আচ্ছা, ভাবুন তো, মনের আনন্দে গান গাইছেন আর সুরগুলো কেমন নিজের থেকেই বেরিয়ে আসছে! এই যে সুরগুলো, এদের জন্ম কিন্তু কিছু বিশেষ অক্ষরের মাধ্যমে। আজ আমরা সেই অক্ষরগুলো নিয়েই গল্প করব – স্বরধ্বনি। তাহলে চলুন, জেনে নিই স্বরধ্বনি কাকে বলে (স্বরধ্বনি কাকে বলে) এবং এর খুঁটিনাটি।
বাংলা ব্যাকরণের এক মজার জগতে আপনাকে স্বাগতম!
স্বরধ্বনি: ভাষার প্রাণ
স্বরধ্বনি হলো সেইসব ধ্বনি, যেগুলো অন্য কোনো ধ্বনির সাহায্য ছাড়াই নিজে থেকে উচ্চারিত হতে পারে। এদের উচ্চারণের সময় মুখগহ্বর বা বাগযন্ত্রের কোথাও কোনো বাধা থাকে না। অনেকটা যেন পাখির গান, কোনো বাধা ছাড়াই আকাশে ভেসে বেড়ায়।
স্বরবর্ণ ও স্বরধ্বনি কি একই?
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, স্বরবর্ণ আর স্বরধ্বনি কি একই জিনিস? একটু পার্থক্য আছে। স্বরবর্ণ হলো স্বরধ্বনিগুলোর লিখিত রূপ। যেমন: অ, আ, ই, ঈ – এগুলো স্বরবর্ণ। আর এই বর্ণগুলো যখন উচ্চারিত হয়, তখন সেগুলো স্বরধ্বনি।
বাংলা ভাষায় স্বরধ্বনি কতগুলো?
বাংলা ভাষায় মৌলিক স্বরধ্বনি ৭টি। এগুলো হলো:
- অ
- আ
- ই
- উ
- এ
- ও
- অ্যা (যেমন: ব্যাগ, ব্যাট ইত্যাদি শব্দে ব্যবহৃত হয়)
এছাড়াও, বাংলা বর্ণমালায় স্বরবর্ণ মোট ১১টি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, স্বরবর্ণের সবগুলো কিন্তু মৌলিক স্বরধ্বনি নয়।
১১টি স্বরবর্ণ কি কি?
বাংলা বর্ণমালায় স্বরবর্ণগুলো হলো:
- অ
- আ
- ই
- ঈ
- উ
- ঊ
- ঋ
- এ
- ঐ
- ও
- ঔ
যৌগিক স্বরধ্বনি: যখন দুটো স্বরধ্বনি একসাথে
কখনো কখনো দুটো স্বরধ্বনি মিলে একটি নতুন ধ্বনি তৈরি করে। এদেরকে যৌগিক স্বরধ্বনি বা দ্বিস্বরধ্বনি বলা হয়।
যৌগিক স্বরধ্বনি উদাহরণ
বাংলায় ঐ (ওই) এবং ঔ (ওউ) এই দুটি যৌগিক স্বরধ্বনি রয়েছে। ঐ গঠিত হয়েছে ‘অ + ই’ মিলে এবং ঔ গঠিত হয়েছে ‘অ + উ’ মিলে।
স্বরধ্বনি উচ্চারণের স্থান: মুখ ও গলার খেলা
স্বরধ্বনিগুলো মুখ ও গলার বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে উচ্চারিত হয়। জিভের অবস্থান, ঠোঁটের আকৃতি – এইসবের ওপর নির্ভর করে কোন স্বরধ্বনিটি কেমন শোনাবে।
বিভিন্ন স্বরধ্বনি উচ্চারণের স্থান
- অ, আ: জিহ্বার পেছনের অংশ থেকে উচ্চারিত হয়।
- ই, ঈ: জিহ্বার সামনের অংশ থেকে উচ্চারিত হয়।
- উ, ঊ: ঠোঁট গোল করে উচ্চারিত হয়।
- এ: জিহ্বার সামান্য পিছন থেকে উচ্চারিত হয়।
- ও: ঠোঁট গোল এবং জিহ্বার পিছন থেকে উচ্চারিত হয়।
হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরধ্বনি: উচ্চারণের সময়
উচ্চারণের সময়কালের ওপর ভিত্তি করে স্বরধ্বনিগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: হ্রস্ব স্বরধ্বনি এবং দীর্ঘ স্বরধ্বনি।
