শুরুতেই একটা গল্প বলি। ছোটবেলায়, দাদুর কাছে রূপকথার গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতাম। দাদু বলতেন, “আগেকার দিনে, কাগজ তো ছিল না, তাই গাছের পাতা, চামড়া—এসবের ওপর লিখে রাখা হতো জরুরি কথা।” ঠিক তেমনই, ইসলামের প্রাথমিক যুগে, কাগজ সহজলভ্য হওয়ার আগে, বিশেষ কিছু ‘পত্রিকা’র ওপর আল্লাহ্র বাণী লেখা হতো। সেই পত্রিকাগুলোকেই বলা হত সহিফা। তাহলে, সহিফা ব্যাপারটা কী, কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ, আর এর ভেতরের কথাগুলোই বা কী, চলুন, আজ সেটাই জেনে নেওয়া যাক!
সহিফা: আল্লাহ্র বাণীর প্রাথমিক রূপ
সহিফা (صُحُف) একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো ‘পত্র’, ‘পাতা’, অথবা ‘লিখিত পৃষ্ঠা’। ইসলামের পরিভাষায়, সহিফা বলতে বোঝায় আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে বিভিন্ন নবী-রাসূলের ওপর অবতীর্ণ হওয়া ছোট আকারের লিখিত বাণী বা ঐশী বার্তা। এগুলো মূলত কুরআন মাজিদের পূর্বে নাজিল হয়েছিল।সহিফাগুলো আকারে ছোট ছিল এবং নির্দিষ্ট কিছু নবীর উপর নাজিল হয়েছিল।
সহিফার ইতিহাস: এক ঝলকে
সহিফার ধারণাটি ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে জড়িত। কুরআন নাজিলের আগে, আল্লাহ্ বিভিন্ন নবীর কাছে ছোট আকারের বার্তা পাঠিয়েছিলেন, যেন তাঁরা তাঁদের সময়কার মানুষদের সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন। এই বার্তাগুলোই সহিফা নামে পরিচিত।
কুরআন ও সহিফার মধ্যেকার সম্পর্ক
সহিফা এবং কুরআনের মধ্যে একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। সহিফাগুলো ছিল কুরআনের পূর্বসূরি। কুরআন হচ্ছে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব, যা আগের সহিফাগুলোর সারসংক্ষেপ এবং পরিপূর্ণ রূপ।সহিফাগুলোতে মূলত মৌলিক কিছু বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, যা কুরআন মাজিদে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু সহিফা
যদিও অনেক নবীর ওপর সহিফা নাজিল হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, তবে বিশেষভাবে কয়েকজন নবীর সহিফার কথা উল্লেখযোগ্য।
হযরত আদম (আঃ)-এর উপর সহিফা
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, হযরত আদম (আঃ) ছিলেন প্রথম মানুষ এবং নবী। তাঁর উপর দশটি সহিফা নাজিল হয়েছিল বলে জানা যায়।এই সহিফাগুলোতে সম্ভবত জীবনধারণের মৌলিক বিধি-নিষেধ এবং আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হয়েছিল।
হযরত শীষ (আঃ)-এর উপর সহিফা
হযরত শীষ (আঃ) ছিলেন হযরত আদম (আঃ)-এর পুত্র। তাঁর উপর পঞ্চাশটি সহিফা নাজিল হয়েছিল বলে কথিত আছে।এই সহিফাগুলোতে সম্ভবত নৈতিক শিক্ষা এবং স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা বলা হয়েছিল।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর উপর সহিফা
হযরত ইব্রাহিম (আঃ), যিনি মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি—এই তিনটি ধর্মের কাছেই শ্রদ্ধেয়, তাঁর উপর দশটি সহিফা নাজিল হয়েছিল। কুরআনের সূরা আল-আ’লার ১৮-১৯ নম্বর আয়াতে এই সহিফার কথা উল্লেখ আছে – “নিশ্চয়ই এটা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও আছে—ইব্রাহীম ও মূসার কিতাবসমূহে।” এখানে ইব্রাহিম (আঃ)-এর সহিফার কথা বলা হয়েছে।
হযরত মুসা (আঃ)-এর উপর সহিফা
