আজকে আমরা কথা বলবো রসায়নের খুব দরকারি একটা বিষয় নিয়ে – সম্পৃক্ত দ্রবণ। জিনিসটা শুনতে হয়তো একটু কঠিন লাগে, কিন্তু বুঝিয়ে বললে দেখবেন এটা আসলে খুবই সহজ! So, let’s dive in!
আপনি হয়তো কখনও চিনি মেশানো শরবত বানিয়েছেন, তাই না? চিনি মেশাতে মেশাতে একটা সময় আসে যখন আর চিনি মিশতে চায় না, যতই নাড়াচাড়া করেন। অনেকটা “বস! আর পারছি না!” মার্কা ব্যাপার। এই যে অবস্থা, এটাই কিন্তু সম্পৃক্ত দ্রবণ (Saturated Solution) এর কাছাকাছি একটা উদাহরণ। তাহলে চলুন, একটু গভীরে গিয়ে দেখা যাক সম্পৃক্ত দ্রবণ আসলে কী, কেন এটা হয়, আর এর ভেতরের রসায়নটাই বা কী!
সম্পৃক্ত দ্রবণ: A Simple Explanation
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, সম্পৃক্ত দ্রবণ হলো সেই দ্রবণ যেখানে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় দ্রাবক (Solvent) আর বেশি দ্রাব (Solute) দ্রবীভূত করতে পারে না। মানে, আপনি যদি একটি গ্লাসে জল নিয়ে তাতে চিনি মেশাতে থাকেন, একটা সময় আসবে যখন আর চিনি গলবে না। পাত্রের তলায় চিনি জমতে শুরু করবে। এই অবস্থাই হলো সম্পৃক্ত দ্রবণ।
ব্যাপারটা অনেকটা এরকম – ধরুন, একটা বাসের মধ্যে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। বাসে যতগুলো সিট আছে, ততজন তো বসেই আছে, কিন্তু দাঁড়িয়েও কিছু লোক আছে। এখন যদি আপনি আরও লোক ঢোকাতে চান, তাহলে কি সবাই ভেতরে ঢুকতে পারবে? পারবে না, কারণ জায়গা নেই। সম্পৃক্ত দ্রবণও অনেকটা তাই। দ্রাবকের মধ্যে দ্রাবের একটা নির্দিষ্ট স্থান আছে। সেই স্থান পূরণ হয়ে গেলে দ্রাব আর ঢুকতে পারে না।
সম্পৃক্ত দ্রবণ চেনার উপায়
আচ্ছা, সম্পৃক্ত দ্রবণটা চিনবেন কী করে? খুব সহজ!
- অতিরিক্ত দ্রাব: যদি দেখেন দ্রবণটিতে অতিরিক্ত দ্রাব (যেমন চিনি বা লবণ) যোগ করার পরেও তা আর দ্রবীভূত হচ্ছে না, বরং পাত্রের নিচে জমা হচ্ছে, তাহলে বুঝবেন দ্রবণটি সম্পৃক্ত হয়ে গেছে।
- স্ফটিক গঠন: অনেক সময় সম্পৃক্ত দ্রবণ ঠান্ডা হতে শুরু করলে দ্রবীভূত হওয়া কঠিন পদার্থগুলো ছোট ছোট স্ফটিকের আকারে জমা হতে শুরু করে। এটা দেখেও আপনি বুঝতে পারবেন দ্রবণটি সম্পৃক্ত।
সম্পৃক্ত দ্রবণ কেন তৈরি হয়?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের একটু ভেতরের খবর নিতে হবে। দ্রবণের মধ্যে আসলে কী ঘটে, সেটা জানতে হবে।
আণবিক স্তরের খেলা
প্রত্যেকটা জিনিসই ছোট ছোট অণু দিয়ে তৈরি, এটা তো আপনি জানেন। দ্রবণ তৈরি হওয়ার সময় দ্রাবকের অণুগুলো দ্রাবের অণুগুলোকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে। এতে দ্রাবের অণুগুলো দ্রাবকের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু যখন দ্রাবকের সব জায়গা দ্রাবের অণু দিয়ে ভরে যায়, তখন নতুন দ্রাবের অণু ঢোকার আর কোনো জায়গা থাকে না।
তাপমাত্রার প্রভাব
এখানে তাপমাত্রার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তাপমাত্রা বাড়ালে দ্রাবকের অণুগুলোর মধ্যেকার বন্ধন দুর্বল হয়ে যায়, ফলে তারা আরও বেশি দ্রাবকে দ্রবীভূত করতে পারে। তাই গরমকালে আপনি শরবতে বেশি চিনি মেশাতে পারবেন, ঠান্ডার সময় তুলনামূলকভাবে কম।
অসম্পৃক্ত, সম্পৃক্ত, এবং অতিপৃক্ত দ্রবণ: পার্থক্য কী?
