আসুন, শিশুদের অধিকার নিয়ে কিছু কথা বলি!
আচ্ছা, কখনো কী ভেবে দেখেছেন, একটা শিশুর জীবনে কী কী প্রয়োজন? শুধু খাবার, পোশাক আর খেলনা হলেই কি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে? একদমই না! শিশুদের সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার জন্য আরও অনেক কিছুর দরকার। আর সেই সবকিছুই হলো তাদের অধিকার।
শিশু অধিকার কাকে বলে? (Shishu Odhikar Kake Bole?)
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, শিশু অধিকার মানে হলো ১৮ বছরের কম বয়সী প্রতিটি ছেলে-মেয়ের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সুযোগ-সুবিধা এবং সুরক্ষা। এই অধিকারগুলো তাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আবেগিক বিকাশে সাহায্য করে। একটা শিশুর জন্ম নেওয়ার পর থেকে সাবালক হওয়া পর্যন্ত সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যা কিছু দরকার, সেটাই শিশু অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
শিশু অধিকার কেন প্রয়োজন? (Shishu Odhikar Keno Proyojon?)
ভাবুন তো, একটা ছোট্ট চারাগাছকে যদি ঠিকমতো আলো, বাতাস, আর জল না দেওয়া হয়, তাহলে কী হবে? গাছটা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে মারা যাবে, তাই না? শিশুদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। তাদের যদি সঠিক সুযোগ এবং সুরক্ষা না দেওয়া হয়, তাহলে তারা ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না।
শিশু অধিকারের প্রয়োজনীয়তা কয়েকটি অংশে আলোচনা করা হলো:
-
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ: প্রতিটি শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা এবং তাদের মানসিক বিকাশের জন্য শিশু অধিকার জরুরি।
-
শিক্ষা: শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। প্রতিটি শিশুর বিদ্যালয়ে যাওয়া এবং শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
-
সুরক্ষা: শিশুদের শোষণ, নির্যাতন এবং খারাপ ব্যবহার থেকে রক্ষা করা দরকার।
-
অংশগ্রহণ: শিশুদের তাদের মতামত প্রকাশ করার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেওয়ার অধিকার আছে।
-
বৈষম্য হ্রাস: জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা অন্য কোনো কারণে শিশুদের মধ্যে বৈষম্য করা উচিত নয়।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (United Nations Convention on the Rights of the Child)
জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ (United Nations Convention on the Rights of the Child – CRC) গ্রহণ করে। এই সনদে শিশুদের অধিকারগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে এই সনদে স্বাক্ষর করেছে, যার মানে হলো আমাদের দেশ শিশুদের অধিকার রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
শিশু অধিকার সনদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা:
ধারা নম্বর | বিষয়বস্তু |
---|---|
২ | কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়াই সকল শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। |
৩ | শিশুদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাদের কল্যাণের কথা প্রথমে বিবেচনা করতে হবে। |
৬ | প্রতিটি শিশুর জীবন ধারণের এবং বেড়ে ওঠার অধিকার আছে। |
১২ | শিশুদের নিজেদের মতামত প্রকাশের অধিকার আছে এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। |
১৯ | শিশুদের সব ধরনের সহিংসতা, নির্যাতন ও অবহেলা থেকে রক্ষা করতে হবে। |
২৮ | শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। |
৩১ | শিশুদের বিশ্রাম, বিনোদন, খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার আছে। |
বাংলাদেশে শিশু অধিকার (Shishu Odhikar in Bangladesh)
বাংলাদেশ সরকার শিশু অধিকার রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের সংবিধানেও শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও, সরকার বিভিন্ন আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে, যাতে শিশুরা একটি সুন্দর এবং নিরাপদ জীবন পায়।
আইন ও নীতিমালা (Laws and Policies)
-
শিশু আইন, ২০১৩ (Children Act, 2013): এই আইনে শিশুদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
-
জাতীয় শিশু নীতি, ২০১১ (National Child Policy, 2011): এই নীতিতে শিশুদের সার্বিক উন্নয়ন এবং অধিকার রক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
-
বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ (Child Marriage Restraint Act, 2017): এই আইনের মাধ্যমে বাল্য বিবাহ বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাস্তব চিত্র (Real Scenario)
এত আইন ও নীতি থাকার পরেও, বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার এখনও পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়। অনেক শিশুই দারিদ্র্য, অপুষ্টি, শিক্ষা, এবং নির্যাতনের শিকার। তাদের ভালোভাবে বাঁচা এবং বেড়ে ওঠার পথে অনেক বাধা রয়েছে।
কিছু চ্যালেঞ্জ (Some Challenges):
-
দারিদ্র্য: দারিদ্র্যের কারণে অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে না।
-
শিক্ষা: অনেক শিশুই বিদ্যালয়ে যেতে পারে না, বিশেষ করে যারা দরিদ্র পরিবারের এবং শ্রমিক শ্রেণির সন্তান।
-
শ্রম: অনেক শিশুকে তাদের পরিবারের জন্য কাজ করতে হয়, যা তাদের শিক্ষা এবং বিকাশে বাধা দেয়।
- নির্যাতন: অনেক শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়, যা তাদের জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলে।
শিশু অধিকারের প্রকারভেদ (Types of Child Rights)
শিশুদের অধিকারগুলোকে সাধারণত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো:
বেঁচে থাকার অধিকার (Right to Survival)
