আসসালামু আলাইকুম, আপনি কি “তাগুত” শব্দটা শুনেছেন? হয়তো শুনেছেন, হয়তো শোনেননি। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই “তাগুত” নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব। বিষয়টাকে সহজভাবে বোঝার চেষ্টা করব, যাতে আপনার মনে কোনো ধোঁয়াশা না থাকে।
ইসলামে “তাগুত” একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা আমাদের বিশ্বাস ও জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। তাই, এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রাখা আমাদের সকলের জন্য জরুরি। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
তাগুত: একটি সহজ সরল ব্যাখ্যা
“তাগুত” শব্দটা আরবি। এর মূল অর্থ হলো সীমা লঙ্ঘন করা, অবাধ্য হওয়া অথবা পথভ্রষ্ট হওয়া। ইসলামে, তাগুত বলতে সেইসব ব্যক্তি, বস্তু বা শক্তিকে বোঝায়, যাদের আল্লাহ্র সমকক্ষ মনে করা হয় অথবা আল্লাহ্র বিধানের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের বিধান তৈরি করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়।
সাধারণভাবে, তাগুত হলো আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো বা কিছুর উপাসনা করা অথবা আল্লাহ্র আইনের পরিবর্তে অন্য কোনো আইন অনুসরণ করা। এটা হতে পারে কোনো মূর্তি, কোনো ব্যক্তি, কোনো ধারণা বা অন্য যেকোনো কিছুই।
তাগুতের স্বরূপ উন্মোচন
তাগুতকে ভালোভাবে বুঝতে হলে এর বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে জানা দরকার। নিচে কয়েকটি প্রধান রূপ আলোচনা করা হলো:
- শয়তান: শয়তান হলো প্রধান তাগুত, যে মানুষকে আল্লাহ্র পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং খারাপ কাজে উৎসাহিত করে।
- মূর্তি ও প্রতিমা: আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে কোনো মূর্তি বা প্রতিমার পূজা করাও তাগুতের অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীনকালে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী মূর্তিপূজা করত, যা সম্পূর্ণরূপে ইসলামে নিষিদ্ধ।
- জাদু ও গণক: যারা জাদুবিদ্যা ও গণকের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জানতে চায় বা অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তারাও তাগুতের অনুসারী।
- স্বৈরাচারী শাসক: যে শাসক আল্লাহ্র আইন অমান্য করে নিজের খেয়ালখুশি মতো আইন তৈরি করে এবং জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়, সেও তাগুত।
- ভ্রান্ত মতবাদ: ইসলামবিরোধী যেকোনো মতবাদ, যা মানুষকে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করে, তা-ও তাগুতের অংশ।
কুরআনে তাগুত
কুরআনে তাগুত সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে। সূরা বাকারার ২৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “লা ইকরাহা ফিদ্দিন ক্বাদ তাবাইয়ানার রুশদু মিনাল গায়্যি, ফামাইঁ ইয়াকফুর বিততাগুতি ওয়া ইউ’মিন বিল্লাহি ফাক্কাQueryWrapper qad ইস্তামসাকা বিল ‘উরওয়াতিল উসকা লানফিসামা লাহা, ওয়াল্লাহু সামিউন ‘আলিম।”
অর্থ: “দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয়ই হেদায়াত গোমরাহী থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে। অতএব, যে তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, সে এমন একটি মজবুত হাতল ধরেছে, যা কখনো ভাঙবে না। আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন।”
এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে তাগুতকে অস্বীকার করার এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন।
কেন তাগুতকে পরিহার করা উচিত?