হযরত মুসা (আঃ), যিনি বনি ইসরাইলের নবী ছিলেন, তাঁর উপরও কিছু সহিফা নাজিল হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে, তাঁর উপর প্রধানত তাওরাত নাজিল হয়েছিল, যা একটি বড় গ্রন্থ।সহিফাগুলোতে সম্ভবত তাওরাতের মৌলিক বিষয়গুলো সংক্ষেপে বলা হয়েছিল।
সহিফার বিষয়বস্তু
সহিফাগুলোতে কী ধরনের বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। যেহেতু সহিফাগুলো এখন আর মূল রূপে পাওয়া যায় না, তাই এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া কঠিন। তবে, ইসলামী পণ্ডিতগণ মনে করেন যে, সহিফাগুলোতে সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আলোচিত হতো:
- তাওহিদ: আল্লাহ্র একত্ববাদ বা এক আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের কথা।
- নবুয়ত: নবী-রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস এবং তাঁদের অনুসরণ করার গুরুত্ব।
- আখিরাত: মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, হিসাব-নিকাশ, জান্নাত ও জাহান্নামের ধারণা।
- নৈতিকতা: মানুষের চরিত্র গঠন, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, দয়া ও ক্ষমা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলির চর্চা।
- ইবাদত: আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য ও ইবাদতের নিয়ম-কানুন এবং গুরুত্ব।
- সামাজিক বিধান: সমাজ ও পরিবারের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান।
সহিফার ভাষা ও লিখন পদ্ধতি
সহিফাগুলো কোন ভাষায় লেখা হয়েছিল, তা নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। তবে, ধারণা করা হয় যে, এগুলো তৎকালীন সময়ে প্রচলিত কোনো প্রাচীন ভাষায় লেখা হয়েছিল। যেহেতু কাগজ সহজলভ্য ছিল না, তাই এগুলো সম্ভবত চামড়া, গাছের পাতা, অথবা পাথরের ওপর লেখা হতো।
বর্তমান যুগে সহিফার প্রাসঙ্গিকতা
সহিফা এখন আর মূল রূপে পাওয়া না গেলেও, এর শিক্ষাগুলো আজও আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।সহিফার মূল বিষয়বস্তু—যেমন আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস, নৈতিকতা, ন্যায়পরায়ণতা—কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাই, সহিফার শিক্ষাগুলো অনুসরণ করে আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দর ওmeaningful করতে পারি।
সহিফা থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবন গড়া
আমরা সহিফা থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি? প্রথমত, আল্লাহ্র প্রতি অবিচল বিশ্বাস রাখতে পারি। দ্বিতীয়ত, নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অর্জন করতে পারি। তৃতীয়ত, সমাজের কল্যাণে কাজ করতে পারি।চতুর্থত, সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে পারি।
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
এখন, সহিফা নিয়ে আপনাদের মনে আসা কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
সহিফা ও কিতাবের মধ্যে পার্থক্য কী?
সহিফা (স্ক্রোল) এবং কিতাবের (বই) মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো আকারে ও ধরনে(form)। সহিফাগুলো ছিল ছোট আকারের এবং সাধারণত কোনো বিশেষ নবীর প্রতি প্রেরিত সংক্ষিপ্ত বার্তা বা উপদেশমালা। অন্যদিকে, কিতাব হলো একটি বৃহত্তর আকারের গ্রন্থ, যা বিস্তারিত আইন, বিধি-বিধান, এবং কাহিনী ধারণ করে।”সহিফাগুলো ছিল ছোট আকারের, কিতাবগুলো বড়”- এভাবেই সহজে মনে রাখতে পারেন।
কুরআনে কতগুলো সহিফার উল্লেখ আছে?