হ্রস্ব স্বরধ্বনি
যে স্বরধ্বনিগুলো উচ্চারণ করতে কম সময় লাগে, সেগুলোকে হ্রস্ব স্বরধ্বনি বলে। যেমন: অ, ই, উ, ঋ।
দীর্ঘ স্বরধ্বনি
যে স্বরধ্বনিগুলো উচ্চারণ করতে বেশি সময় লাগে, সেগুলোকে দীর্ঘ স্বরধ্বনি বলে। যেমন: আ, ঈ, ঊ, এ, ঐ, ও, ঔ।
বৈশিষ্ট্য | হ্রস্ব স্বরধ্বনি | দীর্ঘ স্বরধ্বনি |
---|---|---|
উচ্চারণের সময় | কম | বেশি |
উদাহরণ | অ, ই, উ, ঋ | আ, ঈ, ঊ, এ, ঐ, ও, ঔ |
বিভিন্ন ভাষায় স্বরধ্বনি: এক নজরে
বিভিন্ন ভাষায় স্বরধ্বনির সংখ্যা বিভিন্ন হতে পারে। যেমন, সংস্কৃতে স্বরধ্বনিগুলোর উচ্চারণ এবং ব্যবহার বাংলা থেকে কিছুটা আলাদা।
ইংরেজি ভাষায় স্বরধ্বনি
ইংরেজি ভাষায় স্বরধ্বনিগুলো হলো: a, e, i, o, u এবং কখনো কখনো y। তবে এদের উচ্চারণ স্থান এবং রীতি বাংলা থেকে ভিন্ন।
অন্যান্য ভাষার স্বরধ্বনি
বিভিন্ন ভাষায় স্বরধ্বনির ব্যবহার এবং সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। কোনো ভাষায় স্বরধ্বনির সংখ্যা কম, আবার কোনো ভাষায় বেশি।
স্বরধ্বনি পরিবর্তনের নিয়ম: ধ্বনিতত্ত্বের মজা
ভাষার বিবর্তনের সাথে সাথে স্বরধ্বনিগুলোতেও পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনগুলো ধ্বনিতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
স্বরসঙ্গতি: স্বরধ্বনির প্রভাব
স্বরসঙ্গতি হলো একটি স্বরধ্বনির প্রভাবে অন্য স্বরধ্বনির পরিবর্তন। যেমন, ‘গুলি’ শব্দে ‘ই’ ধ্বনির প্রভাবে ‘গুলো’ শব্দটির ‘ও’ ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে ‘উ’ হয়েছে (গুলি+গুলো = গুল+ই+গুলো = গুল+গুলো)।
অপিনিহিতি: ধ্বনির স্থান পরিবর্তন
অপিনিহিতি হলো শব্দের মধ্যে কোনো স্বরধ্বনির স্থান পরিবর্তন। যেমন, আজি > আইজ। এখানে ‘ই’ ধ্বনিটি তার স্থান পরিবর্তন করেছে।
সাধারন জিজ্ঞাসা (FAQ): স্বরধ্বনি নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
-
প্রশ্ন: স্বরধ্বনি চেনার সহজ উপায় কী?
- উত্তর: স্বরধ্বনি চেনার সহজ উপায় হলো, এটি অন্য কোনো বর্ণের সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে। আপনি যখন কোনো বর্ণ উচ্চারণ করতে গিয়ে দেখবেন যে সেটি অন্য কোনো বর্ণের সাহায্য ছাড়াই উচ্চারিত হচ্ছে, তখন বুঝবেন সেটি স্বরধ্বনি।
-
প্রশ্ন: স্বরধ্বনি এবং ব্যঞ্জনধ্বনির মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
- উত্তর: স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখগহ্বর বা বাগযন্ত্রের কোথাও কোনো বাধা থাকে না। কিন্তু ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখগহ্বরের কোথাও না কোথাও বাধা পায়। এটাই মূল পার্থক্য।
-
প্রশ্ন: বাংলা ভাষায় কয়টি যৌগিক স্বরধ্বনি আছে?
