শব্দ কাকে বলে? বাংলা ব্যাকরণের একেবারে গোড়ার কথা! চলুন, সহজ ভাষায় জেনে নিই!
আচ্ছা, আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আমরা একে অপরের সাথে কথা বলি কী দিয়ে? অথবা, পাখির কিচিরমিচির, নদীর কলতান, কিংবা ঝড়ের গর্জন—এগুলো আসলে কী? উত্তরটা হলো: শব্দ। শব্দ ছাড়া আমাদের জীবন প্রায় অচল। মনের ভাব প্রকাশ করা থেকে শুরু করে যোগাযোগ স্থাপন, সবকিছুর মূলে রয়েছে এই শব্দ।
তাহলে, শব্দ আসলে কী? আসুন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা সেটাই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
শব্দ: একেবারে সহজ সরল সংজ্ঞা
ব্যাকরণের ভাষায়, এক বা একাধিক ধ্বনি মিলে যখন কোনো অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে শব্দ বলে। অর্থাৎ, কতগুলো বর্ণ একত্রিত হয়ে যদি একটি নির্দিষ্ট অর্থ বোঝায়, তবেই সেটি শব্দ হিসেবে গণ্য হবে।
উদাহরণস্বরূপ:
- মা: এখানে ‘ম’ এবং ‘আ’ এই দুটি ধ্বনি মিলে একটি শব্দ তৈরি করেছে, যা একজন নারীকে নির্দেশ করে।
- বই: ‘ব’, ‘ই’ এই দুটি ধ্বনি মিলে একটি শব্দ তৈরি করেছে, যা পড়ার জন্য ব্যবহৃত একটি বস্তুকে বোঝায়।
- আকাশ: ‘আ’, ‘ক’, ‘আ’, ‘শ’ এই চারটি ধ্বনি মিলে একটি শব্দ তৈরি করেছে, যা আমাদের মাথার উপরের অসীম স্থানকে বোঝায়।
যদি কোনো ধ্বনি সমষ্টি কোনো অর্থ প্রকাশ না করে, তবে সেটি শব্দ হিসেবে বিবেচিত হবে না। যেমন: ‘কিম্বা’, ‘যদি’, ‘হয়তো’ – এগুলোও শব্দ।
শব্দের প্রকারভেদ: কত রকমের শব্দ হয়?
বাংলা ভাষায় শব্দকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা যায়। এদের মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:
১. গঠন অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ
গঠন অনুসারে শব্দ দুই প্রকার:
- মৌলিক শব্দ: যে শব্দগুলোকে ভাঙা যায় না, বা বিশ্লেষণ করা যায় না, সেগুলোকে মৌলিক শব্দ বলে। এগুলো নিজে থেকেই তৈরি হয়।
- উদাহরণ: মা, বাবা, বই, কলম, জল, আকাশ, মেঘ ইত্যাদি।
- সাধিত শব্দ: যে শব্দগুলোকে বিশ্লেষণ করা যায়, অর্থাৎ ভেঙে আলাদা করা যায় এবং যেগুলোর একটি মূল শব্দ বা ধাতুর সঙ্গে উপসর্গ বা প্রত্যয় যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়, সেগুলোকে সাধিত শব্দ বলে।
- উদাহরণ: চলন্ত (চল + অন্ত), জানালা (জান + আলা), গরমিল (বে + গরমিল) ইত্যাদি।
২. উৎস বা উৎপত্তি অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ
উৎস বা উৎপত্তি অনুসারে বাংলা ভাষার শব্দগুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। এই ভাগগুলো হলো:
- তৎসম শব্দ: যে শব্দগুলো সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়াই বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়, সেগুলোকে তৎসম শব্দ বলে। তৎসম শব্দের অর্থ হলো “তার সমান,” অর্থাৎ সংস্কৃতের সমান।
- উদাহরণ: চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম, পাত্র, মনুষ্য ইত্যাদি।
তৎসম শব্দ চেনার সহজ উপায়