এই তিনটি টার্ম প্রায়ই একসাথে আসে, তাই এদের মধ্যেকার পার্থক্যটা ভালো করে বোঝা দরকার।
- অসম্পৃক্ত দ্রবণ (Unsaturated Solution): এটা হলো সেই দ্রবণ যেখানে আরও দ্রাব মেশানোর সুযোগ থাকে। মানে, বাসের সিটগুলো এখনও পুরো ভর্তি হয়নি, আরও কিছু লোক বসতে পারবে। আপনি যদি এক গ্লাস জলে অল্প চিনি মেশান, তাহলে সেটা হবে অসম্পৃক্ত দ্রবণ।
- সম্পৃক্ত দ্রবণ (Saturated Solution): এই দ্রবণে আর দ্রাব মেশানোর সুযোগ নেই। বাসের সব সিট ভর্তি, আর জায়গা নেই।
- অতিপৃক্ত দ্রবণ (Supersaturated Solution): এটা একটু স্পেশাল কেস। কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে, যেমন খুব ধীরে ধীরে দ্রবণকে ঠান্ডা করলে, সম্পৃক্ত দ্রবণের চেয়েও বেশি দ্রাব দ্রবীভূত করা সম্ভব। কিন্তু এই দ্রবণ খুব একটা স্থিতিশীল নয়। সামান্য ঝাঁকুনি লাগলেই অতিরিক্ত দ্রাব স্ফটিকের আকারে বেরিয়ে আসে। অনেকটা যেন জোর করে বাসের মধ্যে ঠেসে লোক ঢোকানো হয়েছে, একটু সুযোগ পেলেই তারা বাইরে বেরিয়ে আসবে।
নিচের টেবিলটি দেখলে আপনি সহজেই এই তিনটি দ্রবণের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারবেন:
বৈশিষ্ট্য | অসম্পৃক্ত দ্রবণ | সম্পৃক্ত দ্রবণ | অতিপৃক্ত দ্রবণ |
---|---|---|---|
দ্রাব মেশানোর সুযোগ | আরও দ্রাব মেশানো যায় | আর দ্রাব মেশানো যায় না | স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দ্রাব থাকে |
স্থিতিশীলতা | স্থিতিশীল | স্থিতিশীল | অস্থায়ী, সহজে স্ফটিক তৈরি হয় |
উদাহরণ | অল্প চিনি মেশানো শরবত | ঘন চিনি মেশানো শরবত | ধীরে ধীরে ঠান্ডা করা চিনির দ্রবণ |
দৈনন্দিন জীবনে সম্পৃক্ত দ্রবণের ব্যবহার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সম্পৃক্ত দ্রবণের অনেক ব্যবহার আছে। তার কয়েকটা এখানে উল্লেখ করা হলো:
খাবার তৈরি
- চিনি বা লবণের দ্রবণ তৈরি করা: মিষ্টি খাবার বা নোনতা খাবার তৈরি করার সময় আমরা প্রায়ই চিনি বা লবণের সম্পৃক্ত দ্রবণ ব্যবহার করি। যেমন, জিলাপি তৈরির জন্য চিনির সিরা একটি সম্পৃক্ত দ্রবণ।
- আচার তৈরি: আচার তৈরি করার সময় লবণ বা চিনির সম্পৃক্ত দ্রবণ ব্যবহার করা হয়, যা খাদ্য সংরক্ষণে সাহায্য করে।
ঔষধ তৈরি
- বিভিন্ন সিরাপ তৈরি: অনেক সিরাপ তৈরিতে সম্পৃক্ত দ্রবণ ব্যবহার করা হয়, যেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে ওষুধ দ্রবীভূত করা প্রয়োজন।
- স্যালাইন তৈরি: স্যালাইন তৈরিতে লবণ এবং জলের সঠিক অনুপাত বজায় রাখতে সম্পৃক্ত দ্রবণ ধারণাটি কাজে লাগে।
শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার
- স্ফটিক তৈরি: বিভিন্ন শিল্পে, যেমন গয়না বা ইলেক্ট্রনিক্স শিল্পে, বিশেষ ধরণের স্ফটিক তৈরি করার জন্য সম্পৃক্ত দ্রবণ ব্যবহার করা হয়।
- রাসায়নিক বিশ্লেষণ: বিভিন্ন রাসায়নিক পরীক্ষায়, কোনো পদার্থের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য সম্পৃক্ত দ্রবণ ব্যবহার করা হয়।
FAQ: সম্পৃক্ত দ্রবণ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন
সম্পৃক্ত দ্রবণ নিয়ে অনেকের মনেই কিছু প্রশ্ন থাকে। এখানে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. তাপমাত্রা বাড়ালে কি সম্পৃক্ত দ্রবণে আরও দ্রাব মেশানো যাবে?
