আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? রসায়ন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভালো লাগে তো? আজকে আমরা রসায়নের খুব দরকারি একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করব – সমযোজী ব্যাসার্ধ। এই জিনিসটা আসলে কী, কেন দরকার, আর এটা বের করার নিয়মই বা কী – সব কিছু জলের মতো সোজা করে বুঝিয়ে দেব। তাই, রসায়নের জটিলতায় না গিয়ে সহজভাবে সবকিছু বুঝতে, আজকের ব্লগটি মন দিয়ে পড়ুন।
সমযোজী ব্যাসার্ধ: পরমাণুদের মধ্যে বন্ধুত্বের মাপকাঠি!
আচ্ছা, প্রথমে একটা গল্প বলি। ধরুন, আপনার দুই বন্ধু খুবclose। তারা সবসময় হাত ধরাধরি করে থাকে। এখন, যদি জানতে চান তাদের মধ্যে ঠিক কতটুকু দূরত্ব আছে, তাহলে কী করবেন? সহজ উপায় হলো, তাদের হাতের দূরত্বের অর্ধেকটা মেপে নেয়া। সমযোজী ব্যাসার্ধ অনেকটা তেমনই!
তাহলে, সমযোজী ব্যাসার্ধ (Covalent Radius) কী?
সহজ ভাষায়, দুটি পরমাণু যখন সমযোজী বন্ধন (Covalent Bond) দিয়ে যুক্ত হয়ে একটি অণু (Molecule) তৈরি করে, তখন তাদের নিউক্লিয়াসের মধ্যে যে দূরত্ব থাকে, তার অর্ধেককেই বলা হয় সমযোজী ব্যাসার্ধ।
ধরা যাক, দুটি একই পরমাণু (যেমন Cl-Cl) পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে একটি Cl2 অণু তৈরি করেছে। এখন, এই Cl2 অণুর Cl-Cl বন্ধনের দৈর্ঘ্য যদি 1.98Å হয়, তাহলে ক্লোরিন (Cl) পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ হবে 1.98Å / 2 = 0.99Å। কেমন, বুঝতে পারছেন তো?
সমযোজী বন্ধনটা কী, আরেকটু ঝালিয়ে নেয়া যাক!
আমরা জানি, পরমাণুগুলো স্থিতিশীল (Stable) হতে চায়। স্থিতিশীল হওয়ার জন্য তাদের শেষ কক্ষপথে (Outermost shell) আটটি ইলেকট্রন দরকার হয় (হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রে দুইটি)। এই ইলেকট্রন পাওয়ার জন্য পরমাণুগুলো একে অপরের সাথে ইলেকট্রন শেয়ার করে, মানে ভাগাভাগি করে নেয়। এই ভাগাভাগির মাধ্যমে যে বন্ধন তৈরি হয়, সেটাই হলো সমযোজী বন্ধন।
যেমন, দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু (H) একটি করে ইলেকট্রন শেয়ার করে H2 অণু তৈরি করে। এখানে, দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুই একটি সমযোজী বন্ধন দিয়ে যুক্ত থাকে।
কেন এই সমযোজী ব্যাসার্ধ দরকারি?
সমযোজী ব্যাসার্ধ আমাদের অনেক কাজে লাগে। নিচে কয়েকটি প্রধান ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
- আণবিক গঠন বোঝা: একটি অণুর আকার এবং গঠন কেমন হবে, সেটা জানতে সমযোজী ব্যাসার্ধ খুব গুরুত্বপূর্ণ।
- রাসায়নিক বিক্রিয়া: কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া (Chemical Reaction) কীভাবে ঘটবে, তা বুঝতেও এটা কাজে দেয়।
- পদার্থের বৈশিষ্ট্য: পদার্থের গলনাঙ্ক (Melting Point), স্ফুটনাঙ্ক (Boiling Point) ইত্যাদি ভৌত বৈশিষ্ট্য (Physical Properties) সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
- নতুন যৌগ তৈরি: নতুন যৌগ (Compound) তৈরির সময় কোন পরমাণুগুলো কীভাবে যুক্ত হতে পারে, তার একটা ধারণা পাওয়া যায়।
কীভাবে বের করবেন এই সমযোজী ব্যাসার্ধ?