তৎসম শব্দ চেনার কিছু সহজ উপায় রয়েছে। সাধারণত, যেসব শব্দের বানানে যুক্তবর্ণ, ণ, ষ, অথবা ঢ় থাকে, সেগুলো প্রায়শই তৎসম শব্দ হয়। এছাড়াও, তৎসম শব্দগুলো গুরুগম্ভীর এবং formal হয়ে থাকে।
- অর্ধ-তৎসম শব্দ: যে শব্দগুলো সংস্কৃত ভাষা থেকে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়, সেগুলোকে অর্ধ-তৎসম শব্দ বলে। এগুলো তৎসম শব্দের চেয়ে কিছুটা সহজ সরল রূপে ব্যবহৃত হয়।
- উদাহরণ: জ্যোৎস্না > জ্যোছনা, শ্রাদ্ধ > ছেরাদ্দ, গৃহিণী > গিন্নী ইত্যাদি।
- তদ্ভব শব্দ: যে শব্দগুলো সংস্কৃত ভাষা থেকে প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলোকে তদ্ভব শব্দ বলে। “তদ্ভব” শব্দের অর্থ হলো “তা থেকে উৎপন্ন”।
- উদাহরণ: হস্ত > হत्থ > হাত, কর্ম > কम्म > কাম, মৎস্য > মচ্ছ > মাছ ইত্যাদি।
তদ্ভব শব্দ চেনার সহজ উপায়
তদ্ভব শব্দ চেনার সহজ উপায় হলো, এই শব্দগুলো সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে বেশি ব্যবহৃত হয় এবং এদের উচ্চারণ অনেকটা সহজ হয়। এছাড়াও, এগুলোর মধ্যে দেশজ শব্দের প্রভাব দেখা যায়।
- দেশী শব্দ: যে শব্দগুলো আদিবাসী বা স্থানীয় সংস্কৃতি থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলোকে দেশী শব্দ বলে। এই শব্দগুলোর মূল উৎস সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।
- উদাহরণ: কুঁড়ি, পেট, ডিঙ্গা, ঢেঁকি, কুলা, গাগরি ইত্যাদি।
দেশী শব্দ চেনার সহজ উপায়
দেশী শব্দগুলো সাধারণত আমাদের গ্রামীণ জীবন এবং স্থানীয় সংস্কৃতি থেকে উঠে আসে। এই শব্দগুলো দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত এবং এদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষার টান থাকে।
- বিদেশী শব্দ: বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষেরা এই দেশে আসার কারণে তাদের ভাষা থেকে কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় যুক্ত হয়েছে। এই শব্দগুলোকে বিদেশী শব্দ বলা হয়।
- উদাহরণ: ইংরেজি – টেবিল, চেয়ার, ফ্যান, কম্পিউটার; আরবি – আল্লাহ, ইসলাম, ঈমান, কুরআন, ঈদ; ফার্সি – খোদা, গুনাহ, রোজা, নামাজ, তারিখ।
বিদেশী শব্দ মনে রাখার কৌশল
বিদেশী শব্দ মনে রাখার জন্য শব্দগুলোকে তাদের উৎস অনুসারে ভাগ করে তালিকা তৈরি করে পড়তে পারেন। যেমন, ইংরেজি শব্দগুলোকে একপাশে, আরবি শব্দগুলোকে অন্যপাশে, এবং ফার্সি শব্দগুলোকে আরেক পাশে লিখে পড়ুন। এতে শব্দগুলো সহজে মনে থাকবে।
৩. অর্থ অনুসারে শব্দের প্রকারভেদ
অর্থের দিক থেকেও শব্দ বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। এদের কয়েকটি হলো:
- একার্থক শব্দ: যে শব্দগুলো একটি মাত্র অর্থ প্রকাশ করে। যেমনঃ মানুষ, গরু, বাঘ ইত্যাদি।
- বহুার্থক শব্দ: যে শব্দগুলো একাধিক অর্থ প্রকাশ করে। যেমনঃ ‘ঘর’ শব্দটি দিয়ে আবাস, পরিবার, স্থান ইত্যাদি বোঝানো যায়।
- সমার্থক শব্দ: একই অর্থবোধক ভিন্ন ভিন্ন শব্দ। যেমনঃ জল, পানি, নীর, সলিল – সবগুলোই পানির সমার্থক শব্দ।
- বিপরীতার্থক শব্দ: বিপরীত অর্থবোধক শব্দ। যেমনঃ দিন – রাত, আলো – অন্ধকার ইত্যাদি।
শব্দ এবং পদ: এদের মধ্যে পার্থক্য কী?
