদের অনুপ্রেরণা।