আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন আপনারা? নিশ্চই ভালো!
আজ আমরা পদার্থবিজ্ঞানের (Physics) একটা মজার বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। কখনো কি ভেবেছেন, একটা রাবার ব্যান্ডকে টানলে সেটা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে কেন? আবার স্প্রিংয়ের কথাই ধরুন, সেটাকে compress করে ছেড়ে দিলে লাফিয়ে ওঠে! এর পেছনে কাজ করে স্থিতিস্থাপকতা (Elasticity)। আর এই স্থিতিস্থাপকতাকে সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করার জন্য দরকার হয় স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক (Elastic Modulus)। তাই আজকের আলোচনার বিষয় – স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক কাকে বলে (What is Elastic Modulus?)।
তাহলে চলুন, দেরি না করে শুরু করা যাক!
স্থিতিস্থাপকতা: ফিরে আসার গল্প
কোনো বস্তুর ওপর যখন বাহ্যিক বল প্রয়োগ করা হয়, তখন তার আকার বা আয়তনের পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু বল সরিয়ে নিলে যদি বস্তুটা আবার আগের আকার বা আয়তনে ফিরে আসে, তাহলে সেই ধর্মকে বলা হয় স্থিতিস্থাপকতা। আর যে সকল বস্তু এই ধর্ম প্রদর্শন করে, তাদেরকে স্থিতিস্থাপক বস্তু বলা হয়। যেমন – রাবার, স্প্রিং, ইস্পাত ইত্যাদি।
এবার একটু অন্যভাবে ভাবুন। ধরুন, আপনি একটি লোহার রডকে বাঁকাতে চেষ্টা করছেন। খুব সহজে কি বাঁকাতে পারবেন? নিশ্চয়ই না! কারণ, লোহার মধ্যে স্থিতিস্থাপকতা ধর্ম বিদ্যমান। এই স্থিতিস্থাপকতাই লোহাকে বাঁকতে বাধা দিচ্ছে।
স্থিতিস্থাপক সীমা (Elastic Limit)
একটা রাবার ব্যান্ডকে আপনি কতক্ষণ পর্যন্ত টানতে পারবেন? একটা সময় আসবে যখন রাবার ব্যান্ডটা ছিঁড়ে যাবে, তাই না? ঠিক তেমনি, প্রত্যেক বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা দেখানোর একটা সীমা আছে। এই সীমার মধ্যে বস্তু তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। কিন্তু সীমার বাইরে গেলে, বস্তুটি তার স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে ফেলে এবং স্থায়ীভাবে বিকৃত হয়ে যায়। এই সীমাকেই স্থিতিস্থাপক সীমা (Elastic Limit) বলা হয়।
স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক: স্থিতিস্থাপকতার পরিমাপ
স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক হলো কোনো বস্তুর স্থিতিস্থাপকতার মাত্রার পরিমাপক। এটি বস্তুর ওপর প্রযুক্ত পীড়ন (Stress) এবং বিকৃতির (Strain) অনুপাত। স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক যত বেশি, বস্তুটি তত বেশি স্থিতিস্থাপক। অর্থাৎ, বস্তুটি তার আকার বা আয়তন পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তত বেশি প্রতিরোধ তৈরি করবে।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক আমাদের জানায় যে, কোনো বস্তুকে সংকুচিত বা প্রসারিত করতে কতটা বল প্রয়োগ করতে হবে।
পীড়ন (Stress) ও বিকৃতি (Strain)
স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক বুঝতে হলে, পীড়ন (stress) ও বিকৃতি (strain) সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে।
-
পীড়ন (Stress): কোনো বস্তুর ওপর প্রযুক্ত বাহ্যিক বলের কারণে বস্তুর অভ্যন্তরে যে প্রতিরোধকারী বলের সৃষ্টি হয়, তাকে পীড়ন বলে। পীড়ন হলো একক ক্ষেত্রফলের ওপর প্রযুক্ত বলের সমান। এর একক হলো প্যাসকেল (Pascal) বা নিউটন প্রতি বর্গমিটার (N/m²)।
পীড়ন = প্রযুক্ত বল / ক্ষেত্রফল
-
বিকৃতি (Strain): বাহ্যিক বলের প্রভাবে বস্তুর আকার বা আয়তনের যে পরিবর্তন ঘটে, তাকে বিকৃতি বলে। বিকৃতি হলো বস্তুর আদি দৈর্ঘ্য বা আয়তনের সাপেক্ষে পরিবর্তনের অনুপাত। এর কোনো একক নেই, কারণ এটি একটি অনুপাত।
বিকৃতি = দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন / আদি দৈর্ঘ্য (দৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে)
বিকৃতি = আয়তনের পরিবর্তন / আদি আয়তন (আয়তনের ক্ষেত্রে)
স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের প্রকারভেদ (Types of Elastic Modulus)
স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক মূলত তিন প্রকার:
- ইয়াং-এর গুণাঙ্ক (Young’s Modulus)
- আয়তন গুণাঙ্ক (Bulk Modulus)
