আচ্ছা, আলোর খেলা দেখতে কেমন লাগে? রংধনু, মরীচিকা, হীরের ঝলকানি—সবকিছুতেই আলোর কারসাজি। আর এই আলোর কারসাজির মূলে রয়েছে এক মজার জিনিস, যার নাম প্রতিসরাঙ্ক। ভাবছেন, এটা আবার কী? আসুন, আজকের লেখায় আমরা সহজ ভাষায় প্রতিসরাঙ্কের রহস্যভেদ করি।
প্রতিসরাঙ্ক: আলোর বাঁক বদলের গল্প
প্রতিসরাঙ্ক (Refractive Index) হলো একটি সংখ্যা, যা আলো যখন একটি মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যায়, তখন কতটা বাঁকবে, তা নির্দেশ করে। সহজভাবে বললে, আলো বাতাস থেকে পানিতে গেলে তার দিক পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের পরিমাণই হলো প্রতিসরাঙ্ক।
আলোর গতি ও প্রতিসরাঙ্ক
আলোর গতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলোর গতি সবচেয়ে বেশি শূন্য মাধ্যমে (Vacuum)। যখন আলো অন্য কোনো মাধ্যমে প্রবেশ করে, তখন তার গতি কমে যায়। প্রতিসরাঙ্ক আলোর এই গতি কমার পরিমাণকেও নির্দেশ করে।
- শূন্য মাধ্যমে আলোর প্রতিসরাঙ্ক: ১
- বাতাসে আলোর প্রতিসরাঙ্ক: প্রায় ১ (1.0003)
- পানিতে আলোর প্রতিসরাঙ্ক: ১.৩৩
- কাঁচের আলোর প্রতিসরাঙ্ক: ১.৫ (প্রকারভেদে ভিন্ন হতে পারে)
এ থেকে বোঝা যায়, আলো যখন বাতাস থেকে পানিতে যায়, তখন তার গতি কমে যায় এবং দিক পরিবর্তিত হয়।
স্নেলের সূত্র (Snell’s Law)
আলোর প্রতিসরণের মূল ভিত্তি হলো স্নেলের সূত্র। এই সূত্র প্রতিসরাঙ্ক এবং আলোর আপতন কোণ (Angle of Incidence) ও প্রতিসরণ কোণের (Angle of Refraction) মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে।
স্নেলের সূত্রটি হলো: n₁ sin θ₁ = n₂ sin θ₂
এখানে,
- n₁ = প্রথম মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক
- θ₁ = আপতন কোণ (incident angle)
- n₂ = দ্বিতীয় মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক
- θ₂ = প্রতিসরণ কোণ (refracted angle)
এই সূত্র ব্যবহার করে, আলোকরশ্মি কোন পথে যাবে, তা সহজেই বের করা যায়।
প্রতিসরাঙ্কের প্রকারভেদ
প্রতিসরাঙ্ক সাধারণত দুই প্রকার হয়ে থাকে:
- পরম প্রতিসরাঙ্ক (Absolute Refractive Index): কোনো মাধ্যমের পরম প্রতিসরাঙ্ক হলো শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ এবং ওই মাধ্যমে আলোর বেগের অনুপাত।
- আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক (Relative Refractive Index): যখন আলো একটি নির্দিষ্ট মাধ্যম থেকে অন্য কোনো মাধ্যমে যায়, তখন প্রথম মাধ্যমের সাপেক্ষে দ্বিতীয় মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ককে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক বলে।
পরম প্রতিসরাঙ্ক কিভাবে বের করা হয়?
পরম প্রতিসরাঙ্ক বের করার নিয়ম হলো:
পরম প্রতিসরাঙ্ক (n) = শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ (c) / মাধ্যমে আলোর বেগ (v)
n = c / v
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক কিভাবে বের করা হয়?