কুরআনে স্পষ্টভাবে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত মুসা (আঃ)-এর সহিফার কথা উল্লেখ আছে। সূরা আল-আ’লার ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
সব নবীর উপর কি সহিফা নাজিল হয়েছিল?
ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, সকল নবীর উপর সহিফা নাজিল হয়নি। শুধুমাত্র কিছু নবী-রাসূলের উপর আল্লাহ্ তা’আলা সহিফা নাজিল করেছিলেন।
সহিফাগুলো কি এখনো পাওয়া যায়?
সহিফাগুলো মূল রূপে এখন আর পাওয়া যায় না। এগুলো অনেক আগেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। তবে, কুরআনে কিছু সহিফার শিক্ষার কথা উল্লেখ আছে।
সহিফার শিক্ষা আমাদের জীবনে কীভাবে কাজে লাগাতে পারি?
সহিফার শিক্ষাগুলো মূলত আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস, নৈতিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবতাবোধের ওপর জোর দেয়। এই শিক্ষাগুলো আমরা আমাদের জীবনে কাজে লাগিয়ে একজন ভালো মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করতে পারি।
“নবী” ও “রাসূল”-এর মধ্যে সহিফার ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য আছে কি?
নবী (Prophet) এবং রাসূল (Messenger)-এর মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। সকল রাসূলই নবী, কিন্তু সকল নবী রাসূল নন। রাসূলগণ নতুন শরীয়ত (Divine Law) এবং কিতাব (Book) নিয়ে আসেন, যা তাদের পূর্ববর্তী নবীদের শরীয়তকে রহিত করে অথবা সম্পূর্ণ করে। অন্যদিকে, নবীগণ প্রায়শই পূর্ববর্তী রাসূলগণের শরীয়ত অনুসরণ করেন এবং তাদের শিক্ষা প্রচার করেন।সহিফা সাধারণত নবী এবং রাসূল উভয়ের উপরেই নাজিল হতে পারে, আল্লাহ্র ইচ্ছানুসারে।
আরও কিছু প্রশ্ন (Additional Questions)
এখানে আরো কিছু প্রশ্ন এবং সেগুলোর উত্তর দেওয়া হলো:
সহিফা নাজিলের উদ্দেশ্য কী ছিল?
সহিফা নাজিলের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানবজাতিকে আল্লাহ্র পথে ডাকা, সৎ কাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা। এটি ছিল মূলত একটি পথনির্দেশিকা, যা মানুষকে সত্যের পথে পরিচালিত করত।
ইসলামে সহিফার গুরুত্ব কতটুকু?
ইসলামে সহিফার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি কুরআন মাজিদের পূর্ববর্তী ঐশী বার্তাগুলোর একটি অংশ।সহিফার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, আল্লাহ্ যুগে যুগে নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মানবজাতিকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন।
অন্যান্য ধর্মেও কি সহিফার ধারণা আছে?
ইসলামের মতো অন্যান্য ধর্মেও নবী-রাসূলগণের উপর ঐশী বার্তা নাজিল হওয়ার ধারণা রয়েছে। তবে, সেগুলোর स्वरूप এবং নামকরণে ভিন্নতা দেখা যায়।
সহিফা নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ আছে কি?
সহিফা যেহেতু এখন আর মূল রূপে পাওয়া যায় না, তাই এটি নিয়ে গবেষণার সুযোগ সীমিত। তবে, কুরআনের আয়াত ও হাদিসের আলোকে সহিফার শিক্ষা ও বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।
উপসংহার
সহিফা হয়তো আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু এর শিক্ষাগুলো আজও অমলিন। আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস, সৎকর্ম, ন্যায়বিচার—এই বিষয়গুলো সহিফার মূল বার্তা ছিল, যা আজও আমাদের জীবনে অনুসরণ করা উচিত। আসুন, আমরা সবাই মিলে সহিফার শিক্ষা অনুযায়ী জীবন গড়ি এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে অবদান রাখি। এই ছিল সহিফা নিয়ে কিছু কথা। কেমন লাগল, জানাতে ভুলবেন না! আপনার যদি আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।