প্রতিটি শিশুর জন্ম নেওয়ার এবং সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এর মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত খাবার, নিরাপদ আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, এবং পরিষ্কার জলের অধিকার।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:
- জন্ম নিবন্ধন করা (Birth Registration)
- টিকা দেওয়া (Vaccination)
- পুষ্টিকর খাবার (Nutritious Food)
- চিকিৎসা সেবা (Medical Care)
সুরক্ষার অধিকার (Right to Protection)
শিশুদের সব ধরনের শোষণ, নির্যাতন, অবহেলা এবং খারাপ ব্যবহার থেকে রক্ষা করার অধিকার আছে। এর মধ্যে রয়েছে বাল্য বিবাহ, শিশুশ্রম, এবং মানব পাচারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:
- বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ (Prevent Child Marriage)
- শিশুশ্রম বন্ধ করা (Stop Child Labor)
- নির্যাতন থেকে রক্ষা (Protection from Abuse)
- মানব পাচার রোধ (Prevent Human Trafficking)
বিকাশের অধিকার (Right to Development)
শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, এবং আবেগিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, খেলাধুলা, সংস্কৃতি, এবং বিনোদনের অধিকার।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:
- শিক্ষা গ্রহণ (Get Education)
- খেলাধুলা ও বিনোদন (Sports and Recreation)
- সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ (Participate in Cultural Activities)
- তথ্য জানার সুযোগ (Access to Information)
অংশগ্রহণের অধিকার (Right to Participation)
শিশুদের তাদের মতামত প্রকাশ করার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেওয়ার অধিকার আছে। তাদের কথা শোনা এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ:
- নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ (Opportunity to Express Yourself)
- সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ (Participate in Decision Making)
- সংগঠনে যুক্ত হওয়া (Join Organizations)
- অভিযোগ জানানোর সুযোগ (Opportunity to Complain)
আপনার করণীয় (What You Can Do)
শিশু অধিকার রক্ষায় আপনিও অনেক কিছু করতে পারেন। এখানে কিছু উপায় দেওয়া হলো:
-
সচেতনতা তৈরি করুন: শিশু অধিকার সম্পর্কে নিজে জানুন এবং অন্যদেরকেও জানান।
-
শিশুদের কথা শুনুন: শিশুদের মতামতকে গুরুত্ব দিন এবং তাদের সমস্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
-
সাহায্যের হাত বাড়ান: আপনার চারপাশে যদি কোনো শিশু অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়, তাহলে তাদের সাহায্য করুন।
-
সংগঠনে যোগ দিন: শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনে যোগ দিয়ে তাদের কাজে সাহায্য করতে পারেন।
-
সরকারকে জানান: কোনো শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দেখলে সরকারকে জানান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উৎসাহিত করুন।
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (Frequently Asked Questions – FAQs)
১১ বছরের শিশুদের অধিকার কি?
১১ বছরের শিশুরা অন্যান্য শিশুদের মতোই সব ধরনের অধিকার ভোগ করে। তাদের শিক্ষা, সুরক্ষা, বিকাশ এবং অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। তাদের যেন কোনো প্রকার শোষণ, নির্যাতন বা অবহেলার শিকার হতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
শিশুদের মৌলিক অধিকার কি কি? (Shishuder Moulik Odhikar Ki Ki?)
শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলো হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং নিরাপত্তা। এই অধিকারগুলো তাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।
শিশু অধিকার দিবস কবে? (Shishu Odhikar Dibos Kabe?)
আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার দিবস প্রতি বছর ২০ নভেম্বর পালিত হয়। এই দিনটিতে শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো হয় এবং তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার করা হয়।
শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব কি? (Shishuder Proti Amader Dayitto Ki?)
শিশুদের প্রতি আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। তাদের ভালোবাসা, স্নেহ, এবং যত্ন দিয়ে বড় করা, তাদের শিক্ষা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা, এবং তাদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্য কাজ করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
“জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ” কী?
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ হলো শিশুদের অধিকার রক্ষায় একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ এই সনদ গ্রহণ করে, যেখানে শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে এই সনদে স্বাক্ষর করেছে।
শিশু অধিকার কোথায় পাওয়া যায়?
শিশু অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য আপনি UNICEF-এর ওয়েবসাইট, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইট এবং শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের ওয়েবসাইটে যেতে পারেন। এছাড়া, সরকারি তথ্য centres-এও আপনি এই বিষয়ে তথ্য পেতে পারেন।
উপসংহার (Conclusion)
শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের সুন্দর এবং নিরাপদ জীবন দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। তাই, আসুন, আমরা সবাই মিলে শিশু অধিকার রক্ষায় কাজ করি এবং একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ি, যেখানে প্রতিটি শিশু হাসি-খুশি আর নিরাপদে বেড়ে উঠবে। তাহলে আজকে থেকেই না হয় আমরা সকলে শিশুদের অধিকার রক্ষায় নিজেদের মতামত প্রকাশ করি এবং অন্যকে উৎসাহিত করি।