- দৃঢ়তা গুণাঙ্ক (Shear Modulus or Modulus of Rigidity)
ইয়াং-এর গুণাঙ্ক (Young’s Modulus)
ইয়াং-এর গুণাঙ্ক (Young’s Modulus) হলো কোনো কঠিন বস্তুর দৈর্ঘ্য বরাবর পীড়ন এবং বিকৃতির অনুপাত। এটি বস্তুর দৈর্ঘ্য প্রসারণ বা সংকোচন এর প্রতিরোধ ক্ষমতা নির্দেশ করে।
ইয়াং-এর গুণাঙ্ক = দৈর্ঘ্য পীড়ন / দৈর্ঘ্য বিকৃতি
ধরা যাক, একটি তারের দৈর্ঘ্য L এবং প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল A। তারটির ওপর F বল প্রয়োগ করায় যদি এর দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন ΔL হয়, তাহলে,
ইয়াং-এর গুণাঙ্ক (Y) = (F/A) / (ΔL/L) = (FL) / (AΔL)
এই গুণাঙ্কের মান যত বেশি, তারটি টানা বা প্রসারিত করা তত কঠিন। ইস্পাতের ইয়াং-এর গুণাঙ্ক বেশি হওয়ায় এটি রাবারের চেয়ে বেশি স্থিতিস্থাপক।
সারণী: কয়েকটি উপাদানের ইয়াং-এর গুণাঙ্ক
উপাদান | ইয়াং-এর গুণাঙ্ক (প্যাসকেল) |
---|---|
ইস্পাত | ২০০ x ১০^৯ |
তামা | ১১০ x ১০^৯ |
অ্যালুমিনিয়াম | ৭০ x ১০^৯ |
রাবার | ০.০১ – ০.১ x ১০^৯ |
এই সারণী থেকে দেখা যাচ্ছে, ইস্পাতের ইয়াং-এর গুণাঙ্ক সবচেয়ে বেশি। তাই ইস্পাত অন্য উপাদানগুলোর চেয়ে বেশি স্থিতিস্থাপক।
আয়তন গুণাঙ্ক (Bulk Modulus)
আয়তন গুণাঙ্ক (Bulk Modulus) হলো কোনো বস্তুর ওপর সব দিক থেকে সমানভাবে প্রযুক্ত পীড়ন এবং আয়তন বিকৃতির অনুপাত। এটি বস্তুর আয়তন পরিবর্তনের প্রতিরোধ ক্ষমতা নির্দেশ করে। তরল এবং গ্যাসীয় পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা পরিমাপের জন্য এটি ব্যবহার করা হয়।
আয়তন গুণাঙ্ক = আয়তন পীড়ন / আয়তন বিকৃতি
যদি কোনো বস্তুর আদি আয়তন V হয় এবং এর ওপর P চাপ প্রয়োগ করার ফলে আয়তনের পরিবর্তন ΔV হয়, তাহলে,
আয়তন গুণাঙ্ক (B) = -P / (ΔV/V)
এখানে ঋণাত্মক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়, কারণ চাপ বাড়লে আয়তন কমে যায়।
যে পদার্থের আয়তন গুণাঙ্ক যত বেশি, সেই পদার্থকে সংকুচিত করা তত কঠিন।
দৃঢ়তা গুণাঙ্ক (Shear Modulus or Modulus of Rigidity)
দৃঢ়তা গুণাঙ্ক (Shear Modulus) হলো কোনো বস্তুর ওপর স্পর্শকীয় পীড়ন (Tangential Stress) এবং কিন্তন বিকৃতির (Shear Strain) অনুপাত। এটি বস্তুর আকার পরিবর্তনের প্রতিরোধ ক্ষমতা নির্দেশ করে। কঠিন পদার্থের জন্য এটি প্রযোজ্য।
দৃঢ়তা গুণাঙ্ক = স্পর্শকীয় পীড়ন / কিন্তন বিকৃতি
ধরা যাক, একটি ঘনকের ওপর F বল প্রয়োগ করায় এর একটি তল θ কোণে সরে যায়। ঘনকের তলের ক্ষেত্রফল A হলে,
দৃঢ়তা গুণাঙ্ক (G) = (F/A) / θ
এই গুণাঙ্কের মান যত বেশি, বস্তুর আকার পরিবর্তন করা তত কঠিন।
ব্যবহারিক জীবনে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের প্রয়োগ (Applications of Elastic Modulus in Daily Life)
স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের ধারণা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক কাজে লাগে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- বিল্ডিং এবং সেতু নির্মাণ: বিল্ডিং এবং সেতু নির্মাণের সময় প্রকৌশলীরা বিভিন্ন উপাদানের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক বিবেচনা করে। এর মাধ্যমে তারা নিশ্চিত করেন যে কাঠামোটি যথেষ্ট শক্তিশালী এবং টেকসই হবে।
- স্প্রিং তৈরি: স্প্রিং তৈরির সময় এমন উপাদান ব্যবহার করা হয়, যার ইয়াং-এর গুণাঙ্ক বেশি। এর ফলে স্প্রিং তার স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে পারে এবং বারবার ব্যবহারের পরেও সহজে নষ্ট হয় না।
- যন্ত্রপাতি তৈরি: বিভিন্ন যন্ত্রপাতির অংশ তৈরি করার সময় স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক বিবেচনা করা হয়। এর ফলে যন্ত্রগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়।
- ভূমিকম্প নিরোধক কাঠামো তৈরি: ভূমিকম্পের সময় বিল্ডিংয়ের ক্ষতি কমাতে স্থিতিস্থাপক উপাদানের ব্যবহার করা হয়। এর ফলে বিল্ডিংগুলো ভূমিকম্পের ধাক্কা সহ্য করতে পারে।
- চিকিৎসা বিজ্ঞান: হাড় জোড়া লাগানোর জন্য যে প্লেট ব্যবহার করা হয়, তার স্থিতিস্থাপকতা হাড়ের কাছাকাছি হতে হয়।
স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তাদের উত্তর দেওয়া হলো:
-
প্রশ্ন ১: স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের একক কি?