ইসলামের মূল ভিত্তি হলো তাওহীদ, অর্থাৎ আল্লাহ এক। তাগুত হলো এই তাওহীদের পরিপন্থী। তাগুতকে পরিহার করার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- আল্লাহর অসন্তুষ্টি: তাগুতের অনুসরণ করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এবং এর ফলে ইহকাল ও পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়।
- পথভ্রষ্টতা: তাগুত মানুষকে সত্য পথ থেকে দূরে সরিয়ে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে। ফলে মানুষ সঠিক জীবনযাপন করতে পারে না।
- বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি: তাগুত সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি করে। যখন মানুষ আল্লাহ্র আইন অমান্য করে নিজেদের আইন তৈরি করে, তখন সমাজে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
- মানসিক অশান্তি: তাগুতের পথে চললে মানুষের মনে শান্তি থাকে না। কারণ, তারা সবসময় একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে এবং সঠিক পথের সন্ধান পায় না।
তাগুত থেকে বাঁচার উপায়
তাগুত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হবে। নিচে কয়েকটি উপায় আলোচনা করা হলো:
- আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস: আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস হতে হবে অবিচল ও অটল। কোনো পরিস্থিতিতেই আল্লাহকে ভুলে যাওয়া চলবে না।
- কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ: কুরআন ও সুন্নাহ হলো আমাদের জীবন পরিচালনার মূল পথপ্রদর্শক। তাই, এই দুটিকে সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে।
- ইসলামী জ্ঞান অর্জন: তাগুত সম্পর্কে জানতে হলে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। কুরআন, হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা তাগুত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি।
- সৎ সঙ্গ নির্বাচন: সৎ সঙ্গ মানুষকে ভালো পথে চলতে সাহায্য করে। তাই, সবসময় ধার্মিক ও সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করা উচিত।
- দোয়া ও ইস্তিগফার: আল্লাহর কাছে নিয়মিত দোয়া করতে হবে, যাতে তিনি আমাদের তাগুতের পথ থেকে রক্ষা করেন। এছাড়া, অতীতের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
তাগুত চেনার উপায়
আপনি কিভাবে বুঝবেন যে কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা ধারণা তাগুতের অন্তর্ভুক্ত? নিচে কিছু লক্ষণ দেওয়া হলো:
বৈশিষ্ট্য | তাগুত | আল্লাহর পথ |
---|---|---|
উৎস | মানুষের তৈরি নিয়ম বা খেয়ালখুশি | আল্লাহর নির্দেশিত পথ (কুরআন ও সুন্নাহ) |
উদ্দেশ্য | দুনিয়াবি স্বার্থ ও ক্ষমতা লাভ | আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন |
ফল | সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি | সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা |
অনুসরণকারী | যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কিছুর আনুগত্য করে | যারা আল্লাহর প্রতি অনুগত |
দৈনন্দিন জীবনে তাগুত
আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও তাগুতের প্রভাব দেখা যায়। অনেক সময় আমরা না জেনেও তাগুতের অনুসরণ করি। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- ফ্যাশন: আধুনিক ফ্যাশনের নামে অনেক সময় এমন পোশাক পরা হয়, যা ইসলামী শালীনতাবোধের পরিপন্থী। এটা এক ধরনের তাগুতের অনুসরণ।
- গান ও সিনেমা: ইসলামবিরোধী গান ও সিনেমা দেখা বা শোনাও তাগুতের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো মানুষের মনকে কলুষিত করে এবং খারাপ কাজে উৎসাহিত করে।
- জুয়া ও মাদক: জুয়া খেলা ও মাদক সেবন করা সম্পূর্ণরূপে হারাম এবং এগুলো তাগুতের অংশ।
- সুদ: সুদের লেনদেন ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যারা সুদের সঙ্গে জড়িত, তারা তাগুতের পথে চলে।
কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এখানে তাগুত সম্পর্কে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তাদের উত্তর দেওয়া হলো:
-
প্রশ্ন: তাগুত কি শুধু মূর্তিপূজার মধ্যে সীমাবদ্ধ?
উত্তর: না, তাগুত শুধু মূর্তিপূজার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা ধারণার উপাসনা করা অথবা আল্লাহ্র আইনের পরিবর্তে অন্য কোনো আইন অনুসরণ করাও তাগুতের অন্তর্ভুক্ত।
-
প্রশ্ন: কিভাবে বুঝব যে আমি তাগুতের অনুসরণ করছি কিনা?
উত্তর: যদি আপনি আল্লাহ্র নির্দেশের চেয়ে অন্য কোনো কিছুর নির্দেশকে বেশি গুরুত্ব দেন অথবা আল্লাহ্র আইনের পরিবর্তে অন্য কোনো আইন অনুসরণ করেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনি তাগুতের অনুসরণ করছেন।
-
প্রশ্ন: তাগুতের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করা যায়?
উত্তর: তাগুতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে প্রথমে নিজেকে সংশোধন করতে হবে। এরপর কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করে অন্যদেরকেও তাগুত সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাগুতের বিরোধিতা করতে হবে এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে।
-
প্রশ্ন: বর্তমান সমাজে তাগুতের উদাহরণ কি কি?
উত্তর: বর্তমান সমাজে তাগুতের অনেক উদাহরণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ইসলামবিরোধী আইন, দুর্নীতি, মাদক, জুয়া, সুদ এবং অশ্লীলতা। এছাড়াও, যারা আল্লাহ্র পরিবর্তে অন্য কারো নামে শপথ করে অথবা আল্লাহ্র বিধানের বিরোধিতা করে, তারাও তাগুতের অনুসারী।
উপসংহার
“তাগুত” একটি গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামে এর তাৎপর্য অনেক। আমরা যদি আমাদের জীবনে আল্লাহ্র বিধানকে অনুসরণ করি এবং তাগুতকে পরিহার করি, তবেই আমরা সফল হতে পারব।
আশা করি, এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আপনি “তাগুত” সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। যদি আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।