শব্দ এবং পদের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে, যা অনেক সময় আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। আসুন, এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেওয়া যাক।
সাধারণভাবে, শব্দ হলো কতগুলো ধ্বনি বা বর্ণের সমষ্টি, যা একটি অর্থ প্রকাশ করে। এই শব্দগুলো যখন কোনো বাক্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তা পদ হিসেবে পরিচিত হয়। অর্থাৎ, শব্দ যখন বিভক্তি যুক্ত হয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হওয়ার যোগ্যতা লাভ করে, তখন তাকে পদ বলে।
বিষয়টি আরও সহজভাবে বোঝার জন্য, নিচের উদাহরণটি দেখা যাক:
- শব্দ: বই
- পদ: বইটি (এখানে ‘টি’ একটি বিভক্তি)
এখানে, ‘বই’ একটি শব্দ। কিন্তু যখন আমরা বলি ‘বইটি আমার খুব প্রিয়’, তখন ‘বইটি’ একটি পদে রূপান্তরিত হয়, কারণ এখানে ‘বই’ শব্দের সাথে ‘টি’ বিভক্তি যুক্ত হয়েছে। বিভক্তি যুক্ত হওয়ার পরেই এই শব্দটি বাক্যে ব্যবহার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাহলে, মূল পার্থক্য হল – শব্দ একটি স্বাধীন রূপ, কিন্তু পদ বাক্যের অংশ।
শব্দ নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- বাংলা ভাষায় প্রায় দুই লক্ষেরও বেশি শব্দ রয়েছে!
- “ভালবাসা” শব্দটি সম্ভবত বাংলা ভাষার সবচেয়ে সুন্দর শব্দগুলোর মধ্যে একটি।
- বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষায় শব্দের ব্যবহারে ভিন্নতা দেখা যায়।
শব্দ নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
শব্দ নিয়ে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে। এখানে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. শব্দ কাকে বলে উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা করুন।
উত্তর: এক বা একাধিক ধ্বনি মিলে যখন কোনো অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে শব্দ বলে। যেমন: “জল” একটি শব্দ, যা পান করার কাজে লাগে। এখানে ‘জ’ এবং ‘ল’ এই দুটি ধ্বনি মিলিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট অর্থ প্রকাশ করেছে।
২. উৎস অনুসারে শব্দ কত প্রকার ও কি কি?
উত্তর: উৎস অনুসারে শব্দ পাঁচ প্রকার: তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশী ও বিদেশী।
৩. শব্দ কত প্রকার ও কি কি উদাহরণ দাও?
উত্তর: গঠনের দিক থেকে শব্দ দুই প্রকার: মৌলিক শব্দ (যেমন: মা, বাবা) এবং সাধিত শব্দ (যেমন: চলন্ত, জানালা)। উৎসের দিক থেকে পাঁচ প্রকার: তৎসম (যেমন: চন্দ্র, সূর্য), অর্ধ-তৎসম (যেমন: জ্যোছনা, গিন্নী), তদ্ভব (যেমন: হাত, কাম), দেশী (যেমন: কুঁড়ি, পেট) এবং বিদেশী (যেমন: টেবিল, আল্লাহ)।
৪. “মা” শব্দটি কোন প্রকার শব্দ?
উত্তর: “মা” শব্দটি মৌলিক শব্দ। কারণ এটিকে আর ভাঙা যায় না।
৫. পদ কত প্রকার ও কি কি?
উত্তর: পদ প্রধানত পাঁচ প্রকার: বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয় ও ক্রিয়া।
শেষ কথা: শব্দের ভান্ডার
শব্দ হলো ভাষার প্রাণ। শব্দ ছাড়া ভাষা মৃত। বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার বিশাল ও সমৃদ্ধ। এই শব্দগুলোকে সঠিকভাবে জানতে ও ব্যবহার করতে পারলে আমাদের ভাষার জ্ঞান আরও বাড়বে।
আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে আপনি “শব্দ কাকে বলে” এবং এর প্রকারভেদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। শব্দ নিয়ে আরও কিছু জানতে চান? নিচে কমেন্ট করে জানান! আর এই পোস্টটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।