সমযোজী ব্যাসার্ধ বের করার নিয়মটা বেশ সোজা। নিচে কয়েকটি উপায় আলোচনা করা হলো:
একই পরমাণুর ক্ষেত্রে:
যদি দুটি একই পরমাণু সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, তাহলে তাদের বন্ধন দূরত্বের অর্ধেক নিলেই সমযোজী ব্যাসার্ধ পাওয়া যায়।
যেমন:
- Cl2 অণুতে Cl-Cl বন্ধনের দৈর্ঘ্য 1.98Å হলে, Cl পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ = 1.98Å / 2 = 0.99Å
- H2 অণুতে H-H বন্ধনের দৈর্ঘ্য 0.74Å হলে, H পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ = 0.74Å / 2 = 0.37Å
ভিন্ন পরমাণুর ক্ষেত্রে:
যদি দুটি ভিন্ন পরমাণু সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, তাহলে একটু হিসাব করে বের করতে হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত নিম্নলিখিত সূত্র ব্যবহার করা হয়:
R(A) + R(B) = d(A-B)
এখানে,
- R(A) হলো A পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ।
- R(B) হলো B পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ।
- d(A-B) হলো A এবং B পরমাণুর মধ্যে বন্ধন দূরত্ব।
যদি একটি পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ জানা থাকে, তাহলে অন্যটিরটা বের করা যায়।
উদাহরণ: কার্বন-ক্লোরিন (C-Cl) বন্ধনের দৈর্ঘ্য 1.76 Å। যদি ক্লোরিনের (Cl) সমযোজী ব্যাসার্ধ 0.99 Å হয়, তাহলে কার্বনের (C) সমযোজী ব্যাসার্ধ হবে:
R(C) = d(C-Cl) – R(Cl) = 1.76 Å – 0.99 Å = 0.77 Å
এভাবে, বিভিন্ন যৌগের বন্ধন দূরত্ব জানা থাকলে সহজেই পরমাণুগুলোর সমযোজী ব্যাসার্ধ বের করা সম্ভব।
পলিং এর সূত্র
বিজ্ঞানী পলিং বিভিন্ন পরমাণুর তড়িৎ ঋণাত্মকতার (Electronegativity) ওপর ভিত্তি করে একটি সূত্র দিয়েছেন। এই সূত্র অনুযায়ী ভিন্ন পরমাণুর ক্ষেত্রে সমযোজী ব্যাসার্ধ নির্ণয় করা যায়। সূত্রটি হলো:
d(A-B) = r(A) + r(B) – 0.09 |X(A) – X(B)|
এখানে,
- d(A-B) হলো A এবং B পরমাণুর মধ্যে বন্ধন দৈর্ঘ্য।
- r(A) হলো A পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ।
- r(B) হলো B পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ।
- X(A) হলো A পরমাণুর তড়িৎ ঋণাত্মকতা।
- X(B) হলো B পরমাণুর তড়িৎ ঋণাত্মকতা।
এই সূত্র ব্যবহার করে, তড়িৎ ঋণাত্মকতার পার্থক্য এবং বন্ধন দৈর্ঘ্যের ডেটা থেকে সমযোজী ব্যাসার্ধ নির্ণয় করা যায়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
- সমযোজী ব্যাসার্ধ সাধারণত পিকোমিটার (pm) বা অ্যাংস্ট্রম (Å) এককে মাপা হয়। (1 Å = 10^-10 মিটার)
- পর্যায় সারণীতে (Periodic Table) বাম থেকে ডানে গেলে সাধারণত সমযোজী ব্যাসার্ধ কমে যায়, কারণ নিউক্লিয়াসের চার্জ বৃদ্ধি পায় এবং ইলেকট্রনগুলো ভেতরের দিকে আকৃষ্ট হয়।
- উপর থেকে নিচে নামলে সমযোজী ব্যাসার্ধ বাড়ে, কারণ নতুন ইলেকট্রন স্তর যুক্ত হয়।
সমযোজী ব্যাসার্ধ সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
রসায়ন পড়তে গিয়ে সমযোজী ব্যাসার্ধ নিয়ে কিছু প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক। তাই, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর নিচে দেওয়া হলো:
প্রশ্ন ১: আয়নিক ব্যাসার্ধ (Ionic Radius) এবং সমযোজী ব্যাসার্ধের মধ্যে পার্থক্য কী?
আয়নিক ব্যাসার্ধ হলো কোনো আয়নের (Ion) আকার। আয়ন তৈরি হয় যখন একটি পরমাণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে (ঋণাত্মক আয়ন বা অ্যানায়ন) বা ত্যাগ করে (ধনাত্মক আয়ন বা ক্যাটায়ন)। অন্যদিকে, সমযোজী ব্যাসার্ধ হলো দুটি পরমাণু যখন সমযোজী বন্ধন দিয়ে যুক্ত হয়ে অণু তৈরি করে, তখন তাদের নিউক্লিয়াসের মধ্যবর্তী দূরত্বের অর্ধেক।
সহজভাবে বললে, আয়নিক ব্যাসার্ধ শুধু আয়নের আকার নির্দেশ করে, যেখানে সমযোজী ব্যাসার্ধ দুটি পরমাণুর মধ্যে বন্ধনের দূরত্ব বোঝায়৷
প্রশ্ন ২: ভ্যান ডের ওয়ালস ব্যাসার্ধ (Van der Waals Radius) কী এবং এটি সমযোজী ব্যাসার্ধ থেকে কীভাবে আলাদা?