* **উত্তর:** বাংলা ভাষায় দুটি যৌগিক স্বরধ্বনি আছে – ঐ এবং ঔ।
-
প্রশ্ন: “অ্যা” কি স্বরধ্বনি?
- উত্তর: হ্যাঁ, “অ্যা” একটি মৌলিক স্বরধ্বনি। এটি সাধারণত ইংরেজি শব্দ যেমন: “ব্যাগ” (bag), “ক্যাট” (cat) ইত্যাদি উচ্চারণে ব্যবহৃত হয়।
-
প্রশ্ন: স্বরধ্বনি উচ্চারণে জিহ্বার ভূমিকা কী?
- উত্তর: স্বরধ্বনি উচ্চারণে জিহ্বার অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিহ্বার সামনের, পেছনের এবং মাঝের অংশ ব্যবহার করে বিভিন্ন স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয়।
বাংলা সাহিত্যে স্বরধ্বনি: রসের আলপনা
বাংলা সাহিত্যে স্বরধ্বনিগুলোর ব্যবহার কবিতার ছন্দ, গানের সুর এবং লেখকের ভাষার মাধুর্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কবিতায় স্বরধ্বনি
কবিতায় স্বরধ্বনির সঠিক ব্যবহার ছন্দের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। উদাহরণস্বরূপ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক কবিতায় স্বরধ্বনির চমৎকার ব্যবহার দেখা যায়।
গানে স্বরধ্বনি
গানের সুরে স্বরধ্বনিগুলো আবেগ এবং অনুভূতি প্রকাশ করে। লতা মঙ্গেশকরের গানে স্বরধ্বনিগুলোর ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ব্যবহারিক জীবনে স্বরধ্বনি: প্রতিদিনের উচ্চারণ
আমরা প্রতিদিন কথা বলার সময় অসংখ্য স্বরধ্বনি ব্যবহার করি। সঠিক উচ্চারণের মাধ্যমে আমরা আমাদের বক্তব্যকে আরও স্পষ্ট ও সুন্দর করতে পারি।
শিশুদের স্বরধ্বনি শিক্ষা
শিশুদের স্বরধ্বনি শিক্ষা দেওয়ার জন্য খেলার ছলে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। ছবি ব্যবহার করে, ছড়া শুনিয়ে বা গান গেয়ে তাদের শেখানো যায়।
প্রমিত উচ্চারণ: গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
প্রমিত উচ্চারণ শেখা এবং চর্চা করা আমাদের ভাষার সৌন্দর্য রক্ষা করে এবং যোগাযোগকে আরও কার্যকরী করে।
স্বরধ্বনি নিয়ে মজার খেলা: কুইজ ও পাজল
স্বরধ্বনি শেখাকে আরও আনন্দদায়ক করতে কিছু মজার খেলা খেলতে পারেন। যেমন, স্বরধ্বনি দিয়ে শব্দ তৈরি করা বা স্বরধ্বনি খুঁজে বের করার পাজল সমাধান করা।
কুইজ
১. বাংলা ভাষায় মৌলিক স্বরধ্বনি কয়টি?
(ক) ৫টি (খ) ৬টি (গ) ৭টি (ঘ) ৮টি
২. নিচের কোনটি যৌগিক স্বরধ্বনি?
(ক) অ (খ) আ (গ) ঐ (ঘ) ই
পাজল
নিচের অক্ষরগুলো থেকে স্বরধ্বনিগুলো খুঁজে বের করুন:
ক, খ, গ, অ, ঘ, ঙ, চ, আ, ই, জ, ঝ, ঞ, ট, ঈ
আশা করি, স্বরধ্বনি নিয়ে এই আলোচনাটি আপনার ভালো লেগেছে। স্বরধ্বনি আমাদের ভাষার প্রাণ, আর এই প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এর সঠিক ব্যবহার জানা এবং চর্চা করা খুবই জরুরি।