উত্তর: স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের একক হলো প্যাসকেল (Pascal) বা নিউটন প্রতি বর্গমিটার (N/m²)। যেহেতু এটি পীড়ন ও বিকৃতির অনুপাত, তাই এর একক পীড়নের এককের সমান।
-
প্রশ্ন ২: স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক এবং স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তর: স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক হলো বস্তুর স্থিতিস্থাপকতার পরিমাপক, যা পীড়ন ও বিকৃতির অনুপাত। অন্যদিকে, স্থিতিস্থাপক সীমা হলো সেই সর্বোচ্চ পীড়ন, যা কোনো বস্তু সহ্য করতে পারে এবং বল সরিয়ে নিলে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে।
-
প্রশ্ন ৩: বিভিন্ন পদার্থের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক কি ভিন্ন হয়?
উত্তর: হ্যাঁ, বিভিন্ন পদার্থের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক ভিন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইস্পাতের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক রাবারের চেয়ে অনেক বেশি। তাই ইস্পাত রাবারের চেয়ে বেশি স্থিতিস্থাপক।
-
প্রশ্ন ৪: স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক কিভাবে তাপমাত্রা দ্বারা প্রভাবিত হয়?
উত্তর: সাধারণত, তাপমাত্রা বাড়লে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক কমে যায়। কারণ, তাপমাত্রা বাড়লে বস্তুর অণুগুলোর মধ্যে কম্পন বাড়ে, যা স্থিতিস্থাপকতা কমিয়ে দেয়।
-
প্রশ্ন ৫: স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক কি শুধুমাত্র কঠিন পদার্থের জন্য প্রযোজ্য?
উত্তর: না, স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক কঠিন, তরল এবং গ্যাসীয় – এই তিন ধরনের পদার্থের জন্যই প্রযোজ্য। তবে, তরল এবং গ্যাসীয় পদার্থের ক্ষেত্রে সাধারণত আয়তন গুণাঙ্ক (Bulk Modulus) ব্যবহার করা হয়।
স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক: কিছু অতিরিক্ত তথ্য
- অধিকাংশ কঠিন পদার্থের ক্ষেত্রে, স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের মান অনেক বেশি থাকে। এর কারণ হলো কঠিন পদার্থের অণুগুলো খুব দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে।
- তরল পদার্থের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক কঠিন পদার্থের চেয়ে কম হয়। কারণ, তরল পদার্থের অণুগুলো কঠিন পদার্থের মতো দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে না।
- গ্যাসীয় পদার্থের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক সবচেয়ে কম হয়। কারণ, গ্যাসীয় পদার্থের অণুগুলো খুব সহজেই চলাচল করতে পারে এবং এদের মধ্যে আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল খুবই কম থাকে।
উপসংহার (Conclusion)
তাহলে, স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক (Elastic Modulus) নিয়ে আমাদের আলোচনা আজ এখানেই শেষ হলো। আমরা জানলাম, স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি, এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহারিক প্রয়োগগুলো সম্পর্কে। পদার্থবিজ্ঞানের এই মজার বিষয়টি আশা করি আপনারা সবাই বুঝতে পেরেছেন। স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক আমাদের চারপাশের জগতকে বুঝতে এবং বিভিন্ন প্রযুক্তি তৈরি করতে সহায়ক।
যদি এই বিষয়ে আপনাদের আরো কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট সেকশনে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ, এই ব্লগ পোস্টটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
ধন্যবাদ!