আসুন, একটা মজার খেলা খেলি! ধরুন, আপনি একটা চুম্বক হাতে নিলেন আর আমি একটা তারের কুণ্ডলী। আপনি যখন চুম্বকটা কুণ্ডলীর কাছে আনছেন, তখন কুণ্ডলীতে একটা কারেন্ট তৈরি হচ্ছে! জাদু, তাই না? এই জাদুটাকেই বলে তাড়িতচৌম্বক আবেশ। এই ব্লগ পোস্টে আমরা এই বিষয় নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব।
তাড়িতচৌম্বক আবেশ কী? (What is Electromagnetic Induction?)
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যখন কোনো পরিবাহী তারের (যেমন তামার তার) মধ্যে দিয়ে পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র যায়, তখন ওই তারের মধ্যে একটি তড়িৎচালক বল (electromotive force) বা ভোল্টেজ তৈরি হয়। এই ঘটনাকেই তাড়িতচৌম্বক আবেশ বলে। মানে, চুম্বক ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন! ভাবুন তো, কী চমৎকার একটা ব্যাপার!
কিন্তু পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র মানে কী? এর মানে হল, চৌম্বক ক্ষেত্রের তীব্রতা বা দিক সময়ের সাথে সাথে বদলাতে হবে। স্থির চুম্বক দিয়ে কিন্তু কাজ হবে না, চুম্বকটাকে নাড়াচাড়া করতে হবে অথবা চৌম্বক ক্ষেত্রের আশেপাশে তারের কুণ্ডলীটিকে ঘোরাতে হবে।
তাড়িতচৌম্বক আবেশের পেছনের বিজ্ঞান (The Science Behind Electromagnetic Induction)
এই ঘটনার মূল কারণ হল ফ্যারাডে’র সূত্র (Faraday’s Law)। এই সূত্র অনুযায়ী, কোনো বদ্ধ বর্তনীর (closed circuit) সাথে জড়িত চৌম্বক ফ্লাক্সের (magnetic flux) পরিবর্তনের হার ওই বর্তনীতে উৎপন্ন হওয়া তড়িৎচালক বলের সমানুপাতিক।
গণিতের ভাষায়:
ε = – dΦ / dt
এখানে,
- ε হল তড়িৎচালক বল (electromotive force)
- Φ হল চৌম্বক ফ্লাক্স (magnetic flux)
- dΦ / dt হল চৌম্বক ফ্লাক্সের পরিবর্তনের হার
এই সূত্রের ঋণাত্মক চিহ্নটি ল Lenz’s Law (লেনজের সূত্র) নির্দেশ করে। এই সূত্র অনুযায়ী, আ induced current (আবিষ্ট প্রবাহ) এমন দিকে প্রবাহিত হয়, যা সেই পরিবর্তনের কারণকে বাধা দেয়। অনেকটা যেন “যেখানে মাছি, সেখানেই বাড়ি”!
চৌম্বক ফ্লাক্স (Magnetic Flux): একটা সহজ ধারণা
চৌম্বক ফ্লাক্স অনেকটা যেন কোনো জায়গায় কতগুলো চৌম্বক রেখা (magnetic field lines) লম্বভাবে পড়ছে তার সংখ্যার মতো। যত বেশি রেখা, ফ্লাক্স তত বেশি। আর ফ্লাক্সের পরিবর্তন মানে হল এই রেখার সংখ্যা কমা বা বাড়া।
তাড়িতচৌম্বক আবেশের প্রকারভেদ (Types of Electromagnetic Induction)
তাড়িতচৌম্বক আবেশ মূলত দুই ধরনের হতে পারে:
স্ব-আবেশ (Self-Induction)
যখন কোনো কুণ্ডলীতে (coil) প্রবাহিত কারেন্ট পরিবর্তিত হয়, তখন সেই কুণ্ডলীতেই একটি তড়িৎচালক বল আবিষ্ট হয় (induced)। এটিকে স্ব-আবেশ বলে। অনেকটা নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো! কুণ্ডলীতে কারেন্ট বাড়লে, আবিষ্ট তড়িৎচালক বল কারেন্টকে কমাতে চেষ্টা করে, আর কারেন্ট কমলে বাড়াতে চেষ্টা করে।
পারস্পরিক আবেশ (Mutual Induction)
যদি দুটি কুণ্ডলী খুব কাছাকাছি থাকে, এবং একটি কুণ্ডলীতে কারেন্ট পরিবর্তন করা হয়, তাহলে দ্বিতীয় কুণ্ডলীতেও একটি তড়িৎচালক বল আবিষ্ট হয়। এটিকে পারস্পরিক আবেশ বলে। ট্রান্সফরমার এই নীতির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। অনেকটা যেন বন্ধুর বিপদে এগিয়ে আসা!
