আচ্ছা, শিক্ষিত কাকে বলে? সার্টিফিকেটধারী হলেই কি তিনি শিক্ষিত? নাকি অন্য কিছু? এই প্রশ্নটা কিন্তু আমাদের চারপাশে হামেশাই ঘোরে। চলুন, আজ এই বিষয় নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা করা যাক!
শিক্ষিত বলতে আমরা কী বুঝি?
“শিক্ষিত” শব্দটা শুনলেই আমাদের মাথায় প্রথমেই আসে স্কুল, কলেজ, আর ডিগ্রীর কথা। পরীক্ষায় ভালো নম্বর, সোনার মেডেল—এগুলো যেন শিক্ষার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে, শিক্ষা কি শুধু এইটুকুই? আমার মনে হয়, না।
শিক্ষা আসলে একটা বিশাল সমুদ্রের মতো। এর গভীরতা অনেক, দিগন্ত বিস্তৃত। শিক্ষিত মানুষ তিনি, যিনি শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শী নন, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্ঞান, বুদ্ধি, এবং বিবেচনা দিয়ে কাজ করতে পারেন।
শিক্ষার আসল মানে কী?
আসুন, একটু গভীরে যাওয়া যাক। শিক্ষা মানে শুধু তথ্য মুখস্থ করা নয়, সেই তথ্যকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা অর্জন করা। একজন শিক্ষিত মানুষ নতুন কিছু শিখতে আগ্রহী হন, নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নেন, এবং সব সময় নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করেন।
- জ্ঞান: বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক ও প্রয়োজনীয় তথ্য জানা।
- বুদ্ধি: সেই জ্ঞানকে বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।
- বিবেচনা: ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত পার্থক্য করার ক্ষমতা।
এই তিনটি জিনিস যার মধ্যে আছে, তিনিই প্রকৃত শিক্ষিত।
শুধু কি ডিগ্রি থাকলেই শিক্ষিত হওয়া যায়?
এই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। চারপাশে তাকালে দেখা যায়, অনেক ডিগ্রিধারী মানুষও আছেন, যারা সমাজের জন্য তেমন কিছু করছেন না। আবার এমন অনেক মানুষ আছেন, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম, কিন্তু তারা নিজেদের কাজ দিয়ে সমাজে অনেক বড় অবদান রাখছেন।
আমার মনে হয়, একটা ডিগ্রি অবশ্যই সম্মানজনক, তবে সেটাই শেষ কথা নয়। আসল শিক্ষা হলো, একজন মানুষ কিভাবে তার অর্জিত জ্ঞানকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করছেন।
শিক্ষার প্রকারভেদ: কোন শিক্ষা আপনার জন্য?
শিক্ষা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। প্রত্যেক প্রকার শিক্ষার নিজস্ব গুরুত্ব আছে। আপনার প্রয়োজন আর আগ্রহের ওপর নির্ভর করে, আপনি যে কোনো একটি বেছে নিতে পারেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—এগুলো হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল ভিত্তি। এখানে একটা নির্দিষ্ট সিলেবাসের মাধ্যমে পড়াশোনা করানো হয় এবং পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়।
- সুবিধা: একটি কাঠামোবদ্ধ পরিবেশে জ্ঞান অর্জন করা যায়। বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ থাকে।
- অসুবিধা: অনেক সময় মুখস্থবিদ্যার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাব দেখা যায়।
বৃত্তিমূলক শিক্ষা
বৃত্তিমূলক শিক্ষা মানে হলো কোনো বিশেষ কাজ বা পেশার জন্য হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেওয়া। যেমন: কারিগরি শিক্ষা, নার্সিং, ফ্যাশন ডিজাইন ইত্যাদি।
- সুবিধা: দ্রুত চাকরি পাওয়ার সুযোগ থাকে। বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ে।
- অসুবিধা: ক্ষেত্র বিশেষে সুযোগ কম থাকতে পারে।
আত্মশিক্ষা
নিজের আগ্রহে বই পড়া, অনলাইন কোর্স করা, বা কোনো অভিজ্ঞ মানুষের কাছ থেকে শেখা—এগুলো হলো আত্মশিক্ষার অংশ।
- সুবিধা: নিজের পছন্দমতো বিষয়ে শেখা যায়। কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না।
- অসুবিধা: অনেক সময় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব হতে পারে।
একজন শিক্ষিত মানুষের বৈশিষ্ট্য কী কী?
একজন শিক্ষিত মানুষ কেমন হন? তার মধ্যে কী কী গুণ থাকা উচিত? চলুন, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা যাক:
সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical Thinking)
একজন শিক্ষিত মানুষ কোনো তথ্যকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করেন না। তিনি সেই তথ্যকে যাচাই করেন, বিশ্লেষণ করেন, এবং নিজের বুদ্ধি দিয়ে বিচার করেন।
সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা (Problem Solving)
জীবনের পথে নানা সমস্যা আসবেই। একজন শিক্ষিত মানুষ সেই সমস্যাগুলো ঠান্ডা মাথায় সমাধান করতে পারেন। তিনি জানেন, কিভাবে সঠিক প্রশ্ন করতে হয় এবং কিভাবে সঠিক উত্তর খুঁজে বের করতে হয়।
যোগাযোগ দক্ষতা (Communication Skill ):
নিজের চিন্তা, ভাবনা, এবং মতামত অন্যদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকাটা খুব জরুরি। একজন শিক্ষিত মানুষ ভালোভাবে কথা বলতে পারেন, লিখতে পারেন, এবং অন্যদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারেন।
সহমর্মিতা (Empathy):
অন্যের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা হলো সহমর্মিতা। একজন শিক্ষিত মানুষ শুধু নিজের কথা ভাবেন না, তিনি অন্যদের প্রতিও সহানুভূতিশীল হন।
নৈতিকতা (Morality):
একজন শিক্ষিত মানুষ সৎ এবং নীতিবান হন। তিনি সমাজের নিয়মকানুন মেনে চলেন এবং ভালো কাজ করতে আগ্রহী হন।
শিক্ষিত মানুষের কিছু খারাপ দিক?