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক বের করার নিয়ম হলো:
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক (n21) = মাধ্যম 1 এর প্রতিসরাঙ্ক (n1) / মাধ্যম 2 এর প্রতিসরাঙ্ক (n2)
n21 = n1 / n2
বাস্তব জীবনে প্রতিসরাঙ্কের ব্যবহার
প্রতিসরাঙ্কের ধারণা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে কাজে লাগে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- লেন্স তৈরি: চশমা, ক্যামেরা বা দূরবীনে ব্যবহৃত লেন্সগুলো প্রতিসরাঙ্কের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। লেন্সের প্রতিসরাঙ্ক আলোর দিক পরিবর্তন করে এবং একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে মিলিত করে (Focus) যা স্পষ্ট প্রতিবিম্ব (ছবি) তৈরিতে সাহায্য করে।
- ফাইবার অপটিক cable: এই ক্যাবলের মধ্যে দিয়ে আলো যায় আলোর প্রতিসরণের মাধ্যমে। এখানে আলোর প্রতিসরাঙ্ক এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যাতে আলো কোনো রকম ক্ষতি ছাড়াই ডেটা পরিবহন করতে পারে।
- সমুদ্রের গভীরতা নির্ণয়: প্রতিসরাঙ্কের কারণে সমুদ্রের গভীরতা নির্ণয় করা যায়।
মরীচিকা: প্রতিসরাঙ্কের একটি চমৎকার উদাহরণ
গরমের দিনে রাস্তায় বা মরুভূমিতে মরীচিকা দেখা যায়। এর কারণ হলো, গরমের কারণে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি বাতাসের স্তরগুলোর ঘনত্ব কম থাকে, ফলে প্রতিসরাঙ্কও ভিন্ন হয়। দূর থেকে আলো যখন এই স্তরগুলোর মধ্যে দিয়ে আসে, তখন ক্রমাগত প্রতিসরণের ফলে এমন একটি বিভ্রম তৈরি হয়, যেখানে মনে হয় দূরে যেন পানি রয়েছে।
কোন মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক বেশি?
যে মাধ্যমে আলোর গতি কম, সেই মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক বেশি। কঠিন পদার্থের প্রতিসরাঙ্ক সাধারণত বেশি হয়, কারণ এর মধ্যে আলোর গতি কম থাকে। অপরদিকে, গ্যাসীয় পদার্থের প্রতিসরাঙ্ক কম হয়।
মাধ্যম | প্রতিসরাঙ্ক |
---|---|
বায়ু | 1.0003 |
পানি | 1.33 |
কাঁচ | 1.5 – 1.9 |
হীরা | 2.42 |
এই তালিকা থেকে স্পষ্ট যে হীরার প্রতিসরাঙ্ক সবচেয়ে বেশি, তাই আলো হীরাতে প্রবেশ করলে সবচেয়ে বেশি বাঁক নেয় এবং এর ফলেই হীরা এত উজ্জ্বল দেখায়।
প্রতিসরাঙ্কের উপর তাপমাত্রার প্রভাব
তাপমাত্রা বাড়লে কোনো মাধ্যমের ঘনত্ব সাধারণত কমে যায়। ঘনত্ব কমার কারণে আলোর গতি বেড়ে যায়, ফলে প্রতিসরাঙ্ক কমে যায়।
আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও প্রতিসরাঙ্ক
আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (Wavelength) ওপরও প্রতিসরাঙ্ক নির্ভর করে। সাধারণত, কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি বেশি বাঁক নেয়। এ কারণেই প্রিজমের মধ্যে দিয়ে সাদা আলো গেলে তা বিভিন্ন রঙে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রত্যেকটি রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভিন্ন হওয়ার কারণে তাদের প্রতিসরণের পরিমাণে ভিন্নতা দেখা যায়।
প্রতিসরাঙ্ক মাপার যন্ত্র
প্রতিসরাঙ্ক মাপার জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তার নাম হলো রিফ্র্যাক্টোমিটার (Refractometer)। এই যন্ত্রের সাহায্যে খুব সহজেই কোনো তরল বা কঠিন পদার্থের প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করা যায়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দ্রবণের ঘনত্ব, চিনির পরিমাণ ইত্যাদিও মাপা যায়।
রিফ্র্যাক্টোমিটার কিভাবে কাজ করে?
রিফ্র্যাক্টোমিটার আলোর প্রতিসরণ নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এই যন্ত্রে একটি আলোক উৎস (Light Source), একটি প্রিজম এবং একটি দেখার টিউব (Viewing Tube) থাকে। যখন আলো কোনো নমুনার (Sample) মধ্যে দিয়ে যায়, তখন আলোর প্রতিসরণের পরিমাণ দেখে প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করা হয়।
প্রতিসরাঙ্ক: কিছু দরকারি প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
প্রতিসরাঙ্ক নিয়ে অনেকের মনে কিছু প্রশ্ন থাকে। তেমনই কিছু প্রশ্নের উত্তর নিচে দেওয়া হলো:
১. প্রতিসরাঙ্ক কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: প্রতিসরাঙ্ক আলোর আচরণ বুঝতে এবং লেন্স, অপটিক্যাল ফাইবারসহ বিভিন্ন অপটিক্যাল যন্ত্র তৈরি করতে খুবই দরকারি।
২. আলোর প্রতিসরণ (Refraction) কী?
