আচ্ছা, তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস নিয়ে ভাবছেন? ভয় নেই, আসুন আমরা একদম সহজ করে জেনে নিই!
নিশ্চয়ই সেই ছোটবেলার বিজ্ঞান ক্লাসের কথা মনে আছে, যেখানে পদার্থের গঠন নিয়ে আলোচনা করা হতো? সেই পরমাণু, নিউক্লিয়াস, ইলেকট্রন… মনে আছে তো? আজকের আলোচনা সেই নিউক্লিয়াসের একটা বিশেষ রূপ নিয়ে – তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস।
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস: সহজ ভাষায় বুঝুন
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস (Radioactive Nucleus) হলো সেই অস্থির প্রকৃতির নিউক্লিয়াস, যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন কণা (যেমন আলফা কণা, বিটা কণা) এবং তেজস্ক্রিয় রশ্মি (গামা রশ্মি) নিঃসরণ করে অন্য নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে তেজস্ক্রিয় ক্ষয় (Radioactive Decay) বলা হয়।
নিউক্লিয়াসের অন্দরমহল: একটু গভীরে যাওয়া যাক
পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস। আর এই নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন (ধনাত্মক চার্জযুক্ত) এবং নিউট্রন (চার্জবিহীন)। প্রোটন সংখ্যা কোনো মৌলের পরিচয় নির্ধারণ করে, যাকে পারমাণবিক সংখ্যা (Atomic Number) বলা হয়। এখন, নিউক্লিয়াসের স্থিতিশীলতার জন্য প্রোটন ও নিউট্রনের একটা নির্দিষ্ট অনুপাত থাকা দরকার। যখন এই অনুপাত ঠিক থাকে না, তখনই নিউক্লিয়াস অস্থির হয়ে পড়ে এবং তেজস্ক্রিয়তা দেখায়। অনেকটা যেন সংসারে শান্তি বজায় রাখার জন্য একটা ব্যালেন্স দরকার, তেমনই!
কেন এই তেজস্ক্রিয়তা?
নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটনগুলো একে অপরকে বিকর্ষণ করে (কারণ তারা সবাই পজিটিভ চার্জযুক্ত)। নিউট্রনগুলো এখানে বাইন্ডিং ফোর্সের (binding force) মাধ্যমে প্রোটনগুলোকে একত্রে ধরে রাখে। যদি নিউট্রনের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম বা বেশি হয়, তাহলে নিউক্লিয়াসের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। এই অস্থির নিউক্লিয়াসগুলো তখন তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত করে স্থিতিশীল হওয়ার চেষ্টা করে। বিষয়টা অনেকটা এমন, যেন অতিরিক্ত চাপ কমাতে কেউ জোরে শ্বাস নেয়!
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াসের প্রকারভেদ
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস বিভিন্ন ধরনের তেজস্ক্রিয় ক্ষয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থিতিশীল হয়। এদের মধ্যে কয়েকটা প্রধান প্রক্রিয়া আলোচনা করা হলো:
আলফা ক্ষয় (Alpha Decay)
আলফা কণা হলো দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন সমন্বিত একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস (4He)। যখন কোনো নিউক্লিয়াস আলফা কণা নিঃসরণ করে, তখন তার পারমাণবিক সংখ্যা ২ কমে যায় এবং ভর সংখ্যা ৪ কমে যায়।
আলফা ক্ষয়ের উদাহরণ
ইউরেনিয়াম-২৩৮ (238U) আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে থোরিয়াম-২৩৪ (234Th)-এ রূপান্তরিত হয়:
238U → 234Th + 4He
বিটা ক্ষয় (Beta Decay)
বিটা ক্ষয় দুই ধরনের হতে পারে: বিটা মাইনাস (β–) ক্ষয় এবং বিটা প্লাস (β+) ক্ষয়।
বিটা মাইনাস (β–) ক্ষয়
এই প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াসের একটি নিউট্রন একটি প্রোটন, একটি ইলেকট্রন (বিটা কণা) এবং একটি অ্যান্টি-নিউট্রিনোতে রূপান্তরিত হয়। ইলেকট্রনটি নিউক্লিয়াস থেকে নির্গত হয়। এর ফলে পারমাণবিক সংখ্যা ১ বাড়ে, কিন্তু ভর সংখ্যা একই থাকে।
উদাহরণ: কার্বন-১৪ (14C) বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে নাইট্রোজেন-১৪ (14N)-এ রূপান্তরিত হয়:
14C → 14N + β– + ν̄e
বিটা প্লাস (β+) ক্ষয়
এই প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াসের একটি প্রোটন একটি নিউট্রন, একটি পজিট্রন (বিটা কণার প্রতিরূপ) এবং একটি নিউট্রিনোতে রূপান্তরিত হয়। পজিট্রনটি নিউক্লিয়াস থেকে নির্গত হয়। এর ফলে পারমাণবিক সংখ্যা ১ কমে যায়, কিন্তু ভর সংখ্যা একই থাকে।