তাড়িতচৌম্বক আবেশের ব্যবহার (Applications of Electromagnetic Induction)
তাড়িতচৌম্বক আবেশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক কাজে লাগে। এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার নিচে উল্লেখ করা হল:
- জেনারেটর (Generator): জেনারেটরের মূল কাজ হল যান্ত্রিক শক্তিকে (mechanical energy) বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা। এটি তাড়িতচৌম্বক আবেশের নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। জেনারেটরে একটি চুম্বকক্ষেত্র থাকে এবং এর মধ্যে একটি তারের কুণ্ডলী ঘোরে। কুণ্ডলী ঘোরার ফলে চৌম্বক ফ্লাক্সের পরিবর্তন হয় এবং বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
- ট্রান্সফরমার (Transformer): ট্রান্সফরমার ভোল্টেজ বাড়াতে বা কমাতে ব্যবহৃত হয়। এটি পারস্পরিক আবেশের নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। ট্রান্সফরমারে দুটি কুণ্ডলী থাকে – একটি প্রাথমিক (primary) কুণ্ডলী এবং অন্যটি মাধ্যমিক (secondary) কুণ্ডলী। যখন প্রাথমিক কুণ্ডলীতে পরিবর্তনশীল কারেন্ট পাঠানো হয়, তখন মাধ্যমিক কুণ্ডলীতে একটি তড়িৎচালক বল আবিষ্ট হয়।
- বৈদ্যুতিক মোটর (Electric Motor): যদিও মোটর তাড়িতচৌম্বক বলের (electromagnetic force) ওপর ভিত্তি করে কাজ করে, তবে এর কার্যপ্রণালীতে তাড়িতচৌম্বক আবেশের ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ।
- ইনডাকশন কুকার (Induction Cooker): এই কুকারে তাড়িতচৌম্বক আবেশের মাধ্যমে পাত্র গরম করা হয়। কুকারের নিচে থাকা কুণ্ডলীতে উচ্চ কম্পাঙ্কের (high frequency) কারেন্ট প্রবাহিত করা হয়, যা পাত্রের মধ্যে এডি কারেন্ট (eddy current) তৈরি করে এবং পাত্র গরম হয়।
- মেটাল ডিটেক্টর (Metal Detector): মেটাল ডিটেক্টরে একটি কুণ্ডলী থাকে যা একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। যখন কোনো ধাতব বস্তু এই ক্ষেত্রের মধ্যে আসে, তখন বস্তুর মধ্যে এডি কারেন্ট তৈরি হয়। এই কারেন্ট মূল চৌম্বক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে, যা ডিটেক্টর শনাক্ত করতে পারে।
তাড়িতচৌম্বক আবেশ নিয়ে কিছু মজার প্রশ্ন (FAQs About Electromagnetic Induction)
তাড়িতচৌম্বক আবেশের জনক কে? (Who discovered electromagnetic induction?)
মাইকেল ফ্যারাডে (Michael Faraday) ১৮৩১ সালে তাড়িতচৌম্বক আবেশ আবিষ্কার করেন। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী।
তাড়িতচৌম্বক আবেশের একক কী? (What is the unit of electromagnetic induction?)
তড়িৎচালক বলের একক হল ভোল্ট (Volt)।
ফ্যারাডের সূত্র কী? (What is Faraday’s Law?)
ফ্যারাডের সূত্র অনুযায়ী, কোনো বদ্ধ বর্তনীর সাথে জড়িত চৌম্বক ফ্লাক্সের পরিবর্তনের হার ওই বর্তনীতে উৎপন্ন হওয়া তড়িৎচালক বলের সমানুপাতিক।
লেনজের সূত্র কী? (What is Lenz’s Law?)
লেনজের সূত্র অনুযায়ী, আ induced current (আবিষ্ট প্রবাহ) এমন দিকে প্রবাহিত হয়, যা সেই পরিবর্তনের কারণকে বাধা দেয়।
ট্রান্সফরমারে কোন ধরনের আবেশ ব্যবহার করা হয়? (Which type of induction is used in a transformer?)
ট্রান্সফরমারে পারস্পরিক আবেশ (mutual induction) ব্যবহার করা হয়।
তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ (Electromagnetic wave) কিভাবে তৈরি হয়?
তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ তৈরি হওয়ার মূলে রয়েছে তাড়িতচৌম্বক আবেশের ধারণা। যখন একটি চার্জিত কণা (charged particle) ত্বরণ অনুভব করে, তখন সেটি বিদ্যুৎক্ষেত্র (electric field) ও চৌম্বকক্ষেত্র (magnetic field) তৈরি করে, যা একে অপরের সাথে লম্বভাবে স্পন্দিত হয় এবং তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পরে।
তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালী (Electromagnetic spectrum) কী?