উত্তর: আলো যখন এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যায়, তখন এর দিক পরিবর্তনের ঘটনাই হলো আলোর প্রতিসরণ।
৩. প্রতিসরাঙ্কের একক (Unit) কী?
উত্তর: প্রতিসরাঙ্কের কোনো একক নেই, কারণ এটি দুটি বেগের অনুপাত।
৪. কাঁচের প্রতিসরাঙ্ক কত?
উত্তর: কাঁচের প্রতিসরাঙ্ক সাধারণত ১.৫ থেকে ১.৯ এর মধ্যে হয়, যা কাঁচের ধরনের ওপর নির্ভর করে।
৫. পানির প্রতিসরাঙ্ক কত?
উত্তর: পানির প্রতিসরাঙ্ক হলো ১.৩৩।
৬. প্রতিসরাঙ্ক কি আলোর গতি পরিবর্তন করে?
উত্তর: হ্যাঁ, প্রতিসরাঙ্ক আলোর গতি কমিয়ে দেয় যখন এটি একটি মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যায়।
৭. কোন আলোর প্রতিসরাঙ্ক বেশি – লাল নাকি বেগুনী?
উত্তর: বেগুনী আলোর প্রতিসরাঙ্ক বেশি, কারণ এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম।
৮. আলোর প্রতিসরণের সূত্র কে আবিষ্কার করেন?
উত্তর: আলোর প্রতিসরণের সূত্রটি স্নেল (Snell) আবিষ্কার করেন।
৯. সূর্যাস্তের সময় আকাশ লাল দেখায় কেন?
উত্তর: সূর্যাস্তের সময় আলোকরশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে। এ সময় ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো (যেমন: নীল) বেশি বিক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু লাল আলো তুলনামূলকভাবে কম বিক্ষিপ্ত হওয়ায় আমাদের চোখে পৌঁছায় এবং আকাশ লাল দেখায়।
১০. প্রতিসরাঙ্ক এবং প্রতিসরণের মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: প্রতিসরাঙ্ক হলো একটি মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য, যা আলোর গতি কমার পরিমাণ নির্দেশ করে। অন্যদিকে, প্রতিসরণ হলো সেই প্রক্রিয়া, যখন আলো এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যাওয়ার সময় দিক পরিবর্তন করে।
১১. বৃষ্টির পরে কেন রংধনু দেখা যায়?
উত্তর: বৃষ্টির কণাগুলো প্রিজমের মতো কাজ করে। যখন সূর্যের আলো এই কণাগুলোর মধ্যে দিয়ে যায়, তখন আলোর প্রতিসরণ ও বিচ্ছুরণ ঘটে এবং রংধনু সৃষ্টি হয়।
১২. ফাইবার অপটিক ক্যাবলে প্রতিসরাঙ্কের ভূমিকা কী?
উত্তর: ফাইবার অপটিক ক্যাবলে আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন (Total Internal Reflection) ঘটানোর জন্য প্রতিসরাঙ্ক ব্যবহার করা হয়। এর ফলে আলো কোনো রকম ক্ষতি ছাড়াই ডেটা পরিবহন করতে পারে।
আশা করি, এই প্রশ্ন ও উত্তরগুলো প্রতিসরাঙ্ক সম্পর্কে আপনার ধারণা আরও স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে।
শেষ কথা
আলোর এই বাঁক বদলের খেলা আমাদের জীবনে অনেক প্রভাব ফেলে। প্রতিসরাঙ্কের জ্ঞান শুধু বিজ্ঞানাগারেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমাদের চারপাশের জগৎকে বুঝতেও সাহায্য করে। তাই, আলোর এই মজার জগৎ নিয়ে আরও জানার আগ্রহ রাখুন। কে জানে, হয়তো আপনিই একদিন নতুন কোনো আবিষ্কার করে ফেলবেন!