অবশ্যই! তাপমাত্রা বাড়ালে দ্রাবকের দ্রবণ ক্ষমতা বাড়ে। তাই তাপমাত্রা বাড়ালে সম্পৃক্ত দ্রবণে আরও দ্রাব মেশানো সম্ভব। গরমকালে শরবতে বেশি চিনি মেশানো যায়, এটা তারই একটা উদাহরণ।
২. অতিপৃক্ত দ্রবণ কীভাবে তৈরি করা হয়?
অতিপৃক্ত দ্রবণ তৈরি করার জন্য প্রথমে দ্রাবককে উত্তপ্ত করে তাতে দ্রাব মেশানো হয়, যতক্ষণ না সেটি সম্পৃক্ত হয়। এরপর দ্রবণটিকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় দ্রাবকের দ্রবণ ক্ষমতা কমে গেলেও দ্রাব স্ফটিকের আকারে জমা না হয়ে দ্রবণের মধ্যেই থেকে যায়।
৩. সম্পৃক্ত দ্রবণ এবং গাঢ় দ্রবণের মধ্যে পার্থক্য কী?
এই দুটো টার্ম অনেক সময় গুলিয়ে ফেলা হয়। সম্পৃক্ত দ্রবণ মানে হলো, একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় দ্রাবকে আর বেশি দ্রাব দ্রবীভূত করা যায় না। অন্যদিকে, গাঢ় দ্রবণ মানে হলো, দ্রবণে দ্রাবের পরিমাণ বেশি। একটি দ্রবণ একইসাথে গাঢ় এবং অসম্পৃক্ত হতে পারে, আবার হালকা এবং সম্পৃক্তও হতে পারে।
৪. দ্রাব্যতা (Solubility) কী?
দ্রাব্যতা হলো একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দ্রাবকে (সাধারণত 100 গ্রাম দ্রাবক) সর্বোচ্চ যত পরিমাণ দ্রাব দ্রবীভূত হতে পারে তার পরিমাণ। দ্রাব্যতা পদার্থের একটি বৈশিষ্ট্য, যা তাপমাত্রা এবং চাপের উপর নির্ভর করে।
৫. সম্পৃক্ত দ্রবণ কি সবসময় স্থিতিশীল?
সাধারণত, সম্পৃক্ত দ্রবণ স্থিতিশীল। কিন্তু অতিপৃক্ত দ্রবণ স্থিতিশীল নয়। সামান্য ঝাঁকুনি অথবা কোনো স্ফটিক বীজ যোগ করলে অতিরিক্ত দ্রাব দ্রুত স্ফটিক আকারে বেরিয়ে আসে।
কিভাবে বুঝবেন দ্রবণ সম্পৃক্ত হয়েছে কিনা? (How to identify a saturated solution?)
একটা দ্রবণ সম্পৃক্ত হয়েছে কিনা, তা বোঝার জন্য আপনি কয়েকটা সহজ পরীক্ষা করতে পারেন:
- অতিরিক্ত দ্রাব যোগ করুন: দ্রবণে আরও কিছুটা দ্রাব যোগ করুন। যদি দেখেন দ্রাব আর গলছে না, নিচে জমা হচ্ছে, তাহলে বুঝবেন দ্রবণটি সম্পৃক্ত।
- তাপমাত্রা কমান: দ্রবণটিকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা করুন। যদি দেখেন দ্রাব স্ফটিক আকারে বেরিয়ে আসছে, তাহলে বুঝবেন দ্রবণটি আগে সম্পৃক্ত ছিল।
- স্ফটিক বীজ যোগ করুন: দ্রবণে খুব সামান্য পরিমাণ দ্রাবের স্ফটিক যোগ করুন। যদি দেখেন স্ফটিকের চারপাশে আরও স্ফটিক জমা হচ্ছে, তাহলে বুঝবেন দ্রবণটি সম্পৃক্ত অথবা অতিপৃক্ত।
শেষ কথা
আশা করি, সম্পৃক্ত দ্রবণ নিয়ে আপনার মনে আর কোনো ধোঁয়াশা নেই। রসায়নের এই মজার বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে পারলে আপনার বিজ্ঞান পড়ার অভিজ্ঞতা আরও আনন্দময় হবে। আর যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় কমেন্ট সেকশনে জানান। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!