শিক্ষিত মানুষের খারাপ দিক থাকতে পারে, কিন্তু সেটা শিক্ষার ফল নয়। কিছু সম্ভাব্য দিক আলোচনা করা হলো:
- অহংকার: অনেক শিক্ষিত মানুষ তাদের জ্ঞান ও ডিগ্রীর কারণে অহংকারী হতে পারেন।
- বস্তুবাদিতা: কেউ কেউ শুধুমাত্র বস্তুগত উন্নতির পেছনে ছুটতে পারেন।
শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান: একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক
বর্তমানে, ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। কিন্তু শুধু ডিগ্রীর ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। চাকরির বাজারে টিকে থাকার জন্য কিছু বাড়তি দক্ষতাও অর্জন করতে হবে।
কোন দক্ষতাগুলো এখন বেশি জরুরি?
- যোগাযোগ দক্ষতা: স্পষ্টভাবে কথা বলা ও লেখার ক্ষমতা।
- সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা: যেকোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত সমস্যা সমাধানের দক্ষতা।
- ডিজিটাল দক্ষতা: কম্পিউটার, ইন্টারনেট, এবং অন্যান্য ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহারের জ্ঞান।
- দলবদ্ধভাবে কাজ করার ক্ষমতা: টিমের সাথে মিলেমিশে কাজ করার মানসিকতা।
এই দক্ষতাগুলো থাকলে, আপনি চাকরির বাজারে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশে শিক্ষার হার
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। তবে এখনও অনেক পথ বাকি। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষার মান উন্নত করার দিকে নজর দেওয়া উচিত।
বছর | শিক্ষার হার (%) |
---|---|
২০১০ | ৫২.৮ |
২০১৫ | ৬২.৬ |
২০২০ | ৭৫.৬ |
এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উন্নতি করছে।
শিক্ষা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
আমাদের সমাজে শিক্ষা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। সেগুলো দূর করা জরুরি।
- ভুল ধারণা ১: ভালো রেজাল্ট মানেই ভালো শিক্ষা।
- সঠিক ধারণা: ভালো রেজাল্ট শিক্ষার একটা অংশ মাত্র, সম্পূর্ণ শিক্ষা নয়।
- ভুল ধারণা ২: বিজ্ঞান বিভাগই সেরা, অন্য বিভাগগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
- সঠিক ধারণা: প্রতিটি বিভাগের নিজস্ব গুরুত্ব আছে। নিজের আগ্রহ অনুযায়ী বিভাগ নির্বাচন করা উচিত।
- ভুল ধারণা ৩: শুধু চাকরি পাওয়ার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
- সঠিক ধারণা: শিক্ষা মানুষের ভেতরের সম্ভাবনাকে জাগ্রত করে এবং জীবনকে সুন্দর করে তোলে।
শিক্ষা কিভাবে জীবন পরিবর্তন করে?
শিক্ষা মানুষের জীবনকে নানাভাবে পরিবর্তন করতে পারে।
- শিক্ষা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
- নতুন সুযোগ তৈরি করে।
- সমাজের উন্নয়নে সাহায্য করে।
- জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।
একজন শিক্ষিত মানুষ শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্যও সম্পদ।
শিক্ষা নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের কিছু উক্তি
শিক্ষা নিয়ে অনেক জ্ঞানী মানুষ অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের উক্তি নিচে দেওয়া হলো:
- “শিক্ষা মানুষের ভেতরের সুপ্ত সম্ভাবনাকে বিকশিত করে।” – স্বামী বিবেকানন্দ
- “শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড।” – কাজী নজরুল ইসলাম
- “শিক্ষা ব্যতীত মুক্তি নেই।” – ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
এই উক্তিগুলো থেকে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝা যায়।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এখানে শিক্ষা নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
- প্রশ্ন: শিক্ষিত হতে গেলে কি অনেক টাকা খরচ করতে হয়?
- উত্তর: না, এখন অনেক সরকারি স্কুল-কলেজে স্বল্প খরচে পড়াশোনা করা যায়। এছাড়া, অনলাইনে অনেক ফ্রি কোর্সও পাওয়া যায়।
- প্রশ্ন: বয়স হয়ে গেলে কি আর শিক্ষা গ্রহণ করা যায় না?
- উত্তর: বয়স কোনো বাধা নয়। শেখার কোনো শেষ নেই। আপনি যেকোনো বয়সে নতুন কিছু শিখতে পারেন।
- প্রশ্ন: কোন বিষয়ে পড়লে ভালো চাকরি পাওয়া যায়?
- উত্তর: এটা বলা কঠিন। চাকরির বাজার সব সময় পরিবর্তন হয়। তবে, যে বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে, সেই বিষয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করলে ভালো সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
উপসংহার: আসুন, সবাই শিক্ষিত হই
শিক্ষা আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলে, সমাজকে উন্নত করে। তাই, আসুন আমরা সবাই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হই। শুধু নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য, দশের জন্য কাজ করি। মনে রাখবেন, “জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষই প্রকৃত মানুষ।”