ভ্যান ডের ওয়ালস ব্যাসার্ধ হলো একটি পরমাণুর সেই দূরত্ব, যার মধ্যে অন্য কোনো পরমাণু প্রবেশ করতে পারে না। এটি মূলত দুর্বল আকর্ষণ বলের (Weak attraction force) কারণে তৈরি হয়।
অন্যদিকে, সমযোজী ব্যাসার্ধ হলো রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যমে গঠিত অণুতে পরমাণুগুলোর বন্ধন দূরত্ব। ভ্যান ডের ওয়ালস ব্যাসার্ধ সাধারণত সমযোজী ব্যাসার্ধের চেয়ে বড় হয়, কারণ এটি বন্ধন গঠন করে না, বরং আন্তঃআণবিক দূরত্ব (Intermolecular distance) নির্দেশ করে।
প্রশ্ন ৩: সমযোজী ব্যাসার্ধ কি পর্যায় সারণীতে (Periodic Table) কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে?
হ্যাঁ, পর্যায় সারণীতে সমযোজী ব্যাসার্ধ একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে।
- বাম থেকে ডানে গেলে সাধারণত সমযোজী ব্যাসার্ধ কমে যায়। এর কারণ হলো নিউক্লিয়াসের চার্জ বৃদ্ধি পায়, যা ইলেকট্রনগুলোকে ভেতরের দিকে টানে। ফলে পরমাণুর আকার ছোট হয়ে যায়।
- উপর থেকে নিচে নামলে সমযোজী ব্যাসার্ধ বাড়ে। এর কারণ হলো নতুন ইলেকট্রন স্তর যুক্ত হয়, যা পরমাণুর আকারকে প্রসারিত করে।
এই নিয়মটি আমাদের বিভিন্ন মৌলের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের মধ্যে বন্ধন গঠনের প্রবণতা বুঝতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন ৪: সমযোজী ব্যাসার্ধের মান কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে?
সমযোজী ব্যাসার্ধের মান মূলত নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে:
- প্রোটনের সংখ্যা: প্রোটন সংখ্যা বাড়লে নিউক্লিয়াসের চার্জ বাড়ে এবং ইলেকট্রনগুলো আরো শক্তিশালীভাবে আকৃষ্ট হয়, ফলে ব্যাসার্ধ ছোট হয়ে যায়।
- ইলেকট্রন সংখ্যা: ইলেকট্রন সংখ্যা বাড়লে ইলেকট্রনগুলোর মধ্যে বিকর্ষণ বাড়ে, যা ব্যাসার্ধকে বাড়িয়ে দেয়।
- ইলেকট্রন বিন্যাস: ইলেকট্রনগুলো কিভাবে বিন্যস্ত আছে, তার ওপরও ব্যাসার্ধ নির্ভর করে। যেমন, শিল্ডিং এফেক্ট (shielding effect) বা আচ্ছাদন প্রভাবের কারণে ভেতরের ইলেকট্রনগুলো বাইরের ইলেকট্রনগুলোর ওপর নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ কমিয়ে দেয়, ফলে ব্যাসার্ধ বাড়ে।
প্রশ্ন ৫: সমযোজী ব্যাসার্ধ ব্যবহার করে কীভাবে বন্ধন দৈর্ঘ্য (Bond Length) নির্ণয় করা যায়?
দুটি পরমাণুর মধ্যে বন্ধন দৈর্ঘ্য নির্ণয় করার জন্য তাদের সমযোজী ব্যাসার্ধ ব্যবহার করা যেতে পারে। সাধারণভাবে, দুটি পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ যোগ করলে তাদের মধ্যে বন্ধন দৈর্ঘ্য পাওয়া যায়।
বন্ধন দৈর্ঘ্য = r(A) + r(B)
এখানে, r(A) হলো A পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ এবং r(B) হলো B পরমাণুর সমযোজী ব্যাসার্ধ।
এই পদ্ধতিটি সাধারণত সঠিক ফলাফল দেয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে তড়িৎ ঋণাত্মকতার পার্থক্য বা অন্যান্য কারণে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যেতে পারে।
প্রশ্ন ৬: সমযোজী ব্যাসার্ধের সীমাবদ্ধতাগুলো কী কী?