উদাহরণ: সোডিয়াম-২২ (22Na) বিটা প্লাস ক্ষয়ের মাধ্যমে নিয়ন-২২ (22Ne) এ রূপান্তরিত হয়:
22Na → 22Ne + β+ + νe
গামা ক্ষয় (Gamma Decay)
গামা ক্ষয় সাধারণত আলফা বা বিটা ক্ষয়ের পরেই ঘটে। যখন আলফা বা বিটা কণা নির্গত হয়, তখন নতুন নিউক্লিয়াসটি উচ্চ শক্তিস্তরে (Excited State) থাকতে পারে। এই অতিরিক্ত শক্তি গামা রশ্মি (উচ্চ শক্তির ফোটন) আকারে নির্গত করে নিউক্লিয়াসটি স্থিতিশীল হয়। গামা ক্ষয়ে পারমাণবিক সংখ্যা বা ভর সংখ্যার কোনো পরিবর্তন হয় না।
উদাহরণ: বেরিয়াম-১৩৭m (137mBa) গামা ক্ষয়ের মাধ্যমে বেরিয়াম-১৩৭ (137Ba) এ রূপান্তরিত হয়:
137mBa → 137Ba + γ
ইলেকট্রন ক্যাপচার (Electron Capture)
এই প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াসের একটি প্রোটন নিউক্লিয়াসের ভেতরের স্তরের একটি ইলেকট্রনকে ধরে নিউট্রনে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে একটি নিউট্রিনো নির্গত হয়। এক্ষেত্রে পারমাণবিক সংখ্যা ১ কমে যায়, কিন্তু ভর সংখ্যা একই থাকে।
উদাহরণ: আর্গন-৩৭ (37Ar) ইলেকট্রন ক্যাপচারের মাধ্যমে ক্লোরিন-৩৭ (37Cl) এ রূপান্তরিত হয়:
37Ar + e– → 37Cl + νe
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াসের ব্যবহার
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াসের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে আমরা অনেক কথা শুনি, তবে এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারও রয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
চিকিৎসা ক্ষেত্রে
- রোগ নির্ণয় (Diagnosis): তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ছবি তোলা হয়, যা রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে। যেমন, থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য আয়োডিন-১৩১ (I-131) ব্যবহার করা হয়।
- চিকিৎসা (Treatment): ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করা হয়। কোবাল্ট-৬০ (Co-60) থেকে নির্গত গামা রশ্মি ক্যান্সার চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত।
শিল্প ক্ষেত্রে
- বেধ নির্ণয় (Thickness Measurement): কোনো বস্তুর পুরুত্ব মাপার জন্য তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করা হয়।
- ফাটল নির্ণয় (Crack Detection): ধাতব বস্তুর মধ্যে কোনো ফাটল থাকলে তা তেজস্ক্রিয় রশ্মি দিয়ে শনাক্ত করা যায়।
কৃষি ক্ষেত্রে
- বীজ সংরক্ষণ (Seed Preservation): তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে বীজের গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ রাখা যায় এবং পোকামাকড় থেকে রক্ষা করা যায়।
- উদ্ভিদের পুষ্টি (Plant Nutrition): তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা যায়।
ভূতত্ত্ব ও archeology ক্ষেত্রে
- ভূগর্ভের বয়স নির্ণয় (Dating): তেজস্ক্রিয় কার্বন ডেটিং (Carbon-14 dating) ব্যবহার করে পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং শিলাখণ্ডের বয়স নির্ধারণ করা হয়। যেমন, কোনো জীবাশ্ম কত বছর আগের, তা জানার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াসের ঝুঁকি ও সতর্কতা
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াসের অনেক উপকারী দিক থাকলেও, এর কিছু ঝুঁকিও আছে। তেজস্ক্রিয় রশ্মি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এটি ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে, এবং বংশগত ত্রুটি ঘটাতে পারে।
ঝুঁকি কমাতে সতর্কতা
- তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে আসার সময় বিশেষ পোশাক ও সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে।
- তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও অপসারণ করতে হবে।
- চিকিৎসার ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহারের সময় ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস নিয়ে আপনাদের মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
তেজস্ক্রিয়তা কি ক্ষতিকর?