আলো, রেডিও তরঙ্গ, এক্স-রে – এগুলো সবই তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ। এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য (wavelength) এবং কম্পাঙ্কের (frequency) ভিন্নতার ওপর ভিত্তি করে একটি সারণীতে সাজানো হয়, যাকে তাড়িতচৌম্বকীয় বর্ণালী বলে।
তাড়িতচৌম্বক বল (Electromagnetic force) কী?
দুটি চার্জিত কণার মধ্যে যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল কাজ করে, তাকে তাড়িতচৌম্বক বল বলে। এই বল বিদ্যুৎ এবং চুম্বক উভয় ক্ষেত্রেই কাজ করে।
তাড়িতচৌম্বকীয় ক্ষেত্র (Electromagnetic field) কী?
চার্জিত কণা বা চুম্বকের চারপাশে যে অঞ্চল জুড়ে তার প্রভাব থাকে, তাকে তাড়িতচৌম্বকীয় ক্ষেত্র বলে।
তাড়িতচৌম্বকীয় আবেশ এবং তাড়িতস্থৈতিক আবেশের (Electrostatic induction) মধ্যে পার্থক্য কী?
তাড়িতচৌম্বকীয় আবেশে পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়, যেখানে তাড়িতস্থৈতিক আবেশে একটি চার্জিত বস্তুর কাছে অন্য একটি পরিবাহী আনলে তাতে চার্জের পুনর্বিন্যাস ঘটে।
এডি কারেন্ট (Eddy current) কী?
পরিবাহী পদার্থের মধ্যে যখন পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র যায়, তখন পরিবাহীর মধ্যে বৃত্তাকার পথে যে কারেন্ট তৈরি হয়, তাকে এডি কারেন্ট বলে।
তাড়িতচৌম্বকীয় শিল্ডিং (Electromagnetic shielding) কী?
কোনো যন্ত্র বা স্থানকে তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচানোর জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাকে তাড়িতচৌম্বকীয় শিল্ডিং বলে।
তাড়িতচৌম্বকীয় দূষণ (Electromagnetic pollution) কী?
মোবাইল ফোন, ওয়াইফাই রাউটার, বৈদ্যুতিক তার ইত্যাদি থেকে নির্গত তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গের কারণে পরিবেশের যে দূষণ হয়, তাকে তাড়িতচৌম্বকীয় দূষণ বলে।
বাস্তব জীবনে তাড়িতচৌম্বক আবেশের কিছু উদাহরণ (Real Life Examples of Electromagnetic Induction)
- মোবাইল ফোনের ওয়্যারলেস চার্জিং (wireless charging): এখানে একটি চার্জিং প্যাড এবং ফোনের মধ্যে থাকা কুণ্ডলীর মধ্যে পারস্পরিক আবেশের মাধ্যমে বিদ্যুৎ স্থানান্তরিত হয়।
- এটিএম কার্ডের ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ (magnetic strip): কার্ড রিডারের মধ্যে যখন কার্ড সোয়াইপ করা হয়, তখন স্ট্রিপের চৌম্বক ক্ষেত্র রিডারের কুণ্ডলীতে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে, যা কার্ডের তথ্য পড়তে সাহায্য করে।
- গাড়ি বা বাইকের স্পিডোমিটার (speedometer): কিছু স্পিডোমিটারে চাকার ঘূর্ণন একটি তারের মধ্যে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে, যা স্পিড নির্দেশ করে।
- ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র (seismograph): কিছু সিসমোগ্রাফে কুণ্ডলী ও চুম্বকের ব্যবহার করা হয়। ভূকম্পনের ফলে কুণ্ডলী চুম্বকের সাপেক্ষে নড়ে ওঠে এবং বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, যা ভূকম্পনের তীব্রতা মাপতে সাহায্য করে।
- গিটারের পিকআপ (guitar pickup): গিটারের তার যখন কাঁপে, তখন তারের নিচে থাকা পিকআপের কুণ্ডলীতে একটি ভোল্টেজ তৈরি হয়, যা অ্যাম্পলিফায়ারে (amplifier) পাঠানো হয় এবং শব্দ উৎপন্ন হয়।
শেষ কথা (Conclusion)
তাহলে, তাড়িতচৌম্বক আবেশ শুধু একটা বিজ্ঞানের বিষয় নয়, এটা আমাদের জীবনযাত্রার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। জেনারেটর থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনের চার্জিং – সর্বত্রই এর ব্যবহার বিদ্যমান। এই বিষয় সম্পর্কে আরও জানতে এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে চিন্তা করতে থাকুন। কে বলতে পারে, হয়ত আপনিই একদিন নতুন কোনো উদ্ভাবন করে ফেলবেন! আপনার যদি এই বিষয়ে আরো কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমি অবশ্যই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। ভালো থাকবেন!