সমযোজী ব্যাসার্ধ একটি उपयोगी ধারণা হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:
- পরিবেশের প্রভাব: সমযোজী ব্যাসার্ধের মান ভিন্ন ভিন্ন যৌগের ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে, কারণ পরমাণুর চারপাশের পরিবেশের (যেমন, অন্যান্য পরমাণু বা লিগ্যান্ড) প্রভাব থাকে।
- পোলারাইজেশন: উচ্চ পোলারাইজেশন (Polarization) আছে এমন অণুতে বন্ধন দৈর্ঘ্য সঠিকভাবে অনুমান করা কঠিন হতে পারে।
- জটিল অণু: জটিল অণুগুলোর ক্ষেত্রে, যেখানে একাধিক বন্ধন এবং ত্রিমাত্রিক গঠন বিদ্যমান, সেখানে সমযোজী ব্যাসার্ধ ব্যবহার করে বন্ধন দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা কঠিন হতে পারে।
প্রশ্ন ৭: সমযোজী ব্যাসার্ধ কি তাপমাত্রা এবং চাপের উপর নির্ভরশীল?
সাধারণভাবে, সমযোজী ব্যাসার্ধ তাপমাত্রা এবং চাপের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল নয়। কারণ, সমযোজী ব্যাসার্ধ মূলত পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস এবং নিউক্লিয়াসের চার্জ দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা তাপমাত্রা এবং চাপের স্বাভাবিক পরিবর্তনে খুব একটা প্রভাবিত হয় না।
তবে, চরম তাপমাত্রা বা চাপে (যেমন, খুব উচ্চ চাপ) পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাসে পরিবর্তন আসতে পারে, যা সমযোজী ব্যাসার্ধকে সামান্য প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু সাধারণ পরীক্ষাগার বা প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে এই প্রভাব খুবই নগণ্য।
প্রশ্ন ৮: বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বন্ধনের (Chemical Bond) জন্য কি আলাদা ব্যাসার্ধ ব্যবহার করা হয়?
হ্যাঁ, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বন্ধনের জন্য আলাদা ব্যাসার্ধ ব্যবহার করা হয়। যেমন:
- সমযোজী বন্ধন: এর জন্য সমযোজী ব্যাসার্ধ ব্যবহার করা হয়।
- আয়নিক বন্ধন: এর জন্য আয়নিক ব্যাসার্ধ ব্যবহার করা হয়।
- ধাতব বন্ধন: এর জন্য ধাতব ব্যাসার্ধ ব্যবহার করা হয়।
- ভ্যান ডার ওয়ালস বন্ধন: এর জন্য ভ্যান ডার ওয়ালস ব্যাসার্ধ ব্যবহার করা হয়।
প্রতিটি ব্যাসার্ধ সেই নির্দিষ্ট বন্ধনের প্রকৃতি এবং পরমাণুগুলোর মধ্যে দূরত্বের ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।
প্রশ্ন ৯: সমযোজী ব্যাসার্ধের ব্যবহারিক প্রয়োগগুলো কী কী? কোথায় এটি ব্যবহৃত হয়?
সমযোজী ব্যাসার্ধের ব্যবহারিক প্রয়োগ অনেক বিস্তৃত। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র উল্লেখ করা হলো:
- নতুন যৌগ ডিজাইন ও সংশ্লেষণ: নতুন যৌগ তৈরি করার সময়, সমযোজী ব্যাসার্ধ ব্যবহার করে পরমাণুগুলোর মধ্যে সঠিক দূরত্ব এবং বন্ধন কেমন হবে, তা অনুমান করা যায়।
- কঠিন পদার্থের গঠন বিশ্লেষণ: কঠিন পদার্থের (Solid Materials) গঠন এবং বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য সমযোজী ব্যাসার্ধ ব্যবহার করা হয়।
- ন্যানোটেকনোলজি: ন্যানোস্কেলে (nanoscale) নতুন উপাদান তৈরি এবং তাদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
- ঔষধ শিল্প: নতুন ঔষধ তৈরির সময় অণুর গঠন এবং কার্যকারিতা বুঝতে সমযোজী ব্যাসার্ধ কাজে লাগে।
- পলিমার বিজ্ঞান: পলিমারের (polymer) গঠন এবং বৈশিষ্ট্য জানতে এটি ব্যবহৃত হয়।
প্রশ্ন ১০: কীভাবে বুঝবো কোন পরমাণুর সমযোজী বৈশিষ্ট্য বেশি?