সব তেজস্ক্রিয়তা ক্ষতিকর নয়। তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এবং exposure-এর সময়ের উপর নির্ভর করে এটি ক্ষতিকর হতে পারে। নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তা অনেক ক্ষেত্রে উপকারী, যেমন রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায়।
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ কি?
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ হলো সেইসব আইসোটোপ, যাদের নিউক্লিয়াস তেজস্ক্রিয় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে কণা বা রশ্মি নির্গত করে। উদাহরণস্বরূপ, কার্বন-১৪ (Carbon-14) একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ।
তেজস্ক্রিয় দূষণ কিভাবে হয়?
তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়লে তেজস্ক্রিয় দূষণ হয়। এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন পারমাণবিক দুর্ঘটনা, তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের ভুল ব্যবস্থাপনা, ইত্যাদি।
তেজস্ক্রিয়তা মাপার একক কি?
তেজস্ক্রিয়তা মাপার কয়েকটি একক হলো:
- বেকেরেল (Becquerel, Bq): এটি হলো তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের আন্তর্জাতিক একক। প্রতি সেকেন্ডে একটি ক্ষয় ঘটলে তাকে ১ বেকেরেল বলে।
- কুরি (Curie, Ci): এটি তেজস্ক্রিয়তা মাপার পুরনো একক। ১ কুরি হলো প্রতি সেকেন্ডে 3.7 x 1010 টি ক্ষয়।
Half-life বা অর্ধায়ু বলতে কী বোঝায়?
অর্ধায়ু (Half-life) হলো সেই সময়, যখন কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থের অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয় হয়ে যায়। প্রতিটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের অর্ধায়ু নির্দিষ্ট।
তেজস্ক্রিয়তা কিভাবে শনাক্ত করা যায়?
তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয়, যেমন:
- গেইগার-মুলার কাউন্টার (Geiger-Muller counter)
- সিন্টিলেশন ডিটেক্টর (Scintillation detector)
- ফিল্ম ব্যাজ (Film badge)
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য (Radioactive waste) কিভাবে নিরাপদে অপসারণ করা যায়?
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য অপসারণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। সাধারণত, এগুলোকে বিশেষ পাত্রে ভরে মাটির নিচে গভীর সুরক্ষিত স্থানে রাখা হয়, যাতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিবেশে ছড়াতে না পারে।
কোনো পদার্থ তেজস্ক্রিয় কিনা, তা কিভাবে বুঝব?
কোনো পদার্থ তেজস্ক্রিয় কিনা, তা বোঝার জন্য গামা রশ্মি বা অন্য কোনো তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শনাক্ত করতে হয়। গামা রশ্মি সনাক্ত করার জন্য গামা স্পেকট্রোমিটার ব্যবহার করা হয়।
আরও কিছু প্রশ্ন, যা আপনার মনে আসতে পারে:
- তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস আমাদের জীবনে কিভাবে প্রভাব ফেলে?
- তেজস্ক্রিয়তা থেকে বাঁচতে কী ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
- তেজস্ক্রিয়তা কি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা সম্ভব?
- তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকল্প উৎস কী হতে পারে?
শেষ কথা
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস বিষয়টি জটিল হলেও, দৈনন্দিন জীবনে এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। এর ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হয়ে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করলে আমরা এর সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে পারি। বিজ্ঞানকে ভয় নয়, বরং তাকে জানার এবং বোঝার চেষ্টা করুন। আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন! আর বিজ্ঞান বিষয়ক আরও নতুন কিছু জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।