পরমাণুর সমযোজী বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে পারেন:
- তড়িৎ ঋণাত্মকতা: যে সকল পরমাণুর তড়িৎ ঋণাত্মকতার মান কাছাকাছি থাকে, তাদের মধ্যে সমযোজী বন্ধন গঠনের প্রবণতা বেশি।
- আয়নিক বিভব (Ionization Potential): কম আয়নিক বিভব সম্পন্ন পরমাণুগুলো সহজে ইলেকট্রন শেয়ার করতে পারে, যা সমযোজী বন্ধনের জন্য উপযোগী।
- আকারের প্রভাব: ছোট আকারের পরমাণুগুলোর নিউক্লিয়াস ইলেকট্রন মেঘকে শক্তিশালীভাবে আকর্ষণ করে, যা সমযোজী বন্ধন গঠনে সাহায্য করে।
সমযোজী ব্যাসার্ধ: বাস্তব জীবনের কিছু উদাহরণ
আমরা দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি সমযোজী ব্যাসার্ধ দেখি না, কিন্তু এর প্রভাব আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। নিচে কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া হলো:
১. জলের অণু (H2O): জলের অণুতে অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো সমযোজী বন্ধন দিয়ে যুক্ত থাকে। অক্সিজেনের সমযোজী ব্যাসার্ধ হাইড্রোজেনের চেয়ে বড় হওয়ায় জলের অণুর গঠন বাঁকানো (bent) হয়। এই গঠনের কারণে জলের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন এর উচ্চ পৃষ্ঠটান (surface tension) এবং দ্রবণ ক্ষমতা (solvent power)।
২. প্লাস্টিক (Plastic): প্লাস্টিক হলো পলিমার (Polymer), যা অসংখ্য ছোট অণু দিয়ে গঠিত। এই ছোট অণুগুলো সমযোজী বন্ধন দিয়ে যুক্ত হয়ে একটি বিশাল কাঠামো তৈরি করে। বিভিন্ন প্লাস্টিকের রাসায়নিক গঠন এবং বৈশিষ্ট্য তাদের উপাদানগুলোর সমযোজী ব্যাসার্ধের উপর নির্ভর করে।
৩. ডিএনএ (DNA): ডিএনএ হলো আমাদের বংশগতির ধারক। এর মধ্যে থাকা নাইট্রোজেন বেসগুলো (যেমন, অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন, থাইমিন) সমযোজী বন্ধন দিয়ে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করে। এই কাঠামোর কারণেই ডিএনএ তথ্য সংরক্ষণ এবং স্থানান্তর করতে পারে।
৪. ওষুধ (Medicine): বিভিন্ন ওষুধের অণুগুলো নির্দিষ্ট আকারের এবং আকারের উপর নির্ভর করে শরীরের রিসেপ্টরগুলোর (receptor) সাথে যুক্ত হয় এবং কাজ করে। এই আকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পরমাণুগুলোর সমযোজী ব্যাসার্ধ। সঠিক আকারের অভাবে ওষুধ কাজ নাও করতে পারে।
সারণী: কয়েকটি পরিচিত মৌলের সমযোজী ব্যাসার্ধ
মৌল (Element) | সমযোজী ব্যাসার্ধ (Covalent Radius) (pm) |
---|---|
হাইড্রোজেন (H) | 37 |
কার্বন (C) | 77 |
নাইট্রোজেন (N) | 75 |
অক্সিজেন (O) | 73 |
ফ্লুরিন (F) | 71 |
সিলিকন (Si) | 111 |
ফসফরাস (P) | 107 |
সালফার (S) | 105 |
ক্লোরিন (Cl) | 99 |
ব্রোমিন (Br) | 114 |
আয়োডিন (I) | 133 |
এই সারণীটি বিভিন্ন মৌলের আকারের একটা ধারণা দেয়, যা তাদের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে সাহায্য করে।
শেষ কথা
আশা করি, সমযোজী ব্যাসার্ধ কী, কেন দরকার, কীভাবে বের করতে হয় এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগগুলো সম্পর্কে আপনারা একটা স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। রসায়ন এমন একটা বিষয়, যা আমাদের চারপাশের সবকিছু বুঝতে সাহায্য করে। তাই, শিখতে থাকুন, জানতে থাকুন। আর হ্যাঁ, কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করতে ভুলবেন না!
যদি এই আর্টিকেলটি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং আমাদের ওয়েবসাইটে আরও আকর্ষণীয় বিষয় নিয়ে লেখা পোস্টগুলো পড়তে থাকুন। রসায়নের আরও অনেক মজার বিষয় নিয়ে খুব শীঘ্রই আমি আবার হাজির হবো, ততদিনের জন্য ভালো থাকুন!